নোবেল প্রাইজ, প্রবল সারপ্রাইজ

পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফলতা, অনন্যসাধারণ গবেষণা, উদ্ভাবন এবং মানবকল্যাণমূলক তুলনারহিত কর্মকাণ্ডের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ১৮৯৫ সালে করে যাওয়া একটি উইলের মর্মানুসারে ১৯০১ সাল থেকে এই নোবেল পুরস্কার প্রচলন করা হয়। বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, অর্থনীতি, সাহিত্য ও শান্তি—এই ছয়টি বিষয়ে এ পুরস্কার দেওয়ার রীতি রয়েছে। নোবেল পুরস্কারকে এসব ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিবছর অক্টোবর-নভেম্বরে শুধু শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় অসলো, নরওয়ে থেকে। বাকি ক্ষেত্রে স্টকহোম, সুইডেনে এ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। মানবকল্যাণে তুলনারহিত কর্মকাণ্ডের জন্য এই পুরস্কারবলে প্রতিবছরই বিশ্বের সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে অসলো ও স্টকহোমে।
এই পুরস্কার যিনি পান, তিনি যেমন সারপ্রাইজড হন, তেমনি না পেয়েও নিজেদের বিস্ময়বোধ আটকাতে পারেন না অনেক প্রথিতযশা। এ কারণেই কোনো জাতিকে পরাভূত বা হেনস্তা করার ফন্দিফিকির হিসেবে নোবেল পুরস্কার নিয়ে গোপনে বা প্রকাশ্যে বিশ্ব মোড়লদের মাঝেও চলে নানামুখী গুটিবাজি খেলা। নোবেল কমিটির কর্তাব্যক্তিরা মনুষ্যপ্রাণী বলেই বিশ্ব মাতবরদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের খেলোও করে বসেন হরহামেশা। হেনরি কিসিঞ্জার, দালাই লামা, জিমি কার্টার, শিমন পেরেজ ও সর্বশেষ বারাক ওবামাকে নোবেল শান্তি প্রাইজ দিয়ে নোবেল কমিটি যেমন নিন্দার মুখে পতিত হয়, তেমনি আবার আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা বা অমর্ত্য সেনদের মতো ব্যক্তিত্বকে পুরস্কারে ভূষিত করে ব্যাপক প্রশংসাও কুড়ায়। বলা যায়, বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ মূল্যবান বা সম্মানজনক এই পদকপ্রাপ্তি নিয়ে দুর্মর দোলাচল চলে সারা বছর ধরেই। যাঁরা পান, তাঁরা নিজেরা অপার বিস্ময়ে মুগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি অপরের ঈর্ষার পাত্রও হয়ে ওঠেন। সে সঙ্গে নোবেল নিয়ে সমান্তরালে চলে রাজনীতি, কৌতুক, আলোচনা বা সমালোচনা।
প্রমথনাথ বিশির রচনা থেকে জানা যায়, আমাদের জাতীয় সংগীত রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্য নোবেল বিজয়ী হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর ১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বর কলকাতা থেকে একটি টেলিগ্রাম পান, Noble Prize confirmed for you, our hearty congratulation. হেমন্তের সন্ধ্যায় আলো-আঁধারিতে তিনি পড়লেন সেই বার্তা। কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে, এই ভেবে তারবার্তাটি প্রথমে বিশ্বাস করেননি। শেষে ভ্রম ভাঙা বিশ্বাস নিয়ে অত্যন্ত নিরাসক্তভাবে বার্তাটি অধ্যাপক নেপাল বাবুর হাতে তুলে দিয়ে নোবেল লরিয়েট রবিঠাকুর বললেন, ‘নিন, আপনার ড্রেন করার টাকা।’ শোনা যায়, সে সময় শান্তিনিকেতনে পাকা নর্দমা বানানোর খরচ নিয়ে টানাটানি চলছিল। বোঝাই যায়, প্রকৃত প্রাজ্ঞজনের কাছে বিশাল বড় পুরস্কারও নর্দমাসমান তুচ্ছাতিতুচ্ছ হতে পারে। অন্যদিকে কখনো কখনো ভুল মানুষকে শান্তি পুরস্কার প্রদান করে গভীর অনুশোচনায় নিজেদের ভোগান্তি বাড়ান নোবেল কমিটির লোকেরাই। সম্প্রতি জানা গেল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া ভুল ছিল বলে মনে করেন নোবেল কমিটির সদ্য সাবেক এক কর্মকর্তা। ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এ শান্তি পুরস্কার দেওয়ার অনুশোচনা করেছেন তিনি। গায়ের লানডেস্টেড নামের ওই সাবেক কর্মকর্তা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, কমিটি ভেবেছিল, এ পুরস্কার ওবামাকে আরো উজ্জীবিত করবে।
সে সময় এ পুরস্কার পাওয়া নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই অনেক সমালোচনা হয়েছিল। ওবামা নিজেও বলেছিলেন, তিনি এ পুরস্কারপ্রাপ্তিতে অবাক হয়েছেন। লানডেস্টেড আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তাঁর সমর্থকরাও ভেবেছিল, এটা হয়তো কোনো ভুল হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের সাধারণত নরওয়ের রাজধানী অসলোতে গিয়ে পুরস্কার নেওয়ার রেওয়াজ নেই। কিন্তু হোয়াইট হাউস খুব দ্রুত বুঝতে পারল তাদের অসলো যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেছেন, বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ওবামা অবদান রাখবেন, এই আশা পূরণে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। লানডেস্টেড শান্তি কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, সারা বিশ্বে ভজঘট পাকিয়ে রাখার বিশেষজ্ঞ হিসেবে, মধ্যপ্রাচ্যের আজন্মের অশান্তি জিইয়ে রাখার কারিগর হিসেবে, সৌদি আরব বা ইসরায়েলের বন্ধুত্বের সাহচর্য নিয়ে মুসলমানদের দাসানুদাস বানিয়ে তাদের গায়েই সন্ত্রাসী তকমা স্থায়ীভাবে সাঁটিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব হিসেবে, বিশ্বব্যাপী অস্ত্রবাজি বা মোড়লগিরির প্রধান অনুঘটক হওয়ার দাবিদার হিসেবে যদি কারো অশান্তি পুরস্কার জোটে, তা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সর্বাগ্রে পাওয়ার কথা।
সেই তিনি কি না পেয়ে বসলেন শান্তি পুরস্কার। তবে নোবেল কমিটি শেষাবধি তাদের ভুল অনুধাবন করতে পেরেছে, এটাই বড় কথা। আর তাদের এই অনুশোচনাকে বলা যায় বিশ্বের সেরা নোবেলোনুশোচনা! ব্যালিস্টিক অস্ত্র তৈরির কারখানার মালিক রসায়নবিদ আলফ্রেড নোবেলের প্রস্তুতকৃত অস্ত্রে নিজের ভাই লুডভিগসহ বিপুলসংখ্যক প্রাণহানি দেখে অনুশোচনায় ভুগে নিজের সব সম্পত্তি উইল করে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করেন। অন্যদিকে পদার্থবিজ্ঞানে অবদান রাখা নোবেল পাওয়া বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ভরের সমীকরণ সূত্র মেনে বানানো জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত আমেরিকান পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ দেখে মারাত্মক অনুশোচনায় কুপিত হয়েছিলেন তিনি। জাপানে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহ বিধ্বংসী রূপ দেখে বিচলিত হয়েই আইনস্টাইন লিখেছিলেন, পারমাণবিক শক্তি মানবজীবনে খুব তাড়াতাড়ি আশীর্বাদ হয়ে দেখা যাবে, সে রকম মনে হয় না। তবে এই শক্তি মানবজাতির জন্য ভীতি-জাগানিয়া হলেও পরোক্ষে তা হয়তো ভালোই করবে। ভয় পেয়ে মানবজাতি তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলা চালু করবে। ভয় ছাড়া মানুষ বোধ হয় কখনোই শান্তির পথে অগ্রসর হতে পারবে না।
একজন অনুশোচনাপ্রবণ নোবেল বিজয়ীর এমন সত্য কথন অন্তত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তানের ক্ষেত্রে প্রতিভাত হতে দেখছি। এটাও এক ধরনের নোবেলীয় সারপ্রাইজ বটে! আলফ্রেড নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে তাঁর বিখ্যাত উইলে লিখেছিলেন, এমন কাউকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হোক, যে কি না বিশ্বের জাতিগুলোর মধ্যে ‘ভ্রাতৃত্ববোধ’ বাড়াতে, ‘বর্তমান’ সেনাবাহিনী রদ করতে বা সৈন্যসংখ্যা কমাতে এবং শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে আলোচনা এগিয়ে নিতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে শান্তির বাতাস বইয়ে দেওয়া সবাই যে নোবেল পেয়েছেন এমন নয়, আবার ব্যাপক অশান্তির কুশীলব হয়ে বিশ্ব মানবতার মুখে চুনকালি মাখানো অনেকেই শান্তি নোবেল বাগিয়েছেন।
যেমন ভারতের জাতির জনক অহিংসবাদী মহাত্মা গান্ধী মোট পাঁচবার মনোনয়ন পেয়েও নোবেলওয়ালা সুইডিশদের সঙ্গে গ্রেট ব্রিটেনের সম্পর্ক বিনষ্টের কারণ ঘটার আশঙ্কায় শেষমেশ গান্ধীজির ভাগ্যে নোবেল-ভাগ্যের শিকে ছিঁড়েনি। অন্যদিকে চরম বাংলাদেশ-বিদ্বেষী যে আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ভিয়েতনামে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে হাজারো মানুষের প্রাণ হরণ করেন, সেই তিনি কি না ভিয়েতনামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নোবেল পিস প্রাইজ পেয়েছিলেন। নোবেল চক্রকে যথার্থ তোয়াজ না করতে পারা অথবা ওই চক্রের স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়ার সক্ষমতা অর্জন না করায় পুরো শতাব্দী ধরেই বহু ডাকসাইটে বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক বা শান্তিকর্মীকে নোবেল বঞ্চিত রাখা হয়েছে। আবার অন্যদিকে তিব্বতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ধর্মগুরু দালাইলামাকে নোবেল প্রাইজে ভূষিত করা হয়েছে স্রেফ উদীয়মান পরাশক্তি চীনকে চাপে রাখতে!
