ব্যাংকিং খাতের সমস্যা অর্থনীতির বিপদ
বাজেট উপস্থাপিত হয়ে গেছে। যার যা অবস্থান থেকে প্রতিক্রিয়া জানানোও শেষ। বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়ে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে সবচেয়ে উচ্চপর্যায় থেকে বাজেটের পক্ষে সরকারের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। একটি কথা বোধগম্য যে, খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না আগামী ৩০ জুন সংসদে এই বাজেট পাসের দিনে।
বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা, রাজস্ব কাঠামোর সংকট ও রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা এবং ব্যাংকিং খাতে বিরাজমান অপশাসনসহ বড় চ্যালেঞ্জগুলো আলোচনায় এসেছে। কিন্তু সরকার কতটা সাড়া দেবে, কোন ক্ষেত্রে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে—তা ঠিক পরিষ্কার নয়।
আমার মনে হয়, সরকার চাইলে ব্যাংক তথা আর্থিক খাতের দিকে নজর দিতে পারে। আধুনিক অর্থনীতির বুনিয়াদ বহুলাংশে ব্যাংকনির্ভর। মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের সঞ্চয় থেকে শিল্প ও বাণিজ্যের জন্য ঋণ গ্রহণ—কোনোটাই আজ ব্যাংকের বাইরে ভাবা যায় না। ব্যবসায়িক লেনদেন এবং দেশ-বিদেশে টাকা পাঠানো কিংবা গ্রহণ সবকিছুই হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ব্যাংক একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। এর ভিত্তি হলো ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা। মানুষকে বিশ্বাস করানো গেছে, তাঁর সঞ্চয় ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। যে যে শর্তে ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখেন, সেই শর্তেই তা ফেরত পান। এর মাঝে কোনো অস্বচ্ছতা নেই। ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবসায়িক লেনদেন এবং ব্যক্তিগত, বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতার সামান্যতম ব্যত্যয় হবে না।
এসব কারণেই রাষ্ট্রীয় হোক বা ব্যক্তি খাতে হোক, ব্যাংককে দেখা হয় আর্থিক ক্ষেত্রে পাবলিক ইনস্টিটিউশন বা জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অভিভাবক হিসেবে আইনের মাধ্যমে এই ব্যাংকগুলোর পরিচালনা করে থাকে। সরকারি ব্যাংকের বেলায় যেমন, বেসরকারি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেলায়ও একই আইন প্রযোজ্য। এ কথা সত্য, ব্যক্তি খাতের কিছু লোক পরিস্থিতিগত কারণে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে তাঁরা ব্যাংকগুলোতে রাখা জনগণের গচ্ছিত অর্থের মালিক বনে যাননি নিশ্চয়ই। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এমন একটি মালিকানার ধারণা তৈরি হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দর্শক বানিয়ে তাঁরাই হয়ে উঠছেন ব্যাংকের অভিভাবক।
অদক্ষতা, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং সরকারের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো যখন মানুষের কাছে আস্থাহীনতার প্রতীক হয়ে উঠছিল, তখন আলো হয়ে এসেছিল প্রাইভেট ব্যাংকগুলো। সরকার সরকারি ব্যাংকিং খাতে গত ১০ বছরে ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা জোগান দিয়েছে। এটা পুরোটাই জনগণের টাকা। অদক্ষতা আর দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা ছাড়া আর কী? নতুন অর্থবছরে আরো দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলো এই অদক্ষ সরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য।
সারা দেশে রয়েছে ডেসটিনির মতো এমএলএম কোম্পানির হয়রানি, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতারণা। ডেসটিনির মতো কোম্পানির দ্বারা প্রতারিত, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বেশির ভাগই গরিব ও অজ্ঞ। এসব মানুষ অন্যায় প্রলোভনে পড়ে টাকা ঢেলেছিলেন। মূল ক্ষতি হয়েছে গরিব শ্রেণির। সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশের এই যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি তার জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার অপ্রতুলতাকেই দায়ী করা চলে। ব্যাংকগুলো প্রতিষ্ঠান হিসেবে আকর্ষণীয় হলে মানুষ এসব এমএলএম কোম্পানির কাছে যেত না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ব্যাংকগুলোকে জাতীয়করণের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ করেছিলেন তখনকার বাস্তবতায়। এখনকার বাস্তবতায় বেসরকারি ব্যাংকই অর্থনীতির প্রাণ।
আধুনিক ব্যবস্থাপনা ও সেবার কারণে বেসরকারি ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা চলে আসে দ্রুত। শুধু সাধারণ মানুষের আস্থাই নয়, বিশ্বস্ততাই ব্যাংকের একমাত্র কীর্তি নয়, সরকারের আর্থিক নীতিমালার আলোকে অর্থনীতিতে সচল রাখাও ব্যাংকের বিকল্প কেবলই ব্যাংক। এই যুক্তিতে দেশের প্রতিটি আর্থিক লেনদেন শুধু ব্যাংকের মাধ্যমে করাই সবচেয়ে নিরাপদ। এখন অগ্রাধিকার পাচ্ছে ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম। কৃষকদের পর্যন্ত ১০ টাকার অ্যাকাউন্ট করিয়েছে রাষ্ট্র। এসবই ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি রাষ্ট্র ও জনগণের আস্থা।
আর এসবের জন্য একটাই শর্ত—ব্যাংকের কাজকর্মের স্বচ্ছতা ও দক্ষতা। টাকা গচ্ছিত রেখে কিংবা ঋণ নিয়ে মানুষ বিপদ বাড়াতে চায় না। কিন্তু একাধিক ব্যাংক যে তাদের প্রতিশ্রুতি এবং মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যাশা পূরণে অনেকাংশেই ব্যর্থ হচ্ছে, তার প্রমাণ আমরা মাঝেমধ্যেই পেয়ে থাকি। সেটাই এবার সরকারি তথ্যের আকারে প্রকাশিত হয়েছে। ব্যাংকে খেলাপি ঋণ এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি জালিয়াতি যেটি ঘটছে তা হলো একশ্রেণির মালিক পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে টাকার নয়ছয় করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাঁরা পরিবার নিয়ে ব্যাংকগুলোকে ব্যবস্থাপনার বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিই ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করছে। রাঘববোয়ালগোছের এসব ব্যক্তিকে সরকার এখন অবধি কিছুই করছে না।
এর নেপথ্যে যে রাজনৈতিক কু-নাট্য রয়েছে, তা অতি সাধারণ মানুষটিও বোঝে। এটা বন্ধ হওয়া জরুরি। এর জন্য চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং উপযুক্ত সরকারি তৎপরতা। সংস্কারের পথে চলুক সরকার। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সত্যিকারের অভিভাবক হিসেবে মঞ্চে ফিরে আসুক কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয় তার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তুলে দিক। প্রয়োজনে সরকার কঠোর হোক। ব্যাংক জালিয়াতি বা প্রতারণায় লাগাম টানতে সরকার ব্যর্থ হলে মানুষ বিপাকে পড়বে। আর তার ভয়াবহ পরিণতির জন্য তৈরি থাকতে হবে দেশের অর্থনীতিকে। অর্থমন্ত্রী এই অর্থ বছর থেকেই সেই পথে চলতে শুরু করবেন বলে আশা করছি।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।