যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-ইরানের তিক্ত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী
পাল্টাপাল্টি তেল ট্যাংকার জব্দ করা নিয়ে হুমকি-পাল্টা হুমকির মধ্য দিয়ে যুদ্ধের উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলছে ইরান ও যুক্তরাজ্য। বর্তমানে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি এখন যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও ইরানের চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। পারস্য উপসাগরে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিবাদে জড়ায় ইরান। কিন্তু পরে ওয়াশিংটনের ইন্ধনে কিংবা মিত্রতার রক্ষার বাধ্যবাধকতায় তেহরানের সঙ্গে বিবাদে জড়ায় যুক্তরাজ্য।
ব্রিটিশ পতাকাবাহী ট্যাংকার স্টেনা ইমপেরো ইরানের হাতে আটক হওয়ার আগে ব্রিটেনের রণতরি এইচএমএস মন্ট্রোজের সঙ্গে ইরানি নাবিকদের যোগাযোগ হয়েছিল। বেতারে দুই পক্ষের যোগাযোগের রেকর্ডটি ২১ জুলাই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। ওই রেকর্ডে শোনা যায়, এইচএমএস মন্ট্রোজের নাবিকরা স্টেনা ইমপেরোর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা যেহেতু সর্বস্বীকৃত আন্তর্জাতিক প্রণালির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, সুতরাং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে আপনাদের যাত্রাপথ কোনোভাবেই বাধাপ্রাপ্ত, প্রতিহত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়।’ এরপর এইচএমএস মন্ট্রোজ ইরানি নাবিকদের কাছে নিশ্চিত হওয়ার উদ্দেশে জানতে চায়, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে স্টেনা ইমপেরোয় অবতরণের চেষ্টা তাঁরা করবেন কি না? শেষমেশ ইরান ২৩ নাবিকসহ স্টেনা ইমপেরো আটক করে।
এ মাসের শুরুতে ইরানের ট্যাংকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করছে সন্দেহে তা জব্দ করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। সিরিয়ার জন্য তেল বহন করছে সন্দেহে ৪ জুলাই স্পেনের দক্ষিণ উপকূলে যুক্তরাজ্যে তাদের অন্তরীপ জিব্রাল্টারের কাছে ইরানের গ্রেস ১-কে জব্দ করে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার সূত্রপাত হয়। ৯ জুলাই উপসাগরীয় এলাকায় ইরানের জলসীমায় যুক্তরাজ্যের নৌযানগুলোর হুমকি রয়েছে বলে জানায় যুক্তরাজ্য। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অভিযোগ করে, এর একদিন পর ওই অঞ্চলে ব্রিটিশ তেলবাহী ট্যাংকারকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে ইরানের জাহাজগুলো; যদিও ইরান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ জুলাই ব্রিটিশ পতাকাবাহী জাহাজ আটকের ঘটনাকে ইরানের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরানের বিশাল তেলসম্পদের ওপর নজর পরে তৎকালীন পরাশক্তিগুলোর। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন ব্লক ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ব্লক মরিয়া হয়ে ওঠে সেই তেলের জন্য। দুই ব্লকের গোয়েন্দারা তৎপর হয়।
আমরা জানি, দ্রুততম সময়েই ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার বিষয়টি ইতিমধ্যেই ব্রিটেনে সরকারের আলোচনার টেবিলে রয়েছে। এ ছাড়া ইরানকে রুখতে আরো কয়েকটি বিকল্পও চিন্তা করা হচ্ছে ব্রিটেনের পক্ষ থেকে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের শক্তিকে আরো বলিয়ান করে তুলতে ব্রিটেন বিশেষ মনোযোগী হয়েছে। ব্রিটেনের নৌবাহিনী খুবই দুর্বল। প্রত্যেকটি জাহাজ টহল দিয়ে পার করা অসম্ভব। তাছাড়া তাদের রণতরীগুলোও খুবই ছোট। এ কারণেও হয়তোবা ইরানের সঙ্গে টক্কর দিতে ব্রিটেনের হিমমিশ অবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে। আর এই বিষয়টি মাথায় নিয়ে এবং ভবিষ্যতে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নতুন প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। এদিকে, যুক্তরাজ্যের ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তিগুলো’ ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করছে অভিযোগ করে তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশটিতে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত।
প্রতিশোধ নিতেই যুক্তরাজ্যের মালিকানাধীন তেলবাহী ট্যাংকার ইরান আটক করেছে বলে মনে হয়। ২০ জুলাই ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনার পর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরিমি হান্ট এ দাবি করেন। হান্ট বলেন, জাহাজ আটকের ব্যাপারে ইরানের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে ‘ইটের বদলে পাটকেল অবস্থা’। পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিটেনের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সংকট থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে পাওয়ার ওপর আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী পেনি মরডন্ট হরমুজ প্রণালি থেকে স্টেনা ইমপেরো আটককে ‘শত্রুতামূলক কর্মকা-’ অ্যাখ্যা দেন। পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চিঠি পাঠিয়েছে ব্রিটেন। এ ছাড়া পররাষ্ট্র দপ্তর নিশ্চিত করেছে যে মি. হান্ট তার ফরাসি ও জার্মান সমরপন্থীদের সাথে কথা বলেছেন, যারা উভয়েই ইরানের কর্মকাণ্ডকে নিন্দা জানিয়েছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় অনুমান করা যাচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক নৌ চলাচলের স্বাধীনতার প্রতি এটা সুস্পষ্ট চ্যালেঞ্জ। পারস্পরিক এই চ্যালেঞ্জ বিশ্ব রাজনীতিকে শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। সম্প্রতি বিদ্যমান যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-ইরানের সম্পর্কে যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে তা এই পাল্টাপাল্টি আক্রমণের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। কাজেই এ ক্ষেত্রে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমেই বর্তমান সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।