নোবেল পুরস্কারের এমন দৈন্যদশা, ক্রীড়নকতা বা অদূরদর্শিতা দেখে আলফ্রেড বেঁচে থাকলে কাঁদতেন নাকি হাসতেন, তা হয়তো ঠাওর করে উঠতে পারতেন না। এদিকে, আমাদের দেশের নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে সবেধন নীলমণি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদকপ্রাপ্তির পেছনে বিপুল বিস্তারি রাজনীতির ঘ্রাণ খুঁজেছেন বিরুদ্ধবাদীরা। ভিন্নমতাবলম্বীদের দাবি, নোবেল পুরস্কারের নিজস্ব রাজনীতি, অর্থনীতি বা মতাদর্শের পরীক্ষায় নানা প্রায়োগিক কৌশলগত কারণে উতরে গিয়েই ইউনূস এ পুরস্কার বাগিয়েছিলেন। এদের দাবি, বিশ্বের যেসব দামি পুরস্কারে তিনি ভূষিত, তাঁর প্রায় সব ক্ষেত্রেই নিজের দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁর বিশেষ শ্রেণির বন্ধুদের আনুকূল্যেই সেগুলো অর্জন করেছেন। দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে তাঁর অতি সরবতা বা গভীর মৌনতাই পুরস্কারের আসল রাজনীতি মনে করিয়ে দেয়। তিনি কখনো ইসরায়েলি আগ্রাসন, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মীয় উগ্রবাদিতা বা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এমনটা শোনা যায় না। তাই এই শান্তি নোবেল লরিয়েট আসলে মানবতার কোনো আঙিনায় শান্তির নহর বইয়ে দিয়েছেন, তা প্রশ্নসাপেক্ষই থেকে যায়। তবু নরওয়ের টেলিনর মোবাইল কোম্পানির ঘনিষ্ঠ মিত্র একজন নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশি মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গেই আমরা থাকব হয়তো। রাজনীতি, স্বার্থচিন্তা, বিশ্বব্যাপী ছড়ি ঘোরানো, পুঁজিবাদিতার মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে যুগে যুগে নোবেল প্রাইজের ব্যাপকবিস্তারী সম্পৃক্ততার কারণেই চির দুই বৈরী দেশ পাকিস্তান ও ভারতের নারী শিক্ষাকর্মী মালালা ইউসুফজায়ী বা শিশু অধিকারকর্মী কৈলাশ সত্যার্থীর নোবেল বিজয় নিয়েও প্রশ্ন ওঠে নানা মহলে।
আসলে নোবেল পুরস্কার ও স্বার্থবাদিতা বরাবরই হয়তো সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছে। কিন্তু আলফ্রেড নিশ্চয়ই নিজের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে বিখ্যাত উইলের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই মানবকল্যাণ বা বিশ্বশান্তির স্বপ্নই দেখেছিলেন। কিন্তু আমাদের চিন্তা, বোধ ও মনন দিয়ে নোবেলের সেই স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে পারছি কি? তবু এ বছর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, অর্থনীতি, সাহিত্য ও শান্তিতে যাঁরা নোবেল পেয়ে যারপরনাই সারপ্রাইজড হলেন, তাঁদের জন্য প্রাণান্ত অভিবাদন। আর যাঁরা না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে নোবেল কমিটির রাজনীতিকে শাপশাপান্ত করলেন, তাঁদেরও অভিনন্দন। তবু এগিয়ে চলুক মঙ্গলময় বিশ্ব সকলের যূথবদ্ধতায়।
লেখক : গাজীপুর প্রতিনিধি, মাছরাঙা টেলিভিশন।