৫৭ ধারা
মত প্রকাশ ও স্বাধীনতা

মত প্রকাশের স্বাধীনতা তো আছেই; কিন্তু মত প্রকাশের পর স্বাধীনতা থাকবে কি না, এই গ্যারান্টি তো কেউ দেয়নি। মত প্রকাশ করুন স্বাধীনভাবে, আপনার মত পছন্দ না হলে ক্ষমতাবান প্রতিপক্ষও অনুভূতাধিকার বলে চাইলে আপনাকে জেলে পুরতে পারবে।
৫৭ ধারার একটা ‘মন্দের ভালো’ অবশ্য আছে। সেটা হলো, এ ধারার সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির একটা সম্পর্ক আছে। অন্তত ছিঁচকে চুরির মামলার চেয়ে সাতান্নর মামলা বেশি সম্মানজনক! এ জন্য নীতিনির্ধারকদের ধন্যবাদ না দিলেই নয়। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে এমন একটি ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ধারার আদৌ দরকার ছিল কি?
ডারউইনের বানর-তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক আছে। থাকুক, একটা তত্ত্ব কিন্তু হাড়ে হাড়ে সত্য, সারভাইবাল ফর দ্য ফিটেস্ট। আমি-আপনি এসবই জানি। এক দল ক্ষমতায় আছে, আরেক দল তাদের জন্য ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’। টিকে থাকার জন্য যেকোনো উপায়ে সেই ঝুঁকি নির্মূল করা চাই। এর মধ্যে আবার কিছু ঝুঁকি আছে, যার অস্তিত্ব বর্তমানে টের পাওয়া যায় না। কিন্তু ভবিষ্যতে বিষফোড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। হয়তো প্রতিপক্ষের কাছে এমন একটি ‘ঝুঁকি’ হয়ে গিয়েছিলেন সাতক্ষীরার মোহন কুমার মণ্ডল। তাই ক্ষমতাধর প্রতিপক্ষও তলে তলে ওত পেতে ছিল। দরকার ছিল জুতসই উপলক্ষের। আর সেটার দেখা মিলতেই ঝোপ বুঝে ছোড়া হলো সাতান্নর বাণ। দুই লাইনের মত প্রকাশ করেই স্বাধীনতা হারালেন মোহন। মিনিট বিশেকের মধ্যে সেটা মুছে দিয়েও নিস্তার মিলল না। এর পর দেখা যাবে ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে’ মোহন স্বীকার করেছেন... ইত্যাদি ।
একটা সোজাসাপ্টা প্রশ্ন রাখা যাক। হজবিষয়ক স্ট্যাটাস দেওয়ায় মোহনের বিরুদ্ধে শ্যামনগর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকবর কবীর মামলা করেছেন। স্ট্যাটাসে মোহন লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষও নিয়েছেন। স্ট্যাটাস দেওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যে আকবর কবীর মোহনের বিরুদ্ধে মামলা করলেন। তিনি এর আগে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মামলা করেননি কেন? তখন কি তাঁর অনুভূতি ছিল না? আশা করি, প্রশ্নটা মিথ্যা বা অশ্লীল নয়। বা প্রশ্নটা করার কারণে কেউ নীতিভ্রষ্ট হবেন না। কারো মানহানি ঘটবে কি না, বলতে পারছি না। তবে আইনশৃঙ্খলার অবনতি যে ঘটবে না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত।
লতিফ সিদ্দিকী বা মোহন মণ্ডলের স্ট্যাটাস আপাতত আলোচ্য নয়। বলছিলাম সাতান্ন ধারা ও মত প্রকাশের যৎকিঞ্চিৎ অধিকার (যদি আদৌ তা থেকে থাকে) প্রসঙ্গে। অনেক আইনজীবীও বলছেন, এ ধারা অস্পষ্ট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই যে কাউকে হুটহাট জেলে পুরে দেওয়া যাচ্ছে। মত প্রকাশের অধিকারের কফিনে শেষ পেরেকও বলছেন অনেকে। তাই একটা বড়সড় গোষ্ঠী মাঝেমধ্যেই হাঁক ছাড়ছেন এ ধারা বাতিলের দাবিতে। যেন ধারাটি বাতিল হলেই রক্ষে পায় ফ্রিডম অব স্পিচ ওরফে যেমন খুশি তেমন বলোর অধিকার।
