সড়কে নৈরাজ্য
আনিসুল হকের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হোক
যা অনুমান করেছিলাম তা-ই সত্যি হলো। ছেলেমেয়েরা আবার রাস্তায় নেমে এসেছে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় দিনে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় রাস্তায় নেমে এসেছে। যথারীতি একদল ছেলেমেয়ে গাড়ি চেক করছে, গাড়ির গায়ে নানা কথা লিখে দিচ্ছে।
স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের একটা অংশ খুব ভালো চেতনা নিয়ে রাস্তায় এসেছে। এরা সমাজ বদলে দিতে চায়, এরা গণপরিবহন নৈরাজ্য বন্ধ করতে চায়। যদিও নৈরাজ্য বন্ধের দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের। রাস্তায় আরেকদল আছে; বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ছেলেদের একটা অংশ খোলামেলা বিড়ি-সিগারেট ফুঁকছে, বড়দের সঙ্গে বেয়াদবি করছে। এসবের জন্য এদের দায়ী করাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, এরা দেখছে বড়রা ভালো কিছু করছে না পরিবহন সেক্টরে। এমন অরাজক পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। বড়দের তীব্র, সুনির্দিষ্ট ইচ্ছা থাকলেই কেবল সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
ভাবছি সেই বাবার কথা, সেই মায়ের কথা। সন্তানকে এত বড় করলেন। এখন সে মৃত। এমন সময় কেন আসে মানুষের জীবনে! এবার নিহত আবরারের পরিবার গরিব নয় যে কিছু টাকা দিয়ে এদের সান্ত্বনা দেওয়া যাবে। সারা জীবন ছেলে হারানোর শোক বয়ে বেড়াবে পরিবার। আবরারের বন্ধু-বান্ধব কিংবা সাধারণ বিবেকবান মানুষের কষ্ট কি আদৌ কোনো মূল্য পাবে নীতিনির্ধারকদের কাছে। বাস মালিকদের লোভ কি কমবে কিছুটা? বাস-ট্রাকচালকদের ভালো মজুরির ব্যবস্থা করা হবে? আগেরবার এত বড় আন্দোলন হয়ে গেল, পরিস্থিতি কি খুব বেশি পাল্টেছে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ দায়িত্বে সেবার অনেকগুলো নির্দেশনা দিয়েছিলেন। উনার নির্দেশনা কতটুকু বাস্তবায়ন করেছে সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষসমূহ?
এভাবে মাঝেমধ্যে লাইসেন্সবিহীন, অদক্ষ, বেপরোয়া বাসচালকরা কয়েকটা টাকার নেশায় প্রতিযোগিতা করে মানুষ মেরে ফেলবে। ছেলেমেয়েরা বড় কিছু করে ফেলবে, এ আশায় রাস্তায় নেমে আসবে। চূড়ান্ত বিচারে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য চলবে। এমন হবে আর কতবার? কীভাবে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা যায়? আর কত আবরারের মৃত্যু হলে রাষ্ট্র একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজতে আন্তরিক হবে?
উত্তর সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র সাহেব দুর্ঘটনাস্থলে এসে বললেন, আবরারের নামে একটি ওভারব্রিজ নির্মাণ করে দেবেন! একটি তরুণ প্রাণের বিনিময়ে এই ওভারব্রিজ নির্মাণ করলেই হবে! উনার কথা কেন শুনবে ছেলেমেয়েরা? কদিন আগে ময়লা ছড়িয়ে ময়লা সাফ করার যে ভিডিও আমরা ভাইরাল হতে দেখলাম, এর পরে উনার কথা কেন মানুষ বিশ্বাস করবে?
