পালিয়ে বাঁচা যাবে না, বাঁচতে হলে লড়তে হবে
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল একজন অনুসরণীয় চরিত্র। ইদানীং বাংলাদেশে অনেক মটিভেশনাল স্পিকার, মটিভেশনাল তৎপরতা দেখা যায়। অত কিছু দরকার আপনার মটিভেশনে ঘাটতি হলে মোস্তফা কামালের জীবনীটা একটু পড়ে নেবেন। শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতাই নয়, ব্যবসায়ী মোস্তফা কামাল বিপুল বৈভবেরও মালিক। এই বিত্ত-বৈভব-ক্ষমতা তিনি লটারিতে বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাননি। তিনি অর্জন করেছেন, মেধা আর কঠোর পরিশ্রমে। অথচ ছেলের পড়াশোনা চালানোর সামর্থ্য ছিল না তার দরিদ্র বাবার। এলাকার মানুষের সাহায্যে তিনি স্কুলের বেতন দিয়েছেন।
পড়াশোনা করেছেন মানুষের বাড়িতে লজিং থেকে। পড়াশোনার জন্য ঢাকায় আসার ভাড়া ছিল না। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা টিকেট চেকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিনা টিকেটে ঢাকায় এসেছিলেন। তারপরের গল্প রূপকথাকেও হার মানায়।
১৯৭০ সালে সিএ পরীক্ষায় দুই পাকিস্তান মিলিয়ে রেকর্ডসংখ্যক নম্বর পেয়েছিলেন। অসাধারণ এই মেধার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে ‘লোটাস’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। মেধার সেই অর্জনকে তিনি কখনো ছাড়েননি। তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম লোটাস কামাল, সাধারণেও তিনি লোটাস কামাল নামে পরিচিত। ঢাকায় আসার ভাড়া না থাকা সেই লোটাস কামাল জীবনে যা চেয়েছেন, তাই পেয়েছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে আইসিসির প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এমপি হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। তার জীবনের স্বপ্ন ছিল অর্থমন্ত্রী হবেন, তাও হয়েছেন। কিন্তু সেই লড়াকু, সংগ্রামী লোটাস কামাল কাবু হয়েছেন ছোট্ট মশার কাছে। কতটা কাবু হয়েছেন সেটা সবাই দেখেছেন সরাসরি।
অর্থমন্ত্রী হওয়া তার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নপূরণে প্রথম অর্জন ছিল জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন। কিন্তু বাজেট উপস্থাপনের আগেই তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। অ্যাপোলো হাসপাতালে গোপনে চিকিৎসা নিয়েও বাজেট পেশ করতে চেয়েছিলেন। সংসদ পর্যন্ত এসেছিলেনও। কিন্তু ১৩ জুন সংসদে আ হ ম মোস্তফা কামালের বাজেট উপস্থাপনের স্মৃতি আপনারা ভুলে যাননি নিশ্চয়ই। কোনোরকমে বাজেট পেশ শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হয়ে বাজেট পেশ করেন। ডেঙ্গু এমনই এক রোগ, যা একজন মানুষকে বিধ্বস্ত করে দেয়। ৩০ জুন বাজেট পাশের দিন সংসদে ফিরে এসে তিনি ১৩ জুনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেছেন, ১০ মিনিটের মতো তিনি ব্ল্যাক আউট ছিলেন। তার কিছুই মনে নেই। এমনকি বাজেটের বইয়ের পাতা ওল্টানোর ,মতো শক্তিও তার ছিল না। বেগম মতিয়া চৌধুরী পাতা উল্টে দিয়েছেন। তারপরও পড়তে পারেননি। আজন্ম লড়াকু লোটাস কামাল মশার কাছে যে নিছক কাবু হয়েছেন, তাই নয়। তিনি রীতিমতো পালিয়ে গেছেন।
অর্থমন্ত্রী হওয়ার আগে লোটাস কামাল পরিকল্পনা মন্ত্রী ছিলেন। তার দায়িত্বের সময় তিনি আগারগাঁওয়ের পরিকল্পনা কমিশনকে নতুন করে সাজান। পরিকল্পনা কমিশনের দুটি ব্লকে ছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন নিজস্ব ভবনে চলে যাওয়ার পর পুরো চত্বর পরিকল্পনা কমিশনের অধীনে আসে এবং নতুন করে সাজে। অর্থমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি আগারগাঁওয়ের পরিকল্পনার কমিশন চত্বরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে অফিস করতেন। কিন্তু ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর তিনি আর পরিকল্পনা কমিশনের অফিসে যাচ্ছেন না। এখন থেকে তিনি সচিবালয়ে অফিস করছেন। অর্থমন্ত্রী সচিবালয়ে অফিস করলে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি যে কারণে পরিকল্পনা কমিশনে যাচ্ছেন না, সেটা তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।
