সন্ত্রাসী হামলা
শান্তির বসতি কি হারিয়ে যাবে?
এখনো বিশ্বজুড়ে শান্তিবাদী ও উদারনৈতিক মানুষদেরই ভিড় বেশি। কিন্তু তাদের কোণঠাসা করে রাখবার বন্দোবস্তও পাকাপাকি করে রাখা আছে। দেশে দেশে শাসককূলেরা বৈশ্বিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ধর্মান্ধতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদের চাষবাস ধরে রাখে। সেই অশুভ চাষাবাদের ফসল লুটকারী নিশ্চিতই পুঁজিবাদী ধনতান্ত্রিক ক্ষমতালিপ্সুরা। আর আবাদের অন্ধকার ভূমিজুড়ে দানবীয় আগাছার উৎপাত বেড়ে গেলে মাঝে মাঝেই প্রাণ দিতে হয় নির্দোষ-নির্বিরোধ ও অসহায় মানুষদের। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ ট্র্যাজেডির সর্বশেষ নমুনা।
ইরাক-আফগানিস্তান-সিরিয়া-ইয়েমেন-লেবানন-সোমালিয়া-আরাকানে মানবতাবিরোধী হিংস্রতার ভাইরাসের উৎপাদক শ্রেণি কারা, তাদের চেহারা দেখতে কেমন তা সবার জানা। কিন্তু সেসব স্বঘোষিত ঈশ্বরের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে সাধারণের মুখ খুলতে মানা। পৃথিবীর তাবৎ ধর্মানুসারী সেসব সাধারণ মানুষ মিস্টিক কবি লালন ফকিরের ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ ভাবধারায় পুরোপুরি আস্থাবান না হলেও জঙ্গিবাদ চর্চার মাধ্যমে ভিন্নমতের মানুষকে নিপাত করতে হবে এমন দর্শনে বিশ্বাসী নয়। কিন্তু আফগানিস্তানের লাদেন, সিরিয়ার বোগদাদি, ভারতের শিবসেনা গোষ্ঠী কিংবা অস্ট্রেলিয়ান ব্রেন্টন টারানদের হিংস্রতার বলি হন ঘুরেফিরে ওই সাধারণ মানুষই। কারণ এর পেছনে কলকাঠি নাড়েন কিছু অস্বাভাবিক মানুষ। যারা অন্যের জ্ঞান বা সম্পদ দখল করবার মনোবৃত্তি নিয়েও শুধুমাত্র নিজেরা সুখী থাকার ছক কষে চলে। ক্ষমতালিপ্সা ও কর্তৃত্ববাদী তেমন রাজনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে প্রান্তিক মানুষের এখন চরম নাভিশ্বাস, হৃদয় ক্ষতবিক্ষত।
সন্ত্রাসবাদীর ধর্মীয় পরিচয় ছাপিয়ে তার উগ্র জাতীয়বাদ বা সাম্প্রদায়িক ধ্যানধারণা বড় হয়ে ওঠে যখন আমরা প্রত্যক্ষ করি এসবের পেছনে আছে ভোগবাদী রাজনীতি। উগ্রবাদ নিন্দা ও ঘৃণার বর্বরোচিত উপাখ্যান ছাড়া কোনো ধর্মেরই সুরক্ষা দেয় না। মুসলিম, খ্রিস্টীয় বা হিন্দুয়ানি জঙ্গিবাদ নিজেই আলাদা একটা ধর্মে রূপ পরিগ্রহ করেছে। সাধারণের ধর্মীয় চেতনার সাথে যার কোনো মিল নেই। মানুষের প্রাণহরণ করে ধর্মমত জারি রাখতে হবে আধুনিক উদারনৈতিক ধর্মবেত্তারা এমন ধারণা পোষণ করেন না। কিন্তু আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বা তাঁর সতীর্থ ডানপন্থীরা নিজেরা ধর্মীয় অনুশাসন না মানা শাসক হয়েও শুধু খ্রিস্টান বা শ্বেতাঙ্গদের জন্য আমেরিকার ভূমি সুরক্ষিত রাখতে চান। এদের মতো একালের শাসকরা নিজে ধার্মিক না হয়েও জনগণকে ধর্মের ‘কেপ্টাগন’ খাওয়ান। মানবিক না হয়েও মানবতার গল্প শোনান। এমন একজন ট্রাম্পের অনুসারী বলে ঘোষণা দিয়ে মানুষ হত্যায় নাম লিখিয়েছেন সন্ত্রাসী ব্রেন্টন।
অথচ পৃথিবীর ইতিহাস রাবীন্দ্রিক ভাবধারাই বরাবর মেনে চলেছে। ‘নেবে আর দেবে, মিলিবে মেলাবে’ –এই চেতনাতেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বন্ধন রচিত হয়েছে। গড়ে ওঠেছে সভ্যতার ইতিহাস তথা আধুনিক কালের গ্লোবাল ভিলেজ। আল নূর মসজিদে হামলাকারী সন্ত্রাসীর পূর্বপুরুষ স্কটিশ-আইরিশ। অস্ট্রেলিয়ায় তারাও একজন অভিবাসী। হোয়াইট সুপ্রেমেসিস্ট এই ব্রেন্টন মনে করেন, ‘পৃথিবীতে শ্বেতাঙ্গরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। তাদের কেউ ডোমিনেট করতে পারে না। অন্যরা বরং তাদের নমস্য মনে করবে। হামলার মাসখানেক আগেই এই খুনি ‘Great Replacement : Towards a new society’ শিরোনামে ৭৪ পৃষ্ঠার মেনিফেস্টো প্রকাশ করেছিলেন। মেনিফেস্টোতে জানিয়েছিলেন, তিনি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছেন আর তার বাবা-মা স্কটিশ-আইরিশ ইংরেজ অভিবাসী। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় মুসলিম অভিবাসী তিনি মেনে নিতে পারেন না। তিনি জেনে বুঝেই এই হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তার সঙ্গে আরো অনেকেই আছেন। তিনি কোনো ফেইম সিকার নন, কিংবা কারো এটেনশনও চান না। তবে শেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীদের জন্য তিনি নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে যেতে চান।
নিঃসন্দেহে এই ব্যক্তিটি তার চিন্তা ও ভাবনার বিকৃতির জন্য একজন নিকৃষ্ট উগ্রবাদী সন্ত্রাসী। কিন্তু তিনি যেহেতু মুসলিম বিরোধী, সেহেতু তার বেলায় পশ্চিমা মিডিয়া একজন ‘শ্যুটার’ শব্দ ব্যবহারের মধ্যেই দায়িত্ব সাড়বার প্রয়াস পেয়েছে। কারণ এসব মিডিয়াকে নিজেদের জানপ্রাণ বাঁচিয়ে রাখতে তার কর্তৃত্ববাদী ঈশ্বরের দাওয়াই মেনে চলতে হয়। এসব মিডিয়া যদি নিরপেক্ষতার ভানও করত তবু লিখতে হতো সন্ত্রাসীবাদী হামলায় অর্ধশত মানুষ মারা গেলেন। বৈষম্যের এই যুগে তা হয়তো সম্ভব নয়।
ঘটনার পর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘এই গুলিবর্ষণের ঘটনায় যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নিউজিল্যান্ডে অভিবাসী, এমনকি তাঁদের মধ্যে শরণার্থীরাও আছেন। তাঁরা নিউজিল্যান্ডকে তাঁদের স্বদেশ করে নিয়েছেন এবং এটা তাঁদের দেশ। তাঁরা আমাদের। কিন্তু যে ব্যক্তি (অথবা ব্যক্তিরা) সহিংসতা চালিয়েছে, তারা আমাদের কেউ নয়।’ ব্রেন্টনকে সন্ত্রাসী বা বর্ণবাদী কিছুই বলেননি প্রধানমন্ত্রী। অপরদিকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রতিক্রিয়া দিতে একদিন সময় নিয়েছেন। প্রতিক্রিয়ায় নিউজিল্যান্ডের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়ে ঈশ্বরের কাছে সবার মঙ্গল চেয়েছেন। কিন্তু যে অধিশ্বর মানুষকে সন্ত্রাসবাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী জঙ্গি বানায়, সেই ঈশ্বরদের ব্যাপারে তাঁর কোনো উচ্চারণ নেই।
তবু আমরা বিশ্বাস করতে চাই, ব্রেন্টনের কল্পরাজ্য হয়তো অধরাই থেকে যাবে। তাই যদি না হতো, ইউরোপের প্রভাবশালী রাষ্ট্রপ্রধান জার্মানীর চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল ১০ লাখ সিরীয় মুসলিম শরণার্থীকে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি সত্ত্বেও নিজের দেশে জায়গা দিতেন না। বর্তমান সময়ে ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় বিপুল অভিবাসী মুসলিম মর্যাদার সাথে স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারতেন না। আমেরিকায় আফ্রিকান বংশোদ্ভূতরা সম্মান নিয়ে বাঁচা কিংবা রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হতে পারতেন না। এমনকি মুসলমানদের সূতিকাগার সৌদিআরব কিংবা মধ্যপ্রাচ্য বৈশ্বিক মুসলমানদের জন্য যতটা না নিরাপদ ইউরোপের কোনো কোনো দেশ মুসলিমদের জন্য বেশি স্বস্তিকর।
তবে যারা উগ্রবাদের নিয়ন্তা তাদেরই এর রাশ টেনে ধরতে হবে। বহুমতাদর্শের পৃথিবী গড়ার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। সব ভালো একদিকে জড়ো করবার পরিণতি ভয়াবহই হবে। একদিন নিষ্পেষিত নিগৃহীত সুবিধাবঞ্চিতরা রুখে দাঁড়ালে ক্ষমতার মসনদ টলতে কতক্ষণ?
সন্ত্রাসীর ধর্ম পরিচয়কে ব্র্যান্ডিং না করে ধনতান্ত্রিক শাসকদের উচিৎ সন্ত্রাসবাদের নামে বিশ্বব্যাপী অস্ত্রের পসরা বন্ধ করা। অস্থিতিশীলতায় সুবিধাবাদের বাণিজ্যের অনৈতিক চর্চা বাদ দেওয়া। মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও আফ্রিকার সোনা দখলের রাজনীতি পরিত্যাগ করা। অপরদিকে মুসলমানদেরও উচিত ধর্মরক্ষার নামে ঢালাওভাবে বক্তৃতাবাজিতে ইহুদি-খ্রিস্টানের বিরুদ্ধে বিষোদগারের তরিকা থেকে ঔদার্য চর্চায় ফিরে আসা। তা না হলে লাদেনের উগ্রবাদী অনুসারী যেমন বেড়ে চলবে, পাল্লা দিয়ে ব্রেন্টনরাও দল ভারী করবে। যা কারো জন্যই শুভকর হবে না। ঘৃণা ও হিংসা নয়, ভালোবাসা ও পরমতসহিষ্ণুতাই পৃথিবীতে সুস্থির শান্তি ফেরাতে পারে।
প্রার্থনারত অসহায় অর্ধশত প্রাণ ঝড়ে গেলেও এ যাত্রা আমাদের ক্রিকেটাররা ভাগ্যগুণে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারলেন ঠিকই, কে বলতে পারে শান্ত দেশ নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের সামনে বিশ্বের কোনো এক পরগণায় এমন ভয়াল নরক তার লেলিহান শিখা নিয়ে আবির্ভূত হবে না? সময় এখনো আছে। হিংসার ঘোলাপানিতে মাছশিকারি লোভীদের জিহ্বা সামলে নিয়ে চোয়ালে কঠোর লাগাম পরানোর। শান্তি ও সম্প্রীতির আরাধনা করবার সময় আর বাকি নেই। যেভাবে গৃহে গৃহে বিবাদ বিসংবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে তাতে সাম্রাজ্যবাদীদের দেবালয় কি রক্ষা পাবে?
আমরা পৃথিবীর তাবৎ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। ধনিক শ্রেণির পাতা ফাঁদে পা না দিয়ে মুসলিম নামধারীদের ঘৃণ্য জঙ্গিবাদের বিরোধিতা করতে হবে মুসলমানদেরই সবার আগে। সুন্দর পৃথিবীতে কুৎসিত হিংস্রতার উল্লম্ফন চলতে পারে না। আমাদের ভুলে হারিয়ে না যাক যুথবদ্ধ মানুষের শান্তির বসতি! অভেদ মানুষের পূজারি মরমি কবি লালন ফকির সত্য থাকুক :
ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার।
নদী কিংবা বিল বাওড় খাল
সর্বস্থলে একই এক জল।
একা মেরে সাঁই ফেরে সর্ব ঠাঁই
মানুষে মিশিয়ে হয় বেদান্তর।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন