বৈষম্য
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কর্মে প্রবেশে বাধা

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮-এর (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থা রয়েছে। সে অনুযায়ী সরকারের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ২০১২ সালে ১ শতাংশ কোটা বরাদ্দ করা হয়। এই ১ শতাংশ কোটাসহ সরকারি প্রথম শ্রেণির চাকরিতে কোটা হওয়ার কথা ৫৬ শতাংশ। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, উপজাতি কোটা ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ—মোট ৫৬ শতাংশ।
কিন্তু গত তিন বছরে সরকারি কর্ম কমিশন কর্তৃক এ নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি বলেই আমরা মনে করি। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ কোটা সেভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। সরকারি কর্ম কমিশনের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যায়, কোটা বণ্টনের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নারী, জেলা ও উপজাতি কোটার কথা উল্লেখ থাকলেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত ১ শতাংশ কোটার কথা এখানে উল্লেখ করা হয়নি। তাহলে কি আমরা ধরে নেব, সরকার নির্দেশিত কোটাব্যবস্থা মানছে না কর্ম কমিশন? নাকি মুখে উল্লেখ করলেও সরকার নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত মানতে আগ্রহী না?
একই বছর (২০১২ সালে) প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে বয়সসীমা করা হয়েছিল ৩২ বছর। কিন্তু সেটির কথাও ওয়েবসাইটে উল্লেখ নেই। তাহলে কি কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রবেশগম্যতা উপেক্ষিত থাকবে। সরকার প্রদত্ত এসব সুযোগ কি তাহলে শুভঙ্করের ফাঁকি?
সম্প্রতি ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় তিনজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ক্যাডার পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। মোট নিয়োগ পেয়েছে প্রায় দুই হাজার ২০০ জন। নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মাত্র তিনজনকে। শতাংশ হিসেবে যা ১ শতাংশের অনেক অনেক নিচে। কোন নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে এই মনোনয়ন? এটা কি কর্ম কমিশনের দয়া?
কোটাবিধি অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শূন্য পদে ১ শতাংশ নিয়োগের বিধান রয়েছে। আমরা জানি, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ বরাদ্দ থাকলেও সেখানে ২০১০ সালের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওই কোটা শূন্য থাকলেও তা অন্য প্রার্থী দিয়ে পূরণে বাধা রয়েছে। তা ছাড়া নারীদের জন্য ১০ শতাংশ ও জেলা কোটা ১০ শতাংশ সব সময় পূরণ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে কমিশনের এখনকার চাহিদা হচ্ছে, যদি উপজাতি কোটা শূন্য থাকে, সে ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের দিয়ে তা পূরণ করা যেতে পারে। উপজাতিদের জন্য বরাদ্দ কোটা পূরণ হয়ে গেলে প্রতিবন্ধীদের জন্য চাকরি ক্ষেত্রে আর কোনো সুযোগ থাকছে না।
আমরা জানতে পেরেছি, ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় কেবল শিক্ষা ক্যাডারে তিনজন প্রতিবন্ধীকে সুপারিশ করা হয়েছে। এ ক্যাডারের পদগুলো অধিকাংশ সময় পূরণ হয় না। কিন্তু অন্যান্য ক্যাডারে প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের বিবেচনাই করা হয়নি। শুধু শিক্ষা ক্যাডারেই কেন প্রতিবন্ধীদের বিবেচনা করা হবে? সাধারণ ক্যাডারে আবেদনকারী প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের বিসিএস স্বপ্ন কি অধরাই থেকে যাবে?
এটাই যদি হয়ে থাকে তাহলে যাঁরা আইন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, লোকপ্রশাসন, শিক্ষা ও গবেষণা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পড়বেন, সেসব চাকরিপ্রার্থী প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাছে বিসিএস কল্পনা হিসেবেই থেকে যাবে। কারণ, এসব বিষয় শিক্ষা ক্যাডারেও প্রযোজ্য নয়।
আবার অন্য এক হিসাবে ১ শতাংশ কোটাই সামগ্রিক হিসেবে বেশ অপ্রতুল। কেননা, যেকোনো ক্যাডারে পদসংখ্যা ৫০-এর কম হলে ১ শতাংশ গাণিতিক হিসাবে বিবেচিতই হয় না। আমরা দেখতে পাই, প্রশাসন ক্যাডার ও পুলিশ ক্যাডারে শতাধিক পদ থাকে। কিন্তু অন্যান্য ক্যাডারে সাধারণত ১০, ২০ কিংবা ৩০টির বেশি পদের জন্য সার্কুলারই হয় না। এই অঙ্কের মারপ্যাঁচে ১ শতাংশ কোনোভাবেই কার্যকর করা লাগে না কর্ম কমিশনের। যার মাধ্যমেও প্রতিবন্ধী নাগরিকরা বৈষম্যের শিকার হয়।
এমনিতেই প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বেশ অপ্রতুল, সমাজ-রাষ্ট্রে তাঁদের নানা ধরনের প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়। সে জন্যই উন্নত অনেক দেশ, এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও প্রতিবন্ধীদের জন্য নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। যেন তাঁরা সমাজের বৃহত্তর উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেন। আমাদের দেশেও নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে প্রতিবন্ধীদের এসব সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
কিন্তু এর বাস্তব প্রয়োগ বেশ দুরূহ হয়ে উঠছে। আর প্রতিবন্ধী প্রার্থীরাও এসব জটিলতার কারণে হতাশ হয়ে পড়ছেন।
৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় আমার পরিচিত কমপক্ষে পাঁচজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কোনো ক্যাডার পদে মনোনয়ন পাননি। কারণ, তাঁদের সবারই সাধারণ ক্যাডার পছন্দ ছিল।
এ অবস্থায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে আমরা নিম্নোক্ত দাবিগুলো করছি :
১. সার্কুলারে উল্লেখ করা মোট পদসংখ্যার ১ শতাংশ যেন প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ হয়।
২. শূন্য পদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ১ শতাংশ কোটা পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা কোটার মতো এটিও যেন সংরক্ষণ করা হয়।
৩. সাধারণ ও টেকনিক্যাল উভয় ক্ষেত্রেই যেন উল্লেখিত ১ শতাংশ কোটা বণ্টন করা হয়।
৪. যেসব ক্যাডার পদে একশর কম পদ থাকে, সেসব ক্যাডারের সম্মিলিত পদসংখ্যায় যেন ১ শতাংশ কোটা পূরণের ব্যবস্থা করা হয়।
৫. এ কোটা যেন বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী (যেমন—শারীরিক, দৃষ্টি ইত্যাদি) ব্যক্তির ক্ষেত্রে সমবণ্টন নীতি অনুসরণ করা হয়।
আমরা মনে করি, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেও আমলাদের অনীহা ও অবহেলার কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কর্মসংস্থানের বিষয়টি অনেকখানিই পিছিয়ে আছে। এ বিষয়ে সরকারের বিশেষত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
লেখক : সহকারী সচিব, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ।