মিনা ট্র্যাজেডি
সৌদি রাজকীয় বর্বরতার বলি ধর্মপ্রাণ মানুষ

১.
অনুভূতিপ্রবণ প্রত্যেক মানুষই তাঁর নিজ নিজ ধর্মের প্রতি এবং ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনের ক্ষেত্রে জীবন বাজি রাখেন। এটা কেবল মহান ঈশ্বরের প্রতি প্রেম বা তাঁর নৈকট্য লাভের ইচ্ছার এক অপার আধ্যাত্মিকতা থেকেই সম্ভবপর হয়ে ওঠে।
আমাদের ইসলাম ধর্মের পাঁচ স্তম্ভের শেষটি হলো সামর্থ্য থাকলে মহান আল্লাহ্র ঘরে গিয়ে হজ আদায় করা। আর এই সামর্থ্যের উপযোগিতা অর্জনের জন্য একজন মানুষকে সারা জীবন অপেক্ষা করে বয়োবৃদ্ধ হয়ে যেতে হয়। কিন্তু সেই তিনি নবী বা খোদাপ্রেমের আকাঙ্ক্ষাটা বয়ে বেড়ান জীবনভর। সেই প্রেমের পূর্ণতা দিতে লাখ টাকা ব্যয় করে জরাজীর্ণ শরীর নিয়েই তিনি হজে যান। অনুসন্ধান তাঁর একটাই, ধর্মালোকের পথ বেয়ে সত্য ও সুন্দরের সাধনায় এই মানবজীবনের সত্যিকারের মুক্তি। সেই মানবমুক্তির ধর্মানুভূতিকে নিয়ে যখন ভজনালয়ে চেপে বসা কোনো স্বার্থান্ধ চক্র লাভ-লোকসানের অঙ্ক কষে নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতা, অদূরদর্শিতা, দায়িত্বহীনতা বা খামখেয়ালিপনার প্রমাণ দেন-তখনই তাদের বর্বরতার বলি হন নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষ।
ইবাদত উৎসবের আনন্দটা অকাল রক্তপাত বা অসহায় প্রাণদানের করুণ ফল্গুধারায় পর্যবশিত হয়। এমনটাই আমরা দেখলাম এবারের হজে পদদলিত বা ক্রেনচাপায় হাজারো মানুষের প্রাণ হরণের মধ্যদিয়ে।
২.
সারা পৃথিবীর মুসলমানদের বিভিন্ন জাত-বর্ণ-গোষ্ঠী, আবালবৃদ্ধবণিতা সম্প্রীতির মহান ঐতিহ্য নিয়ে প্রতিবার হজেই সমবেত হন আরাফাতের ময়দানে। নিজেদের সকল রোগ-শোক, দীনতা বা অক্ষমতা ভুলে তাঁরা হজের কঠিন কার্যাবলি পালন করে যান হাসিমুখে। ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় লাখো মানুষের ভিড়ে দমবন্ধ অবস্থাকেও তাঁরা মেনে নেন। এ থেকে প্রতিবছর সৌদি সরকার অন্তত চার হাজার কোটি টাকা আদায় করে নিয়ে নিজেদের জিডিপি সমৃদ্ধ করে। কিন্তু হাজিদের নিরাপত্তায় ওই সরকারের নির্বিকারতা আকাশ ছুঁয়েই থাকে। এবারের হজের আগে মসজিদুল হারামের ওপর কয়েক টন ওজনের ক্রেন অযত্নে রাখা হলো। আর তা নিচে ভেঙে পড়ে ১২০ জন হাজির প্রাণ কেড়ে নিল।
দোষ চাপানো হলো ঝড়ের ওপর। এরপর হজের দিন স্মরণকালের ভয়াবহ ট্র্যাজেডি চাপিয়ে দেওয়া হলো হাজিদের ওপর। বড় জামারা বা বড় শয়তানের প্রতীকী স্তম্ভে পাথর মারাটা হজের অন্যতম অনুষঙ্গ। সে সময় মানুষ উদভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকে শয়তানের উদ্দেশে। গরম বা মানুষের ভয়ংকর ভিড় অত্যুঙ্গ ধ্যানে উপেক্ষা করেন হাজিরা। কিন্তু এবারের হজের সেই আনুষ্ঠানিকতার সময় সৌদি বিলাসী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তার ৩৫০ জন নিরাপত্তারক্ষীর বহরসহ পাঁচ বর্গকিলোমিটার এলাকা দাপিয়ে ভ্রমণবিলাস করতে চলে এলেন মিনার সেই জনারণ্যে। বন্ধ করে দেওয়া হলো তিনটি রাস্তার দুটোই। খোলা থাকা এক রাস্তাকেও করা হলো দ্বিমুখী। সামনে ধাবমান প্রায় পাগলপ্রায় হাজিদের থামিয়ে দেওয়া হলো শাহজাদা এই রাস্তায় যাবেন তাই। কিন্তু মানুষ থামল না। উঠে গেল একজন আরেকজনের ওপর। কারণ কেউ সামনেও যেতে পারছেন না, পেছানোরও সুযোগ নেই। ফলাফল সহস্রাধিক মানুষের অকাল প্রাণপাত। জখম হলেন আরো হাজারো মানুষ। স্রেফ যুবরাজের ভ্রমণবিলাসিতার বর্বরতার বলি হলেন আমাদের ধর্মপ্রাণ বাবা, মা, ভাই-বোনেরা। কষ্ট আরো বেড়ে গেল, যখন মানুষ তাঁর নিখোঁজ স্বজনের খোঁজটিও যথাসময়ে জানতে পারল না। কারণ ঘটনার পর সৌদি সরকার নিজেদের প্রিন্সকে আড়াল করে একটার পর একটা মিথ্যার নাটক সাজিয়ে যাচ্ছে। তারা দাবি করছে, আফ্রিকার একটি হাজি গ্রুপের সামনে এগুনোতে জোর প্রদর্শনকে কেন্দ্র করেই এই ঘটনা ঘটেছে। আবার ৭১৭ জন হাজির মৃত্যুর একই দাবি করে যাচ্ছে তিনদিন ধরে। অথচ বিশ্ব মিডিয়া দাবি করছে, অন্তত দুই হাজার মানুষ মারা গেছেন পদদলিত হয়ে। মক্কা ও মদিনার মতো পবিত্র নগরীর রক্ষক বলে যাঁরা নিজেদের ঘোষণা করেন, তাঁদের মুখে এমন অসত্য কেমনে মানায়!
৩.
তবে আমরা যদি ইতিহাসের পথে হেঁটে আসি তবে দেখব, বর্তমান সৌদি রাজবংশ আসলে চরমতম স্বৈরাচার, দখলদার, সাম্রাজ্যবাদী ইসরাইল, ব্রিটেন বা আমেরিকার দোসর, নারীলোলুপ, অর্থলোভী ছাড়া আর কিছু নয়। এদের মতো অমানুষের হাতে পবিত্র নগরীর দায়ভার ছেড়ে দিয়ে বিশ্ব মুসলমানদের চুপ করে বসে থাকার সময় শেষ হয়েছে কি না, ভাবার এখনই সময়! ইতিহাসবিদ ও মধ্যপ্রাচ্য বিশারদ নাসিরুস সাইদ প্রণীত ‘আল সৌদের ইতিহাস’ গ্রন্থমতে, ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের অনুচরও সেবাদাস আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ব্রিটেনের অনুমতি নিয়ে হিজাজের নাম পরিবর্তন করে নিজ বংশের নাম অনুযায়ী এই বিশাল আরব ভূখণ্ডের নাম রাখে সৌদি আরব। রক্তপাত, গণহত্যা ও প্রতারণার মাধ্যমে ইবনে সৌদ দখল করেছিল হিজাজ। এই দেশই (বর্তমান সৌদি আরব) বিশ্বের একমাত্র দেশ যার নামকরণ করা হয়েছে দেশটির সংখ্যালঘু একটি গোত্রের নাম অনুসারে। আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ছিল ‘নজদ’ নামক মরু অঞ্চলের অধিবাসী। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য সে ওয়াহাবি সম্প্রদায়ের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই উগ্র মতবাদটির জন্ম দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যালফোর ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই ঘোষণা ব্যালফোর ঘোষণা নামে ইতিহাসে খ্যাত। এ ঘোষণা দেওয়ার আগে ব্রিটিশরা সৌদি রাজা আবদুল আজিজের কাছ থেকে লিখিত সম্মতিপত্র আদায় করেছিল। ওই চিঠিতে লেখা ছিল : “আমি বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে আবদুর রহমান, ফয়সলের বংশধর ও সৌদের বংশধর, হাজারবার স্বীকার করছি ও জেনেশুনে বলছি যে, মহান ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি স্যার কুকাস-এর সামনে স্বীকারোক্তি করছি এই মর্মে যে, গরিব ইহুদিদের বা অন্য কাউকে ব্রিটিশ সরকার যদি ‘ফিলিস্তিন’ দান করে দেন তাহলে এতে আমার কোনো ধরনের আপত্তি নেই। বস্তুত আমি কিয়ামত পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের অভিমতের বাইরে যাব না।” ইতিহাসবিদ মুহাম্মাদ আলী সাইদ লিখিত ‘ব্রিটিশ ও ইবনে সৌদ’ গ্রন্থমতে, ব্রিটিশ সরকার আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের ক্ষমতা গ্রহণের উৎসবে স্যার কুকাসকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছিল। রাজা উপাধিতে বিভূষিত করে কুকাস তাকে বলেছিলেন, ‘হে আবদুল আজিজ, আপনি শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী’।
উত্তরে বাদশাহ বলেছিলেন, ‘আপনারাই আমার এ ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করেছেন ও এ সম্মান দান করেছেন। যদি মহান ব্রিটিশ সাম্রাজ্য না থাকত, তাহলে এখানে আবদুল আজিজ আল-সৌদ নামে কেউ আছে বলেই জানত না। আমি তো আপনাদের (ব্রিটিশদের) মাধ্যমেই ‘আমির আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ’ শীর্ষক খেতাবটি অর্জন করতে পেরেছি। আমি আপনাদের এই মহানুভবতা আজীবন ভুলব না। আর আমার বিগত আচরণ ছিল আপনাদের সেবক ও ফরমান বরদার (গোলাম) হিসেবে আপনাদের ইচ্ছাগুলো বাস্তবায়ন করা।’ ওই উৎসবে কুকাস ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া শাহি তামগা বা মেডেল রাজা আজিজের গলায় পরিয়ে দেয়। কুকাস বলে যায় : “অচিরেই আমরা আপনাকে হিজাজ ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলোর বাদশাহ বলেও ঘোষণা করব এবং তখন হিজাজকে ‘সৌদি সাম্রাজ্য’ বলে ঘোষণা করা হবে।” এ কথা শুনে বাদশাহ আজিজ স্যার কুকাসের কপালে চুমু খান এবং বলেন : ‘আল্লাহ যেন আমাদের (সৌদিদের) আপনাদের খেদমত (দাসত্ব) করার ও ব্রিটিশ সরকারের সেবা (গোলামি) করার তৌফিক দেন।’ ইদানীংকালে দেখা যাচ্ছে ওয়াহাবি মতবাদে বিশ্বাসী সেই সৌদি কর্তৃপক্ষ স্থাপনা নির্মাণের উদ্দেশ্যে সেই স্তম্ভটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে যেখান থেকে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পবিত্র মেরাজ বা ঊর্ধ্বাকাশ সফরের প্রাক্কালে মুসলমানদের প্রথম কিবলা বা আলকুদস অভিমুখে রওনা হয়েছিলেন। সৌদি ওয়াহাবি পুলিশ এই ধ্বংসযজ্ঞকে উৎসব হিসেবে পালন করেছিল বলে সে সময় বিশ্বের প্রধান দৈনিকগুলোতে খবর বেরোয়। সৌদি ওয়াহাবিরা সহিষ্ণুতা, বিশ্বজনীনতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও আধ্যাত্মিকতার মতো বিষয়গুলোকে ঘৃণা করে আর উগ্র ওয়াহাবিরা তাদের সমমনা ছাড়া অন্য সব মুসলমানকে ‘কাফির’ মনে করে এবং তাদের হত্যা করাকে বৈধ মনে করে।
৪.
উড়ে এসে জুড়ে বসা এই সৌদ বংশের পারিবারিক সভ্যরাই বিশ্বমুসলিম সম্প্রদায়ের কাছ থেকে হজের নামে ফি-বছর বিলিয়ন ডলার আয় করে। কিন্তু হাজীদের নিরাপত্তার দিকটিতে তাদের কোনো মনোযোগ থাকে না। বিশ্ব অসহায় মুসলমানদের জন্য তাদের কিছু করণীয়ও থাকে না। চরম অগণতান্ত্রিক সৌদের রাজবংশরা আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র কেনায় বিশ্বে প্রথম হয়ে, সেই অস্ত্র আবার মুসলমানদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করে। কিন্তু তাদের পরম বন্ধু ইসরাইল যখন নিরীহ ফিলিস্তিনের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায়, সে সময় এরা চোখ ও জবান বন্ধ করে রাখে। এটাই সাবেক হিজাজ দেশের বর্তমান শাসকদের আসল চালচিত্র।
৫.
পবিত্র নগরীর প্রাচীন ঐতিহ্য; আর মুসলিম বিশ্বে অসন্তোষ জিইয়ে রেখে সাম্রাজ্যবাদীদের তোষণেই যাঁরা নিজেদের ব্যাপৃত রাখেন; হাজিদের মর্যাদার চেয়ে যুবরাজের ভ্রমণবিলাস যাঁদের কাছে বড় হয়ে ওঠে; মানুষের মৃত্যু নিয়েও যাঁরা মিথ্যাচারে লিপ্ত হন; সেই তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় এসেছে। এই মানসিকতা যাঁরা ধারণ করেন, তাঁদের কাছে পবিত্র নগরী নিরাপদ থাকতে পারে না। তাই হজের দায়িত্ব নিতে হবে বিশ্বমুসলিমের। ইসলাম সৌদ বংশের একার সম্পত্তি নয়। তাই এই পবিত্র ভূমি দর্শনে কোনো অর্থের ফিকির চলবে না। এখন যুবরাজের খামখেয়ালিপনায় অসহায় হাজিদের প্রাণ গেল, তাদের পরিবারকে পথে বসিয়ে দিল; এর বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্ব কী কথা বলবে? হজ ট্র্যাজেডিতে ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রাণহত্যার দায় যে যুবরাজের ওপর; এই দায় কে নেবে?। এই হজ ট্র্যাজেডিতে ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রাণহত্যা আর সৌদি সরকারের খামখেয়ালিপনা, যুবরাজের ভ্রমণ বিলাসের স্বীকার আগামী দিনগুলিতে যেন না হয় তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
লেখক : সাংবাদিক