অগ্নিকাণ্ড
ভস্মীভূত হবে আর কত প্রাণ?
মেয়েটিকে আমি পড়িয়েছিলাম। নাম তার তানজিলা মৌলি। আমাদের বিবিএ ৫১তম ব্যাচের ছাত্রী। ডিবেট করত। বাইরে কোথাও ডিবেট থাকলে মাঝেমধ্যে আমার কাছে আসত, জিজ্ঞেস করত এটা-সেটা। পড়াশোনা শেষে বনানীর এফ আর টাওয়ারের একটা অফিসে চাকরি করত সদাহাস্যোজ্জ্বল মেয়েটা। বিয়ে হয়েছে, এখনো বছর ঘোরেনি তার। হাতে লেপ্টে আছে বুঝি এখনো মেহেদির রং। এ মাসেরই ১২ তারিখ জন্মদিন ছিল বলে ফেসবুকে তারই পোস্ট করা ছবি দেখে জেনেছি। তারই ঠিক ১৬ দিন পর সাঙ্গ হয়ে গেল তার এপারের হিসাব। সর্বগ্রাসী আগুন কেড়ে নিল তার জীবনটা। নিশ্চিহ্ন করে দিল তাকে! ভয়ংকর অগ্নি ভস্মীভূত করে দিল তার দেহখানা।
পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি এখনো ভোলেনি মানুষ। এই তো সেদিন। এই তো ফেব্রুয়ারির শেষে! নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, পথচারী-গৃহবাসীসহ আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে কয়লা হয়ে গেল ৭৮টি তাজা প্রাণ! সেই স্মৃতি এখনো দগদগে! এখনো জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে সেইসব ছবি। সন্তানহারা মায়ের চোখের জল এখনো শুকায়নি। অবুঝ কোলের শিশুটি এখনো বুঝতে পারেনি বাবা-মা তার হারিয়ে গেছে চিরজনমের মতো! আর কোনোদিন ফিরবে না, আর কোনোদিন এসে নেবে না কোলে! অগ্নিদগ্ধ সেইসব মানুষের মুখচ্ছবি এখনো জীবন্ত চোখের সামনে! দুটি মাসও গত হয়নি তারপর। আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। একই রকম কায়দায় সকলের চোখের সামনে জ্বলেপুড়ে ভস্মীভূত হলো তরতাজা প্রাণ একে একে!
পুরান ঢাকার গলি-ঘুপচি এলাকা ছেড়ে শহরের সবচেয়ে অভিজাত এলাকার একটিতে এবার। কেবল অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকল না আমাদের! সারাদিন জ্বলেপুড়ে মারা গেল ২৫ জন মানুষ! সকালবেলা যারা ঘর থেকে বেরিয়েছিল দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে। রোজকার মতোই যাদের কথা ছিল ঘরে ফিরবার। অন্য সবার মতো যাদের সকলেরই প্রিয়জন অপেক্ষায় ছিল ঘরে ঘরে। শুধু তারাই ফিরল না! ভয়ংকর আগুন কেড়ে নিল তাদের জীবন!
দিনভর অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা দেখে হতভম্ব হয়ে অসহায়ের মতো কেবল তাকিয়ে ছিলাম টেলিভিশনের দিকে। সরাসরি দেখাচ্ছিল তারা। কেমন করে চোখের সামনে পুড়ে মরছে মানুষ। আগুনের লেলিহান শিখায় টিকতে না পেরে দশতলা-বারোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ছে কেউ কেউ! এ দৃশ্য সহ্য করা যায় না। বারবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছিলাম পর্দা থেকে। তবুও স্বস্তি নেই। এরই একফাঁকে কানে এলো মৌলির মৃত্যুসংবাদ! ভয়ংকর রকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল তখন। আমার শিক্ষকতার জীবনে সরাসরি পড়িয়েছি এমন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই প্রথম কারো মৃত্যুসংবাদ শুনতে হলো। তবু সে স্বাভাবিক মৃত্যু নয়! সারা দিন চোখের সামনে দাউদাউ করে জ্বলতে দেখেছি যে এফ আর টাওয়ার, সেখানেই ভস্মীভূত হলো আমাদের স্নেহের এক ছাত্রী! এ সংবাদ বড় বেদনার! বড় নির্মম! এ প্রাণে সহ্য করা কঠিন!
বহু হতাহত, বহু মৃত্যুর সংবাদ যখন বোধহীন করে দিচ্ছিল আমাকে, সেই সময় মনে পড়ল একদিনের কথা বিশেষভাবে। মৌলিদের ব্যাচের আয়োজনে সম্ভবত নন্দন পার্কে একবার গিয়েছিলাম আমরা সকলে। সবাই যখন ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের পানিতে নেমে ঝাঁপিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল, সে তখন পাশেই হাঁটছিল পানির ধারে। পানিতে নামেনি। সে সাঁতার জানে না। সে পানি ভয় পায়। পানি ভয় পাওয়া সেই মেয়েটাই পুড়ে মরল আগুনে!
তারই মতো পুড়ে মরল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আবদুল্লাহ আল ফারুক তমাল। সকালবেলা মেয়েকে স্কুলে দিয়ে যে গিয়েছিল এফ আর টাওয়ারের অফিসে। মেয়েকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে কি না, প্রতিদিন বারবার স্ত্রীকে ফোন করে এই কথা জানতে চাইত যে তমাল, সে নিজেই আর ফিরল না। ফিরতে পারল না। দুপুরের পর হঠাৎ স্ত্রীকে ফোন করে জানাল, অফিস বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে! আমার মেয়েদের দিকে খেয়াল রেখো! পারলে ক্ষমা করে দিও আমাকে!
কেবল মৌলি কিংবা তমাল নয়, আগুনে পুড়ে মরেছে তাদেরই মতো আরো ২৬ জন মানুষ! সকলেরই ঘরে রয়েছে প্রিয়জন। আগুনে আটকে পড়ার পর সকলেরই ছিল একই রকম বাঁচার আকুতি। সবাই হয়তো একই রকম করে ক্ষমা চেয়েছে। কেউ হয়তো তাও পারেনি। তারই আগে শেষ হয়ে গেছে সব।
আর কতটা প্রাণে সয়? আর কত দেখব চোখের সামনে জীবন্ত মানুষের এইরকম জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া? কিছুই কি করার নেই? অবশ্য আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা আর নেহাত গায়ের জোরে জনা পঞ্চাশেক প্রাণ তারা বাঁচাতে পেরেছেন। এর বেশি আর কী বা করার ছিল তাদের? সক্ষমতাই বা আর কতটুকু। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে উন্নত প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম সক্ষমতা দরকার, তা কি আমাদের আছে? থাকলে তার ব্যবহার কই? না থাকলে নেই কেন? আধুনিক কোনো প্রযুক্তি নেই, নেই কোনো অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম। উন্নয়ন মানে কি কেবলই ব্রিজ-কালভার্ট? উঁচু উঁচু দালানকোঠা? জীবনের নিরাপত্তা যদি না থাকে, তবে কি লাভ এসব দালানকোঠায়? জরুরি প্রয়োজনে পরিস্থিতি মোকাবিলার সক্ষমতাই যদি না থাকে, তবে এ উন্নয়নের ফায়দা কী? মানুষ, মানুষের প্রাণ এর প্রায়োরিটিই তো সবার আগে হওয়া উচিত!
বরাবরের মতোই জানা গেল, বনানীর এফ আর টাওয়ারটি রাজউকের বিল্ডিং নির্মাণ কোড মেনে নির্মিত হয়নি! এখন কী হবে সেই হিসাব কষে? এতগুলো প্রাণ ফিরে আসবে? কে দেবে এতগুলো প্রাণের ক্ষতিপূরণ? আদৌ কি দেওয়া সম্ভব? ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২২ তলার বিল্ডিং! পুরো বিল্ডিংয়ে নেই কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা। লিফট বন্ধ হয়ে গেলে সিঁড়ি ব্যবহার করে যে মানুষ নামবে, তারও উপায় নেই। সিঁড়ির প্রস্থ নাকি মাত্র তিন ফুট! গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী স্বয়ং নিজে বললেন, এ কোনো দুর্ঘটনা নয়! এ হত্যাকাণ্ড! যদি তাই হয়, তবে এ হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্ত কে? কী সাজা হবে তার? এ রকম বহু বহু প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না। আমরা শুধু জানি, মৃত্যুই আমাদের নিয়তি।
কিছুদিন পরপর একটা করে দুর্ঘটনা ঘটবে (যদিও আমি এসব ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলতে রাজি নই! এইসব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের চেয়ে কিছু অংশে কম নয়), কিছুদিন আহাজারি করে আমরা চুপচাপ হয়ে যাব। তারপর সবই চলবে আগের মতো। আগুন লাগার পর, বহু মানুষ পুড়ে মরার পর জোর তল্লাশি শুরু হবে বিল্ডিংয়ের কী ছিল কী নেই, বিল্ডিং তৈরিতে আইন মানা হয়েছে কি হয়নি, তদন্ত কমিটি গঠিত হবে, তদন্ত চলতে থাকবে, কখনো কখনো সেই তদন্তের রিপোর্টও পেশ করা হবে, তারপর ঠিক কী হবে, ঠিক কী হয়, তা আর জানা যাবে না। নতুন কোনো ইস্যু, নতুন কোনো ঘটনা আবার দখল করে নেবে আলোচনার টেবিল। ওদিকে মৃত্যুর পরোয়ানাকারী ফেঁদে বসবে নতুন কোনো ফাঁদ। সেইখানে হবে আবারও মৃত্যুর মিছিল! আমরা অসহায়ের মতো চোখের জল মুছতে মুছতে বলব—ওপারে ভালো থেকো তোমরা! ঠিক কতকাল এইভাবে বিদায় দিতে থাকব? কে দেবে সেই প্রশ্নের জবাব!
লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।