অভিমত
গণমাধ্যমের অধীনতা
বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন, এনিয়ে আলোচনার শেষ নেই। এমনিতে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলবেন, গণমাধ্যম স্বাধীন নয়, সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেননা বা করেন না। কিন্তু যারা সমালোচনা করছেন তাদের কাছেই আবার গণমাধ্যমই শেষ ভরসা দুর্নীতির তথ্য পেতে, অনিয়ম সম্পর্কে জানতে বা কোনোঅন্যায় থেকে প্রতিকার পেতে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাস পর্যালোচনা করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তবে এই বঙ্গে কাগজ থেকে বেতার, টেলিভিশন হয়ে আজকের অনলাইন পর্যন্ত সুদীর্ঘ যাত্রায় সাংবাদিকদের একটা বড় ভূমিকা আছে। ভাষার সংগ্রাম, সংস্কৃতির সংগ্রাম, অর্থনৈতিক সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, সামরিক শাসন বিরোধী মানুষের লড়াই এবং হাল আমলের সুশাসের জন্য মানুষের প্রচেষ্টা থেকে গণমাধ্যম ও এর কর্মীরা নিজেদের কখনো বিচ্ছিন্ন রাখতে পারেননি কখনো।
একটা সময় ছিল গণমাধ্যমের মালিকানায় যারা এসেছিলেন তাদের একটা বড় অংশ এসেছিলেন রাজনীতি থেকে। তারা রাজনীতি করেছেন, কিন্তু সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতার বাইরে যেতে যাননি। এখন গণমাধ্যমের মালিকানায় বড় আকারে বড় পুঁজির প্রবেশ ঘটছে। তবে মালিকানা নির্ধারিত হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। বিশেষ করে টেলিভিশন লাইসেন্স দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটিই রাজনৈতিক। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে সেই দলের মতাদর্শ প্রচারের জন্য মালিক বেছে বেছে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দর্শনের সাথে এমন সংশ্রব শুধু মালিকদেরই নয়, সাংবাদিকদেরও। রাজনৈতিকভাবে সাংবাদিকদের ইউনিয়ন বিভক্ত হয়ে এখন এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে, প্রায় সবাই দলীয় গণমাধ্যম কর্মীতে পরিণত হয়েছে। ফলে গণমাধ্যমের কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুর মালিকানা মূলত হয়ে দাঁড়িয়েছে মালিকদের এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের। বিষয়বস্তুতে জনগণের মালিকানা কমছে দ্রুততার সাথে।
বিষয়টার আরো নানা দিক আছে। সংবিধান স্বীকৃত মত প্রকাশের স্বাধীনতার সামনে বড় বাধা রাষ্ট্র ও করপোরেট হাউজের চাপ, সমাজের সুশীল সমাজের কট্টর রাজনৈতিক অবস্থান, নতুন নতুন সব নিবর্তনমূলক আইন এবং সর্বোপরি মিডিয়ার নিজের আপস। যে দল ক্ষমতার বাইরে আছে সেই দল অনেক বেশি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে। সেই দলই ক্ষমতায় গিয়ে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার জন্য একের পর এক নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন করে। এমন একটি রাজনৈতিক অসততার মাঝেই কাজ করতে হয় সাংবাদিকসহ গণমাধ্যমের সব শ্রেণির কর্মীদের। সাংবাদিকরা, মত প্রকাশের লড়াকুরা আক্রান্ত হলে, বড় বা ছোট রাজনৈতিক নেতা অথবা দলকে সহসা তাদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় না।
আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে আছে :
১. চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেওয়া হইল।
২. রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে
ক. প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং
খ. সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হইল।
সংবিধান এমনটা বললেও কার্যত এর প্রয়োগ করতে রাষ্ট্র বরাবরই কুণ্ঠাবোধ করে। বিভাজিত রাজনীতির বাইরে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বাধা ধর্মান্ধদের জ্বালাতন। আমাদের সব দল ও মতের নেতারা ধর্মান্ধদের সামনে আজ নতজানু। উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কখনো কখনো সম্পাদক বা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করার দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে।