লোটাস কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ওখানে বেশি মশা। এ পর্যন্ত দুবার কামড় দিয়েছে। একবার চিকুনগুনিয়া, দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু। এটা কোনো কথা হলো। আমি এজন্য ভয়ে ওখানে যাচ্ছি না।’ সংসদে অর্থমন্ত্রীর যে অবস্থা দেখেছি, তাতে ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ব্যক্তিটি যখন আ হ ম মোস্তফা কামাল, তখন আমি ভেবেছিলাম অন্যরকম। অর্থমন্ত্রী না হয় অফিস বদলে ফেললেন, কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন চত্বরের বাকি অফিসগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারী, সংলগ্ন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক বা আগারগাঁও এলাকার মানুষ কই যাবে? অর্থমন্ত্রী কি জেনেশুনে তাদের ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকির মধ্যে রেখে আসলেন না। মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের এই পলায়ন, সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা দেবে। অর্থমন্ত্রী বরং পরিকল্পনা কমিশনসহ গোটা আগারগাঁও এলাকা, সম্ভব হলে গোটা ঢাকাকে মশামুক্ত করতে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারতেন। সেটা না করে তিনি পালিয়ে গেলেন। কিন্তু এবার ডেঙ্গুর যে ভয়াবহ বিস্তার, পালিয়ে বাঁচা যাবে না। বাঁচতে হলে, লড়তে হবে পত্রিকার হিসাব অনুযায়ী এবার এখন পর্যন্ত সাড়ে তিন লাখ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন অন্তত ৩০ জন। অর্থমন্ত্রী থেকে রিকশাওয়ালা ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকে কেউই মুক্ত নন। এমনকি হবিগঞ্জের সিভিল সার্জনও ডেঙ্গুর ভয়াল থাবা থেকে মুক্তি পাননি। ঢাকায় আনতে আনতে মারা গেছেন তিনি।
এবারের মৌসুমের শুরুর দিকে মারা গেছেন একজন ডাক্তার। মৃতের তালিকায় ডাক্তারের সন্তানও আছে। তাই নিরাপদ নয় কেউই। অর্থমন্ত্রী না হয় পালিয়ে গেছেন। কিন্তু আমি-আপনি পালাব কোথায়? ডেঙ্গু এখন ঢাকা ছাড়িয়ে গাজীপুর, খুলনাসহ বিভিন্ন শহরে ছড়িয়েছে। একটাই উপায় আগে গ্রামে চলে যাওয়া। ডেঙ্গুর কারণ যে এডিস মশা, সেই মশা অভিজাত এলাকায় থাকে। সব ছেড়ে এখন গ্রামে যাওয়াও সম্ভব না। তাহলে কী করতে হবে? বাঁচতে হলে লড়তে হবে, সচেতন থাকতে হবে। ডেঙ্গু হঠাৎ করে আসেনি।
২০০০ সাল থেকেই বাংলাদেশে মৌসুমী আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়ে ডেঙ্গু ছড়াবে, এটা তো সবারই জানা। দুই সিটি করপোরেশনও নিশ্চয়ই জানে। তাহলে তারা ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর আগেই মশা মারতে বিশেষ পদক্ষেপ নিল না কেন? বাড়ি-ঘর পরিষ্কার রাখার উদ্যোগ নিল না কেন? পরিষ্কার পানি যাতে জমতে না পারে,তা নিশ্চিত করা হলো না কেন? মশা মরে না এমন ওষুধ ছিটানো হলো না কেন? এখন জনসচেতনতা সৃষ্টিতে যা যা করা হচ্ছে, আগে তা করা হলো না কেন? আমি এটা বুঝি না, দায়িত্বশীল সবাই কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমান? বিশ্বে সম্ভবত এই প্রথম হাইকোর্ট মশা মারার নির্দেশ দিয়েছেন।
এবারের ডেঙ্গুর ধরনটা একটু অন্য। ডেঙ্গু বোঝার আগেই মানুষ কাবু হয়ে যায়। এবারের ডেঙ্গুতে তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রি, র্যাশ দেখা যায় না, রক্তক্ষরণও হয় না। হাড়ে বা শরীরের সংযোগস্থলে ব্যথাও হয় না। ফলে অনেকে বুঝতেই পারে না যে সে ডেঙ্গু আক্রান্ত। তাই গুরুত্ব দেয় না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, জ্বর চলে যাওয়ার পরে প্লাটিলেট ভেঙ্গে ব্লাডপ্রেসার কমে কলাপস করে। জ্বরের সাথে বমি ও লুজ মোশনও ডেঙ্গুর লক্ষণ। এবারের ডেঙ্গু হেমোরেজিক নয়, শকড সিনড্রম। ডেঙ্গুর ধরন যাওয়ায় টের পাওয়ার আগেই রোগী বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যায়। তাই ডাক্তারদের পরামর্শ, জ্বর অল্প হোক আর বেশি, দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। অপেক্ষা করা চলবে না। আর জ্বর যাতে না আসে, সে জন্য মশা থেকে দূরে থাকতে হবে। মশা যাতে বংশ বাড়াতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সিটি করপোরেশন তো করবেই। আপনার বাসার পাশে যাতে কোথাও পানি জমতে না পারে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু আপনারও।
জ্বর এলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রচুর তরল খাবার খেতে হবে, প্যারিাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্ক নয়, সতর্কতা জরুরি। বাঁচতে হলে লড়তে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক