ভারত-পাকিস্তান
যুদ্ধে সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ‘সত্য’
১৯১৮ সালে মার্কিন সিনেটর হিরাম ওয়ারেন জনসন বলেছিলেন, ‘যুদ্ধের সময় সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সত্য’। ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ আইন প্রণেতা আর্থার পনসনবিও একই কথা বলেন। ১৯১৪ সালে শুরু হয়ে ১৯১৮ সালে শেষ হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ ও তথ্য বিষয়ে করা সে ঐতিহাসিক উক্তির প্রাসঙ্গিকতা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানের চলমান সামরিক হামলা-পাল্টা হামলার প্রেক্ষাপটে। এই ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানের নানা সংবাদমাধ্যম তো বটেই, বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোর বেশ কয়েকটি বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
পাকিস্তানের মানুষ ও মিডিয়ার সাথে বাংলাদেশের মানুষের যোগাযোগ কম। এই পাকিস্তানকেই মুক্তিযুদ্ধে পরাভূত করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশের মানুষ। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে পাকিস্তানের মানুষ কিংবা মিডিয়ার সাথে বাংলাদেশের বাঙালি ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের যোগাযোগ ও সম্পর্ক নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহাসিক অম্ল-মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী, মুজিববাহিনীসহ সব মুক্তিকামী বাঙালির সাথে সরাসরি যোগ দেয় ভারতীয় সেনা ও বিমানবাহিনী। তা ছাড়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হামলা থেকে বাঁচতে ত্রিপুরা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয় কোটি খানেক বাংলাদেশি। ফলে ৭১ ইস্যুতে ভারতের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ইতিবাচক অনুভূতি রয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার মত রাজ্যগুলোর সাথে বাংলাদেশের মানুষের আত্মার সম্পর্ক বিরাজমান। বিপরীতে, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি হত্যা, নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদানে গড়িমসি, বাংলাদেশি চ্যানেল ভারতে দেখতে না দেওয়া ও বিশাল বাণিজ্য ঘাটতিসহ নানাবিধ কারণে ভারতের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অসন্তুষ্টিও রয়েছে।
সাংস্কৃতিক নৈকট্যজনিত কারণে ভারতের বাঙালিদের সাথে বাংলাদেশের বাঙালিদের প্রচুর যোগাযোগ হয়। ভারত ও পাকিস্তানের চলমান সামরিক দ্বৈরথের প্রভাব ভারত ও বাংলাদেশের বাঙালি সমাজের মধ্যেও পড়েছে। তীব্র আপত্তিজনক ভাষা ব্যবহার করে এক শ্রেণির ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাঙালি একে অপরকে আক্রমণ করে চলেছেন। বলাবাহুল্য যে, সংবাদমাধ্যমগুলোর অনলাইন ভার্সনেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে প্রতিবেশী দুই দেশের মানুষের একাংশের মধ্যে কথার যুদ্ধ চলছে।
দুই দেশের সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধুত্বের বার্তা দিলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্ক কতখানি বন্ধুত্বপূর্ণ সেটি খতিয়ে দেখার দরকার। সংবাদমাধ্যম ভারত ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি ও বজায় রাখার ক্ষেত্রে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে সঠিক ভূমিকা রাখতে হলে সংবাদমাধ্যমগুলোর বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে হবে।
কিন্তু আমরা দেখছি ভারত-পাকিস্তান ‘যুদ্ধ’ ইস্যুতে সংবাদ মাধ্যমগুলো মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারছে না। অন্যভাবে বলা যায়, সংবাদমাধ্যমগুলোর একটা অংশ মানুষের মাঝে নানা বিভ্রান্তিকর ‘তথ্য’ ছড়াচ্ছে। ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় ভারতের বহু সৈন্যের হতাহতের ঘটনায় পুরো ভারতে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। সৈন্য হত্যার ঘটনায় ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে। পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও ভারতের সরকার জনগণকে এটা বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় যে, পাকিস্তানই এই হামলা করিয়েছে। ফলে পাল্টা কিছু করা ভারতের সরকারের জন্য অনিবার্য হয়ে উঠে।
চরমপন্থী বিজেপি, শিবসেনা তো বটেই, সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যেও পাকিস্তানকে ‘শায়েস্তা’ করার দাবি উঠে। হয়ত এমনই একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি আশা করছিল বিজেপি। অবশেষে ভারতীয় বিমান বাহিনীর কয়েকটি যুদ্ধ বিমান পাকিস্তানের বালাকোটে হামলা চালায়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে, সে হামলায় জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদের ৩০০ সদস্যকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনী । অন্যদিকে, পাকিস্তান দাবি করে, ভারতের বিমান সীমান্ত অতিক্রম করেছিল ঠিকই, পাকিস্তানের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। পশ্চিমা সংবাদসংস্থা রয়টার্স এবং এর সূত্র ধরে আরো কয়েকটি পশ্চিমা মাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, ভারতীয় বিমান হামলায় পাকিস্তানের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পাকিস্তানের ডন পত্রিকাও জানায় যে, এই হামলায় পাকিস্তানের একজন নাগরিক আহত হয়েছে।
ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম খুব ফলাও করে বিমান হামলায় ৩০০ জঙ্গি নিহতের কথা জানায়। ভারত জুড়ে নরেন্দ্র মোদী সাহেবের প্রশংসা শুরু হয়। যদিও ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনী কিংবা ভারতের কোনো সংবাদমাধ্যম বালাকোটে হামলার কোনো ছবি বা ভিডিও প্রদর্শন করতে পারেনি। সব মিলিয়ে বালাকোট হামলায় ভারত কতটুকু সফল হতে পেরেছিল, সেটি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দাবি জানিয়ে বলেছেন, বালাকোটে কত জনের মৃত্যু হয়েছে সেটা জানাক সরকার, জওয়ানদের রক্ত নিয়ে রাজনীতি মেনে নেওয়া হবে না। ২৮ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকা প্রকাশ করে, “পুলওয়ামা-কাণ্ড এবং পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে ফের মোদি সরকারের বিরুদ্ধে আঙুল তুললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় বিমানহানায় ঠিক ক’জনের মৃত্যু হয়েছে? বোমাটা কি ঠিক জায়গায় পড়েছে? দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরে বৃহস্পতিবার এই প্রশ্ন তুলেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। নির্বাচনের আগে পরিকল্পিত আস্ফালন চলছে— ইঙ্গিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।”
খুব কড়া ভাষায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন বলেছেন, ‘‘আমরা জানতে চাইতেই পারি, বিমানহানায় কতজন মারা গেছে? কারা মারা গেছে? কিছুই তো আমরা জানতে পারিনি।’’ ভারতের বিমান হামলায় পাকিস্তানে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন। ৩০০ জন, ৩৫০ জন, ৪০০ জন— সংবাদমাধ্যমে এমন নানা সংখ্যা ঘোরাফেরা করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে ‘একতরফা’ তথ্য ‘খাওয়ানো’ হয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
আনন্দবাজার আরো লিখেছে, ‘কয়েকটি বিদেশি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা শুনেছি বোমাটা ঠিক জায়গায় পড়েনি, বোমাটা মিস হয়েছে এবং মানুষ মারা যায়নি। কেউ কেউ বলছেন, একজন মারা গেছে।’
ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এমন একটি স্পর্শকাতর ইস্যুতে প্রকাশ্যে ‘৩০০ জঙ্গি’ হত্যার বিষয়ে নিজের সব সন্দেহ প্রকাশ করে মোদি সরকারের দাবিকে রীতিমত চ্যালেঞ্জ করছেন। সেখানে আমরা কী দেখলাম? বাংলাদেশের কিছু সংবাদমাধ্যম কোনো ধরনের প্রশ্নবোধক চিহ্ন না রেখেই বড় বড় শিরোনামে ৩০০ জঙ্গি হত্যার খবর প্রচার করল!
শুধু মমতা ব্যানার্জি নন, বালাকোট নিয়ে খোদ ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীও নিশ্চিত নয়। সেটি গেল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার হওয়া গেল। আনন্দবাজার লিখেছে, এক প্রশ্নের উত্তরে বায়ুসেনার প্রতিনিধি বলেন, তাঁদের কাছে জঙ্গিশিবির ধ্বংসের যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তাঁর মন্তব্য, ‘আমরা যে ভাবে যতটুকু ধ্বংস করতে চেয়েছি, তাতে আমরা সফল। তবে কত জন মারা গেছে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে শিবির ধ্বংসের তথ্যপ্রমাণ কোথায় কীভাবে পেশ করা হবে, তা ঠিক করবে দেশের নেতৃত্বই।’
এই যে অনিশ্চিত খবর নিজ দায়িত্বে সংবাদমাধ্যমগুলো প্রচার করল, তাতে লাভ হলো কার? যুদ্ধ হচ্ছে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে, ফাঁকে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাল বাংলাদেশের মিডিয়া! প্রতিবেশী দেশের এত বড় বিপদে বাংলাদেশের মিডিয়ার উচিত ছিল শতভাগ বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রেখে সাংবাদিকতা করা। টেলিভিশনের যুগ পেরিয়ে বহুদিন হল পৃথিবী ইন্টারনেটের যুগ পার করছে। মানুষকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে লাভ নেই। মানুষের ঘরে ঘরে টেলিভিশন। মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট থাকলেই হলো; বিশ্বের যেকোনো পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে প্রবেশ করা যাচ্ছে, এমনকি টেলিভিশনে লাইভ দেখা যাচ্ছে।
এমন একটা সহজ যোগাযোগের সময়ে কোনো সংবাদমাধ্যম যদি যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করে তাহলে ধরা পড়বেই। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, ভারত-পাকিস্তান বিষয়ে নির্ভরযোগ্য সংবাদ-উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে পশ্চিমা কিছু সংবাদমাধ্যম। অথচ রয়টার্স, বিবিসির মতো পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধেও তথ্য বিকৃতির বিস্তর অভিযোগ আছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসন বিষয়ে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা সংবাদমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতাকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। এই সংবাদমাধ্যমগুলোই এখন ভারত-পাকিস্তান ইস্যুতে আমাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সংবাদউৎস!
মমতা বললেন, নরেন্দ্র মোদির সরকার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে ‘তথ্য খাইয়েছে’। একজন পেশাদার, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকের জন্য মমতার এই অভিযোগ যে কতখানি লজ্জাজনক সেটি বলাই বাহুল্য। মিথ্যা তথ্য দিয়ে, বিভ্রান্তিকর ‘সংবাদ’ ছড়িয়ে আজকের দিনে পার পাওয়া যায় না। মিথ্যা দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি নয়, বরং সত্য সংবাদ পরিবেশন করেই শান্তির পৃথিবী গঠনে মিডিয়া কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।