তবে সামগ্রিক বিচারে রাজনীতিই সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ক্ষমতায় যারা থাকেন তাদের হাতে অনেক অস্ত্র। যে গণমাধ্যম কথা শুনছেনা তার মালিকের অন্য ব্যবসা ধরে টান দাও, এমনিতেই কথা শুনবে। রাজনীতি, ব্যবসা ও ক্ষমতার সাথে গণমাধ্যমের মালিক ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অতিরিক্ত সখ্যতা এ সময়ের সবচেয়ে আলচিত বিষয়। এই সমঝোতা ও সখ্যতার কারণে সেন্সর আরোপ করতে হয় না, সেল্ফ সেন্সরশিপের খড়গ সবসময়ই সাংবাদিকের মাথা উপর ঘুরতে থাকে। এই সব আয়োজন মত প্রকাশের স্বাধীনতার খর্ব করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নেয়, যা প্রকারান্তরে গণমাধ্যমের চরিত্রকে নষ্ট করে। গণমাধ্যমের মালিকরা, কখনো কখনো সম্পাদকরাও অনেক খবর ছাপা বা প্রকাশের চেয়ে চেপে যেতেই বেশি তৎপর হন। গণমাধ্যমের মালিকরাই হয়ে গেছেন সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তা।
টেলিভিশন, বেতার ও অনলাইনগুলো সরকারী মন্ত্রীদের ব্যাপক কভারেজ দিয়েও সরকার থেকে কোনো আর্থিক প্রণোদনা পায় না। অন্যদিকে সংবাদপত্রগুলোর বড় অংশই সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল। এই সমস্যাটি কেন্দ্রে যেমন আছে, জেলা পর্যায়েও আছে। ফলে কোনো কাগজ নির্ভীকভাবে সরকারের অসাফল্য নিয়ে লেখালিখি করবে, এমনটা আর আশা করা যায় না।
বাংলাদেশে যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সে দল দুটো প্রতিষ্ঠান – বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনকে দলীয় মুখপত্র বানায়। এটা অনেকদিন ধরে চলছে। তবে মালিক শ্রেণির সাথে রাজনীতি ও ব্যবসার সখ্যতার কারণে এখন প্রায় সব চ্যানেল সারাদিনই সরকারের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের প্রচারণায় ব্যস্ত। সরকারি বা বেসরকারি মালিকানা হোক গণমাধ্যমকে গণমাধ্যমের জায়গায় রাখাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দলগুলো সাংবাদিকদের ওপর বলপ্রয়োগ করতে পারে, তাদের দমন করতে পারে, নানা ভাবে তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, এবং করেও থাকে। বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন বেসরকারি ব্যবসায়ীরাও। আর তাই, গণমাধ্যমগুলোর বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিপদটি তৈরি হয়। বহু বড় বাণিজ্যিক সংস্থা সেই সব চ্যানেল বা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে যেখানে তাদের সমালোচনাসূচক কিছু প্রচারিত হয়।
গণমাধ্যম কর্মীদের এই লড়াইটা সবসময়ই মালিকের সাথে, সরকারের সাথে, রাজনীতির সাথে, করপোরেটের সাথে করে যেতে হয়। কিন্তু একটা বিপদ সাংবাদিকরা নিজেরাই সৃষ্টি করেছেন। কোনো একটা মতবাদের কট্টরপন্থী অনুসারী হয়ে নিজেরাই রাজনৈতিকভাবে আজ বিভাজিত হয়ে নিজেদের শক্তি তলানীতে নিয়ে এসেছেন। সাংবাদিক বা বুদ্ধিজীবী সমাজ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো রকম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ রাখবেন না- এটা সবাই প্রত্যাশা করে। কিন্তু এখনকার বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ থেকে নিজেদের আর মুক্ত রাখতে পারছে না কেউ। রাজনীতি ও সমাজ সম্পর্কে সাংবাদিকদের নিশ্চয়ই দৃঢ় মত থাকবে, নিজের স্বাধীনতা বা বিবেক কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে বন্ধক রেখে দিলে তার পক্ষে নৈতিক অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয় না।
সম্পাদকরা, সাংবাদিকদের অনেকেই কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা এমনকি কোনো কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক নেতার বা বড় ব্যবসায়ীর লোকে পরিণত হয়েছেন। এর ফলে তথ্য চেপে যাওয়া বা মতামতকে বিকৃত করার প্রবণতা বাড়ছে। সম্পাদক যখন মনে করেন সত্যের চেয়ে দলের বা ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থ বড়, তখন আর সাংবাদিকতার স্বাধীনতা থাকে না। সমাজের নানা শ্রেণির সুযোগ সন্ধানীর মত সম্পাদক, সাংবাদিকও সরকারের কাছে জমি চান, প্লট বা ফ্ল্যাট চান, সরকারী পদ চান এবং এভাবে চাইতে চাইতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শব্দটি ভুলে যেতে থাকেন।
লেখক : প্রধান সম্পাদক জিটিভি ও সারাবাংলা