পর্যটন
পর্যটকদের আকর্ষণে দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা

একটি দেশের পরিচিতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া কিংবা বিশ্ব প্রেক্ষাপটে দেশটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার কাজটি সহজ নয়। সম্ভাব্য সেই কঠিন উপায়গুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত সহজ হলো পর্যটন। পরিচিতি আর গুরুত্ব বাড়ানোর মাধ্যমে পর্যটন থেকে একটি দেশ বিপুল পরিমাণ আয়ও করতে পারে। এটি জিডিপিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। বিশ্ব ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিলের সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৩ সালে জিডিপিতে পর্যটনশিল্পের অবদান সিঙ্গাপুরে ৭৫ শতাংশ। আর ৫০ শতাংশের বেশি আসে তাইওয়ান, হংকং ও ফিলিপাইনে। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপের ক্ষেত্রে প্রায় পুরোটাই আসে পর্যটন খাত থেকে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ২ দশমিক ১০ শতাংশ!
পর্যটন বিকাশে সম্ভাবনাময় একটি দেশ বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক যেসব দর্শনীয় স্থান ও স্থাপনা পর্যটক আকর্ষণে ভূমিকা রাখে, তার সবকিছুই এখানে রয়েছে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, সেন্টমার্টিন, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, ফয়’স লেক, পাহাড়ে ঘেরা তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি ঝর্ণা-হ্রদ-পাহাড়, নীলগিরি, সাজেক, সিলেটের জাফলং, মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, চা বাগান, বিশ্বঐতিহ্য স্থাপনা হিসেবে ঘোষিত সুন্দরবন—এমন অজস্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার বাংলাদেশ। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছে আমাদের এই জন্মভূমিকে। এ ছাড়া ঐতিহাসিক অনেক স্থাপনা রয়েছে, যেগুলো বিশ্বের মাঝে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট।
জাতিসংঘের বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশের বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, খুলনা বিভাগের তিনটি জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা আর বাগেরহাটজুড়ে অবস্থিত বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন এবং নওগাঁর পাহাড়পুরকে (সোমপুর বিহার) বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া দেশের সোনালি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লায় অবস্থিত ময়নামতির পুরাকীর্তি, আড়াই হাজার বছর আগের মানববসতি ও সমৃদ্ধির ইতিহাসে ঢাকা নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর, ঢাকার লালবাগ দুর্গ, বাণিজ্য সমৃদ্ধির উদাহরণ সোনারগাঁ, শাহজালাল (রহ.), শাহপরাণ (রহ.), শাহ মখদুম (রহ.)সহ অসংখ্য অলি-আউলিয়ার পুণ্যস্মৃতিমহ স্থান রয়েছে।
শিক্ষার আলো ছড়ানো অতীশ দীপঙ্করের পিতৃভিটা, চন্দ্রনাথ পাহাড়, আদিনাথ মন্দির, ঢাকেশ্বরী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, গান্ধী আশ্রম, গুরুদুয়ারা নানকশাহিসহ দেশজুড়ে নানা ধর্ম ও বর্ণের অসংখ্য পুণ্যভূমি এখানে। রয়েছে শত বছরের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, নাটোরের উত্তরা গণভবন, রানী ভবানীর বাড়ি-দীঘি, রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ি, মানিকগঞ্জের বালিহাটি জমিদারবাড়িসহ ব্রিটিশ শাসনের নানা কীর্তি।
আর মসজিদের শহর হিসেবে পরিচিত ঢাকাজুড়ে অসংখ্য মসজিদ রয়েছে, যেটি এ অঞ্চলে মুসলিম শাসনের নানা দিক তুলে ধরে। বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, রাজশাহীর বাঘা মসজিদ, টাঙ্গাইলের আতিয়া মসজিদ, ঢাকার বিনত বিবির মসজিদসহ দেশজুড়েও রয়েছে ঐতিহাসিক হাজারো নিদর্শন।
রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের প্রত্ননিদর্শনই শুধু নয়, এটি নিজেই এখন কালের সাক্ষী। পুরো উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন জাদুঘরের একটি এটি।
চট্টগ্রামে রয়েছে এশিয়ার একমাত্র জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত হওয়া যোদ্ধাদের সমাধি।
দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মোগল, সুলতান, পাল, সেন, বারো ভূঁইয়া, ব্রিটিশ যুগের এমন হাজারো কীর্তি। এমন ইতিহাসসমৃদ্ধ জাতি বিশ্বের মাঝেই অত্যন্ত বিরল। এ অবস্থায় শুধু প্রত্ননিদর্শনকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের পর্যটন। এই শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে সমস্যা চিহ্নিত করে তা দূর করতে কার্যকর উদ্যোগ অপরিহার্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসাবে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশে ঘুরতে আসেন নয় লাখ মানুষ। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে যান গড়ে ১৫ লাখ। উল্টো চিত্র হওয়া উচিত ছিল। বিশ্বের ৭০টি দেশ থেকে বাংলাদেশে অন-অ্যারাইভাল সুবিধা রয়েছে। তার পরও বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে উৎসাহিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে সেসব দেশে স্থাপিত বাংলাদেশি দূতাবাস। এ জন্য সরকারের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
পর্যটনশিল্পের বিকাশে অভাব রয়েছে সুষ্ঠু পরিকল্পনার। যে পরিকল্পনাগুলো নেওয়া হয়, সেটিও বাস্তবায়ন করা হয় না ঠিকমতো। অসংখ্যবার সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো সমাধানের উদ্যোগ গতি পায়নি দীর্ঘদিনেও। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইনের অভাব, অনুন্নত অবকাঠামো, যোগাযোগব্যবস্থার বেহাল দশা, পরিকল্পনার অভাব, পর্যটনবিষয়ক গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তার অভাব, পর্যটন স্থান উন্নয়নে ব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাব, পর্যটন পণ্য বিপণনে পেশাদারিত্বের অভাব, বিভিন্ন দেশে স্থাপিত বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর প্রচারে সৃজনশীলতার অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করেছে। ইতিহাস আর নয়নাভিরাম প্রকৃতির অনন্য উপহার শস্য-শ্যামলা সুন্দর এই দেশ। সুপরিকল্পনা আর উদ্যোগ নিলে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প। এতে আমাদের গর্ব আর ভালোলাগা যেমন বাড়বে, দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতেও দারুণ ভূমিকা রাখবে, নিঃসন্দেহে।
লেখক : ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।