আমার মনে হয়, এসব ‘ইস্যু’ একটা অদৃশ্য ভারী চাদরের ভোজবাজি। যে চাদর দিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঢেকে দেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার চোখ-কান-মুখ। যে চাদরের নিচে চাপা পড়ে আছে একটি শ্রেণি, ওপরে সজাগ আরেক শ্রেণি। বিভাজনের মাঝে আছে কেবল পুঁজি আর ক্ষমতার কাঁটাতার। চাদরটা করপোরেট, চাদরটা ক্ষমতার, চাদরটা নীলনকশার।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন, বাকস্বাধীনতা, অনুভূতি... চিন্তাশীল মাথাগুলোকে ব্যস্ত রাখতে চাই আরো আইটেম। মত প্রকাশ কিংবা চিন্তার স্বাধীনতার সঙ্গে আইনের পেঁচাপেঁচিতে আসলে চিন্তাশীলদের মগজের রাস্তা করে দেওয়া হচ্ছে সংকীর্ণ।
একটার পর একটা ইস্যু বাসনে-কোসনে সাজিয়ে হাজির করা হচ্ছে তাদের সামনে। এবার এটা নিয়ে দু-চার লাইন লেখো, খানিক ব্যস্ত থাকো, একটা-দুটো গ্রেফতার হোক, মানববন্ধন করো, স্ট্যাটাসের স্তূপ জমুক ইত্যাদি। সময়-সুযোগ বুঝে জামিনও পাবে ক্ষণ। ততদিনে পেরিয়ে যাবে অনেকখানি মূল্যবান সময়।
সাতান্ন ধারার আবির্ভাবের পর কতশত মানুষ কত হাজার শ্রমঘণ্টা ব্যয় করেছেন এর পেছনে, স্ট্যাটাস দিয়েছেন, কলাম লিখেছেন, কলাম পড়েছেন...। আমার-আপনার সময়ের দাম না থাক, বিশেষ শ্রেণির আছে, তাদের কাছে টাইম ইজ দ্য নিউ কারেন্সি। সময়ই টাকা, সময়ই পুঁজি। তাঁরা চান, যতক্ষণ পারো চিন্তকদের চোখে পট্টি বেঁধে রাখো। কে আগে জামায়াত করত, এখন উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি হয়েছে এসব না ঘেঁটে বরং কার কাছে কত ব্যবসা আছে, কার বাড়ির পাশে কোটি কোটি টাকা চোরাকারবারির সীমান্ত সেসব অঙ্ক বেশি দরকারি। ‘ওরা’ সাতান্ন নিয়ে পড়ে থাকুক। এই ফাঁকে যা অঙ্ক কষার করে নেওয়া যাক।
মিডিয়াও ইস্যুর পর ইস্যু হাতড়ায়। এটা তো সত্যি যে, শার্প শুটারের চোখেও ব্লাইন্ড স্পট থাকতে পারে। গণমাধ্যমের সেই ব্লাইন্ড স্পটেরও সুযোগ নিচ্ছে বিশেষ মহল। চোখের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে আরো অনেক ঘটনা, অনেক বড় লেনদেন। ক্ষমতাধরদের চালাকিটা কেউ ধরতে পারে না। তাঁরা একটা করে গিট্টু খোলেন, আর অমনি একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন সবাই। ফেসবুক আর অনলাইন হয়ে ওঠে তাঁদের চিন্তার মাপকাঠি, জিয়নকাঠি। সরকারও ক্যালকুলেটর নিয়ে মাপতে বসে, কোন সিচুয়েশনে কার দৌড় কতটুকু (ঠিক যেমনটা মাপা হয়েছিল ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে)। চলতে থাকে নতুন নতুন ছক। বড় একটা দান মারতে হবে, তো দুদিনের জন্য ‘মাথা’গুলোকে নতুন কিছু দিয়ে ব্যস্ত রাখা চাই। দুদিন পর তো লাউ-কদু মিলেমিশে একাকার।
সুতরাং সাতান্ন আসলে নিছক একটা সংখ্যা। একটা চলমান ‘সিস্টেমে’র আধুনিক অনুষঙ্গ মাত্র। তবে এ চাদরে ফুটো অনেক। কী করলে অপরাধ হবে, কখন কিসে কে উসকানি বোধ করবে, সেসবের কোনো পরিসীমা রাখা হয়নি ব্যাখ্যায়। তথ্য-প্রমাণ হিসেবে কী হাজির করতে হবে, সেসবেরও ঠিক নেই। তার পরও মামলা ঠোকা হচ্ছে দেদার (২০১৩ সালে চারটি, ২০১৪ সালে ৩৩টি, ২০১৫ সালে ৩৭টি)।
তাই ধারণা করা যায়, এ আইন বাতিল না হলে কিংবা স্রেফ ধারার দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক-গ্রেফতার বন্ধ না হলে ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করবে আসল ছক আর পাপেট নাচিয়ে গডফাদারদের চেহারা।
তো, পাঁচ-সাত না ভেবে চাপিয়ে দেওয়া চাদরের বাইরের জগৎটা কীভাবে চলছে, সেটা আঁচ করুন। সম্ভব হলে ফুটোয় চোখ রাখুন। ভলতেয়ার বলে গেছেন, যে শেকলটাকে লোকে পূজা করে, সে শেকল ভাঙা কঠিন। সুতরাং অপরের ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের গুটি না হয়ে চোখ-কান আরো প্রসারিত করুন। বড় ছবিটা বোঝার চেষ্টা করুন।
পরিশেষে ইন্টারনেটকে পাবলিক টয়লেটের দেয়াল বানালেও চলবে না। ওই দেয়ালে স্বাধীনভাবে যে যা-ই লিখুক, সেটা ঠিক মত প্রকাশ হয়ে ওঠে না।
লেখক : সাংবাদিক, বাংলা ট্রিবিউন।