জনপ্রতিনিধিদের মূল পুঁজি হচ্ছে জনবিশ্বাস। পাবলিক যদি বিশ্বাস করে, তাঁর ডাকে জান দেবে। যেমন বঙ্গবন্ধুর এক ডাকে পুরো বাঙালি জাতি যুদ্ধে নেমেছিল। আর এখনকার অধিকাংশ জনপ্রতিনিধিকে মানুষ বিশ্বাস করে না। উত্তরের মেয়র এখন যত আহ্বানই করুক, ছেলেমেয়েরা শুনবে না। সাবেক মেয়র প্রয়াত আনিসুল হক বললে হয়তো শুনত। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকেও সারা দেশের মানুষ বিশ্বাস করে অনেক। অথবা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকেও মানুষ বিশ্বাস করত। বিশ্বাস অর্জন করা সহজ নয়। আমার ধারণা, সমাজের বড় মানুষগুলো সাধারণ মানুষকে বোকা মনে করে। মনে করে সাধারণ মানুষ আর কী-ই বা করতে পারে! রাগ-ক্ষোভ একদিন/দুদিন থাকবে, তারপর আবার চলে যাবে! সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এখন অনেক বেশি সচেতন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশের মানুষ যত ভালোবাসে কিংবা তাঁকে যতটা বিশ্বাস করে, ততটা অন্যদের করে না। অন্যদের মধ্যে জনগণের আস্থা অর্জনের চেষ্টা আছে বলেও মনে হয় না।
নীতিনির্ধারকদের, বিশেষ করে সড়ক ও গণপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা কোনো স্থায়ী সমাধান খুঁজেছেন বা খুঁজছেন এমন কোনো খবর সাধারণ মানুষের মধ্যে নেই। এখনো রাস্তায় লাইসেন্সবিহীন চালক, ফিটনেসবিহীন শত শত গাড়ি চলছে। এমনই এক লাইসেন্সবিহীন চালক আবরারকে হত্যা করেছে। লেগুনা নামের ভয়ানক বিপজ্জনক এক গাড়ি রাস্তায় চলে। ডিএমপির কমিশনার স্বয়ং টেলিভিশনে লেগুনা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় লেগুনা বন্ধ থাকলেও পরের দিন থেকেই আগের মতো চলা শুরু করে। এত বড় একজন সরকারি কর্তার ঘোষণার কি কোনো মূল্য নেই? হাতেগোনা কিছু বাস। তাও ভাঙা, লক্কড়ঝক্কড়। ভাড়ার কোনো ঠিক নেই। যাত্রীদের সঙ্গে চালক-হেল্পারের বাজে ব্যবহার, মারামারি। অসহ্য যানজট, গরম, ধুলাবালি; এগুলোই ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এমন পরিস্থিতির কি কখনো পরিবর্তন হবে না?
অথচ প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক এক চমৎকার সমাধান দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে অনেক কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর কথা কি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে?
বেঁচে থাকতে ২০১৭ সালে তিনি জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সমঝোতা মর্মে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ঢাকায় চার হাজার নতুন বাস নামানো হবে। এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট কোম্পানি এসব বাস পরিচালনা করবে।
তিনি বলেছিলেন, ‘২০০ জনের মতো লোক ঢাকার গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণ করেন। আমরা তাদের আহ্বান জানিয়েছি যে, আসেন আমরা হোল্ডিং কোম্পানি করি। হোল্ডিং কোম্পানি আমরা ৬-৭টা করার চেষ্টা করছি। পৃথিবীর অনেক দেশেই এভাবে গণপরিবহন পরিচালনা করা হয়।’
এসব কোম্পানির হাতে গেলে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসবে বলে আশা প্রকাশ করে আনিসুল বলেছিলেন, ‘বাস স্টেশনে দাঁড়াবে, যাত্রীদের হাত ধরে টানাটানি করবে না। একজন বাস মালিকের বাস যদি সারা দিনে একজন প্যাসেঞ্জারও না পায়, অন্য বাস যদি বেশি পায় তাহলে তার প্রফিট ইকুইটি শেয়ার অনুযায়ী হবে।’
এসব বাস চালাতে দক্ষ চালক তৈরিতে প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়ে আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের ড্রাইভাররা দক্ষ নন। সুতরাং আমাকে ড্রাইভারদের একাডেমি করতে হবে। আমি মনে করি, যারা বাসের ব্যবসা করবেন, এখানে তাদের জন্য এটা মেনডেটারি।’
আনিসুল হকের কথা মনে হলে মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এমন মেয়র আর কখনো আসেনি ঢাকাবাসীর জীবনে। তিনি পরিবহন মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ২৬টি বৈঠক করেছিলেন। এ বিষয়ে আনিসুল হক মন্তব্য করেছিলেন, ‘সবাইকে রাজি করানো কঠিন ছিল। কারণ এর পেছনে হাজার কোটি টাকার ব্ল্যাক মানি কাজ করছে।’
‘যারা এটা করছেন, উনারাই বলেন—ভাই, অনেক লোকের অনেক স্বার্থ আছে, যেটা বাংলাদেশে থাকে। আমরা বলেছি, তাদের স্বার্থ বেশি, না দেশের স্বার্থ বেশি? মানুষ ভুগছে; আসুন আমরা সবাই মিলে কিছু একটা করি।’
নতুন কিছু করা লাগবে না। আনিসুল হকের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলেই চলবে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? কালো টাকার সিন্ডিকেট কি আনিসুল হকের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দেবে? সরকার যদি পরিবর্তন আনতে চায়, তাহলে বর্তমানের ফিটনেসবিহীন বাস সব রাস্তা থেকে সরিয়ে আনতে হবে। নতুন বাস নামাতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে পরিবহন ব্যবস্থা রাষ্ট্র নিজে নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তিমালিকানা থাকে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু থাকলে হয়তো বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত দেশের মতো জাতীয়করণ করা হতো।
ঢাকায় অচিরেই মেট্রো রেল হবে। পদ্মা সেতু হবে। অনেক বড় পরিবর্তন হবে। কিন্তু ঢাকার সড়কের নৈরাজ্য বন্ধ করতে গেলে স্থায়ী সমাধান বের করতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।