সাদা চোখে
বিচারহীনতা ও চার তরুণের মোষ তাড়ানোর গল্প
নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো লোকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। ঢাকা শহর তো দূরের কথা, মফস্বলেও এখন বিনা লাভে ও বিনা লোভে সমাজের জন্য, মানুষের জন্য, এমনকি স্রেফ শিল্পসংস্কৃতির জন্য কাজ করা লোকও হাতেগোনা। আপনি আপনার শহরেই খোঁজ নিয়েই দেখুন, অন্তত ১০ বছর আগেও মঞ্চনাটক বা গান-বাজনা করা অথবা সামাজিক কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত তরুণের যে সংখ্যা ছিল, তাদের মধ্যে যে উদ্যম ছিল, তা এখন আছে কি না।
সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। এই ব্যস্ততা যতটা না জীবন-জীবিকার, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রলোভনের। এই ব্যস্ততা প্রযুক্তির। সবার হাতেই স্মার্টফোন। সবাই এখন একসঙ্গে আলাদা মানুষ। ফলে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর সময় নেই কারো।
তার পরও কিছু লোক থাকবেই, যারা এই ব্যস্ততা, প্রলোভন, যান্ত্রিকতা আর প্রযুক্তির হাজারো অফারের ভিড়েও সমাজের জন্য, পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করবে। কিন্তু নিজের খেয়ে এ রকম বনের মোষ তাড়াতে গিয়েও যদি কেউ সমাজ ও রাষ্ট্রের বাঘের তাড়া খায়, আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে দিনের পর দিন কারাবন্দি থাকে, জিজ্ঞাসাবাদের নামে পুলিশি রিমান্ড ভোগ করতে হয়, তাহলে কিছুদিনের মধ্যে এই বনের মোষ তাড়ানো মানুষগুলোকে বাটি চালান দিয়ে খুঁজতে হবে।
১২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী থেকে শিশু পাচারকারী সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয় ‘অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের চার সদস্যকে। যাঁরা ছিন্নমূল ও পথশিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন ‘মজার স্কুল’ নামে প্রতিষ্ঠান। যাঁদের স্বপ্ন একসঙ্গে কমপক্ষে ২০০ শিশু পড়তে পারবে এমন একটি স্কুল গড়ে তোলা। যেখানে থাকবে কম্পিউটার ল্যাব আর প্রযুক্তির নানা আয়োজন। ডিজিটাল বাংলাদেশের আলোয় যাতে পথশিশুরাও আলোকিত হয়, যাতে তারা নতুন জীবনের দিশা পায়, সেটিই মজার স্কুলের ওই তরুণদের স্বপ্ন। অথচ একটি মামলার ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হলো শিশু পাচারের অভিযোগে। এমনকি জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাদের রিমান্ডেও নেওয়া হয়। এক মাস সাত দিন কারাভোগের পর ১৯ অক্টোবর জামিনে মুক্ত হন তাঁরা। অথচ খোদ পুলিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, ওই চার তরুণের বিরুদ্ধে শিশু পাচারের কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
তাঁদের গ্রেপ্তারের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার অপরাধে যদি মানবপাচারকারীর তকমা লাগে, যদি তাদের সাজা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কেউ আর এ রকম কাজে উৎসাহী হবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা।
এর পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ ও উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন বিষয়টির খোঁজখবর নেন। এরপরই ঢাকার মহানগর হাকিম ইউসুফ হোসেন তাঁদের জামিন মঞ্জুর করেন।
জামিনের পরে অদম্য বাংলাদেশের ওই চার তরুণের আমন্ত্রণ আসে খোদ প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে। প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকনের আমন্ত্রণে চার তরুণ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যান। দেখা করেন বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে। অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়েও বৈঠক করেন তাঁরা। সাক্ষাতে মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ এই তরুণদের সঙ্গে মজার স্কুল নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করেন। সেখানে মধ্যাহ্নভোজও সারেন তাঁরা। অদম্য বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সময় স্বল্পতার কারণে আমরা সবকিছু জানাতে পারিনি। তাই আমরা একটা ঘরোয়া আয়োজনে কয়েকজন কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। উনারাও আসবেন বলে কথা দিয়েছেন। ওই দিনই আমরা আমাদের পুরো প্রজেক্টটা তাদের সামনে তুলে ধরব।’
গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে, বনশ্রী থেকে যে ১০ শিশুকে ‘উদ্ধার’ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন কুমিল্লার মোবারক হোসেন। ওই শিশুর চাচা মো. মনির হোসেনের মামলার ভিত্তিতে অভিযান চালায় পুলিশ। এজাহারে বর্ণিত বাদীর বক্তব্য মতে, ছয় মাস ধরে মোবারককে সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে অদম্য বাংলাদেশের বক্তব্য হচ্ছে, ওই ছেলে কখনোই তার সঠিক কোনো ঠিকানা বলতে পারেনি। সে কখনোই কোথাও যেতেও চায়নি। হঠাৎ করে পুলিশের অভিযান এবং ওই শিশুর বক্তব্যে তারা বিস্মিত বলে আদালতকে জানান গ্রেপ্তারকৃতরা।
বাকি যে শিশুদের উদ্ধার করা হয় তারা সাংবাদিকদের বলেছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা তাদের অভিভাবক। তাদের কারণেই তারা শিক্ষার আলো পেয়েছে। নতুন জীবনের দিশা পেয়েছে। তাদের সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার তো দূরে থাক, বরং অনেক আদর-যত্ন করা হতো বলেও শিশুরা জানায়। ছিন্নমূল এই শিশুরা এখন কম্পিউটার চালাতে পারে বলেও জানায়।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা আরিফুর রহমান আদালতকে বলেন, ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে, যেমন—সদরঘাট, কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের স্বেচ্ছাসেবকরা কমপক্ষে দুই থেকে সর্বোচ্চ তিন বছর বয়সী ছিন্নমূল বাচ্চাদের পর্যবেক্ষণ করে। যদি দেখা যায়, একই বাচ্চা দিনের পর দিন একই স্থানে থাকছে এবং অন্য কোথাও যাচ্ছে না, তখন স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের শেল্টারে আসার জন্য বলত। যারা আগ্রহী হতো তাদের নিয়ে আসা হতো।
বাংলাদেশের যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, তারই নির্মম শিকার ওই চার তরুণ। তবে এই চার তরুণের ভাগ্য অন্তত ফজলু মিয়ার চেয়ে ভালো। কেননা, সিলেটের ফজলু মিয়া বিনা বিচারে ২২ বছর কারাগারে আটক থাকার পর ১৫ অক্টোবর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে সিলেটের আদালত প্রাঙ্গণ থেকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরার অভিযোগে ফজলু মিয়াকে পুলিশ আটক করে। পরে তাঁকে মানসিক ভারসাম্যহীন দাবি করে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আইনি লড়াইয়ের পর ২০০৩ সালে আদালত তাঁকে মুক্তির আদেশ দিলেও মুক্তি মেলেনি ফজলু মিয়ার। অবশেষে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সহায়তায় তিনি সিলেটের কারাগার থেকে ছাড়া পান। এই ২২ বছরে ফজলু মিয়াকে ১৯৮ বার আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। প্রশ্ন হলো, বিনা বিচারে ফজলু মিয়ার জীবনের এই যে ২২টি বছর নষ্ট হয়ে গেল, এর ক্ষতিপূরণ কে দেবে? তার সেই সময়গুলো কেউ কি ফিরিয়ে দিতে পারবে?
একই কথা অদম্য বাংলাদেশের ওই চার তরুণের বেলায়ও। যে পথশিশুদের জন্য রাষ্ট্র ওই অর্থে কিছু করে না, সেখানে নিজের পকেট খরচের পয়সা বাঁচিয়ে, যে তরুণরা পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছেন, তাদের এক মাসের বেশি সময় যে কারাগারে আটকে রাখা হলো, জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নেওয়া হলো, তার বিচার করবে কে? তাদের যে আর্থিক, সামাজিক, শারীরিক আর মানসিক ক্ষতি করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং দেশের বিচারব্যবস্থা, তার বিচার কে করবে? কে তাদের ক্ষতিপূরণ দেবে? তাদের জীবন থেকে এক মাস সাত দিনের এই কালো অধ্যায়ের কলঙ্কমোচন করবে কে? তাদের এ সময় কে ফিরিয়ে দেবে?
বিচারহীনতা আর বিচারে দীর্ঘসূত্রতা এ দেশে নতুন নয়। অবিচারেরও সংখ্যাও অগণিত। র্যাবের গুলিতে যে নিরপরাধ কলেজছাত্র লিমন পঙ্গু হলো, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে আইনের গ্যাঁড়াকল থেকে তাঁর মুক্তি মিলেছে ঠিকই, কিন্তু যে বা যারা লিমনের পায়ে গুলি করল, তাদের বিচার কে করবে? লিমন এখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। কিন্তু যদি দেশের গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি আলোচিত না হতো, তাহলে পুরো রাষ্ট্রয্ন্ত্র কিশোর লিমন ও তাঁর পরিবারকে সন্ত্রাসী বানানোর যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, তাতে এখন তার দিনমজুর বাবা-মাসহ পুরো পরিবারকেই থাকতে হতো জেলে। আর বহু বছর জেল খেটে বেরিয়ে পঙ্গু লিমন হয়তো ভিক্ষা করত।
এ রকম আরো অনেক ঘটনাই আমাদের অগোচরে থেকে যায়। সবাই লিমন নয়, সবাই অদম্য বাংলাদেশের আরিফ, সবুজ, জাকিয়া কিংবা শুভ নয়। সবার ঘটনা গণমাধ্যমে আসে না। সবাইকে নিয়ে ফেসবুক তোলপাড় হয় না। ফলে এই বিচারহীনতা আর অবিচারের শিকার আরো কত মানুষ যে কত নির্মম পরিণতি ভোগ করছেন, তা আমরা জানি না। আরো কত ফজলু মিয়া বিনা বিচারে বছরের পর বছর কারাগারে আছেন, তা আমরা জানি না। তবে এটুকু বলা যায়, যাদের কারণে এই বিচারহীনতা আর অবিচার, তাদের কোনোদিন বিচার হবে না।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও উপস্থাপক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।