বিশ্লেষণ
একদিকে নিরাপত্তাহীনতা, আরেকদিকে অত্যাচার : সলিমুল্লাহ খান
প্রতি রোববার প্রচারিত এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘এই সময়’-এর এবারের বিষয় ছিল ‘রাজধানীতে প্রকাশক হত্যা এবং ব্লগার হত্যার চেষ্টা’। অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে কথা বলেছেন চিন্তাবিদ অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তাঁর বক্তব্যের শ্রুতিলিখন নিচে তুলে দেওয়া হলো।
আমরা যেগুলোকে বলি মৌলিক অধিকার সেগুলো আসলে কীভাবে তৈরি হলো? যখন রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে, রাষ্ট্রকে বলা হয় রাজনৈতিক সংগঠন। ইংরেজিতে একে বলে পলিটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। রাষ্ট্রের কর্তব্য হচ্ছে নাগরিকদের জন্মগত এবং অপরিবর্তনযোগ্য অধিকারগুলো নিশ্চিত করা। সেগুলোর মধ্যে ফরাসিরা ফরাসি বিপ্লবের বছর যে ঘোষণাপত্র দিয়েছিল, সেটাকে মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারে সর্বজনীন ঘোষণা বলা হতো তখন। সেখানে তারা ২ নম্বর ধারাতে বলেছিল, সব রাষ্ট্রের উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে নাগরিকদের এ অধিকারগুলো নিশ্চিত করা। সে অধিকারের মধ্যে চারটির নাম তারা উল্লেখ করেছে। প্রথমটি হচ্ছে, তাদের মতে মানুষের স্বাধীনতা (লিবার্টি), দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাদের ভাষায় সম্পত্তি (প্রোপারটি), তিন নম্বরটি হচ্ছে নিরাপত্তা (সিকিউরিটি), নির্যাতন বা নীপিড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা (রেজিটেন্স টু অপ্রেরেশন)। এই চারটি কাজ করতে হবে রাষ্ট্রকে। কারণ আমরা যদি নিরাপত্তাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছেড়ে দেই তাহলে দেখা যাবে, যারা ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তা দিতে পারছে না তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তাই নিরাপত্তাহীনতা রাষ্ট্র গঠনের পরে এটি আর প্রাইভেট থাকতে পারে না, এটি হয়ে যায় পাবলিক। এটা গুরুত্বপূর্ণ।
এখন যে বিষয়ে আমাকে বলতে বলা হয়েছে, সে বিষয়টিতে আমরা কিছুটা ব্যথিত, কিছুটা আতঙ্কিত এবং কিছুটা বিস্মিত। সেটা আমাদের দেশের ইতিহাসের চেয়ে একটু ভিন্ন মাত্রা গ্রহণ করেছে। একদিক থেকে এতে নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং এর দায়-দায়িত্ব প্রথমেই রাষ্ট্রের ওপর পড়বে এবং যারা এই ঘটনা ঘটাচ্ছে, সেই ঘাতকরা যে ব্যক্তিকে আক্রমণ করছে, সেটা তো দৃশ্যমান এবং একই সাথে এই আক্রমণ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাজ্যের বিরুদ্ধেও। এজন্য বলছি এটা এক ধরনের নৈরাজ্য। কারণ যে কেউ যদি অপরাধ করে আমার দৃষ্টিতে, এমন কোনো কথা বলে, এমন কোনো বই লেখে যেটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তার জন্য বিচার চাইবার যে চ্যানেল আছে, সেটা রাষ্ট্রের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। রাষ্ট্রের একটা শাখার নাম বিচার বিভাগ। সেটাকে যদি আমি যেকোনো কারণেই পাত্তা না দেই। অর্থাৎ আমি আর রাজ্য চাই না, আমি নৈরাজ্যের পথে যাই।
ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রের কাছে তার নাগরিকত্বের সনদ লাভ করেছে, ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রকে গঠন করেছে। তখন সে কিন্তু অস্ত্র রাখার অধিকার ত্যাগ করেছে। আধুনিককালের দার্শনিকদের মধ্যে একজন হচ্ছেন জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ম্যক্স বেভার। তিনি বলেছিলেন যে, রাষ্ট্রই একমাত্র শক্তি যার কাছে মনোপলি অব ভায়োলেন্স অর্থাৎ অস্ত্র রাখার একাধিকার রাষ্ট্রের কাছে। আর জনসাধরনের কাউকে কাউকে হয়তো সরকার লাইসেন্স দেয় একটি বন্দুক, একটি রাইফেল বা একটি পিস্তল রাখার জন্য। কাজেই ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তা বিধান করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
যদি রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, মৌলিক অধিকার দিতে ব্যর্থ হয়- তাহলে আমরা তাকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলি। সেদিক থেকে বলতে গেলে, আধুনিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র সেটাও ব্যর্থ রাষ্ট্র। যেমন সে তার কালো নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। উপাসনা করার জন্য গির্জায় লোকজন সমবেত হলে সেখানে জনৈক উন্মাদ লোক হত্যা করেছে আট-নয়জনকে। সেদিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ব্যর্থ। অথবা ধরেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্র তো আর নাই সেই ১৯৬০-এর দশকে। তার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে গুলি করে হত্যা করা হলো। অর্থাৎ তারা প্রেসিডেন্টকেও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। অর্থাৎ কোনো নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা নেই।
এই কথাগুলো মনে রেখেই বলছি, আজকে আমাদের বুকে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে, সাধারণভাবে নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধ এবং বাস্তব নিরাপত্তা দুটোই কমেছে। গতকাল দীপনের বাবা যে কথাটি বলেছেন, যে আমি বিচার চাই না। এটার অনেকে ভুল ব্যাখ্যা করছে। তিনি আসলে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর খানিকটা আস্থা হারিয়েছেন। কিন্তু পাছে তাকে কেউ ভুল বোঝেন তাই পরের বাক্যেই তিনি বলেছেন, আমি আইনে বিশ্বাস করি, আমি মামলা করব যথারীতি। কিন্তু তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, এতে যে বিচার হবে এমন আশা আমি করি না। কথাটি তিনি এভাবেই বলেছেন। আমার মনে হয় এটাকে নিয়ে টানাহেচড়া না করাটাই ভালো।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যুক্ত করা যায়। বিমান ও পর্যটনের দায়িত্ব যিনি পালন করছেন সেই মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের যে বিবৃতি সেটা ভাববার মতো। উনি বললেন, রাষ্ট্র হিসেবে অর্থাৎ পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী দিয়ে আমরা যেটুকু দমন করছি, কিন্তু যে কাজটি করা উচিত ছিল সমাজের মধ্য থেকে, এ ধরনের কাজকে নিরুৎসাহিত করার যে আন্দোলন, সেই সামাজিক আন্দোলন, সমাজ এটাকে প্রতিরোধ করবে, সেটা হয়নি। মানে এখানে পরিষ্কার উনি দুটো কথা তুলেছেন, একটা হচ্ছে রাষ্ট্রের এলাকা, আরেকটি হচ্ছে সমাজের এলাকা, এটা মনে মনে আমাদের একটা বিভক্তি আছে।
যদি সমাজের ভেতর থেকে এটি প্রতিরোধ না হয় অর্থাৎ যেমন ধরুন যারা এমন ধরনের হত্যাকাণ্ড করছে তাদের বিরুদ্ধে যদি সামাজিক বিক্ষোভ হয় তাহলে..., যারা করছে তারাও তো আমাদের সমাজের। এখানে একটি কনফিউশন তৈরির চেষ্টা হচ্ছে যে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের নাম বলা হচ্ছে। হোক সেটা আল-কায়েদা, সেটা হোক আইএসএস। এগুলোর তলায় একটি গোপন এবং গূঢ় সত্য আছে। যারা করছে তারা অধিকাংশই আমাদের দেশের লোক। অর্থাৎ আমাদের দেশেরই সন্তান। আমাদেরই সন্তান। এটা আবুল কাসেম ফজলুল হক বলার চেষ্টা করেছেন। এই যে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা, রাজনীতির যে ভুল পথে যাওয়া, সেটা তো তাদের বোঝাতে হবে। সেটা তাদের কে বোঝাবে, আমাদের সমাজকেই বোঝাতে হবে। এখানে সমাজকে আরো একটি ভাগ করতে হবে। আমরা যারা মনে করি রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে, রাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি, বিভিন্ন জাতিগত সম্প্রদায়ের প্রতি সমান আচরণ করবে, যেটাকে আমরা ধর্ম নিরপেক্ষতা শব্দ দিয়ে বর্ণনা করতে চেয়েছি। সেখানেও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে। যে যে সম্প্রদায়ের লোক, তার নিজের সম্প্রদায়ের প্রতিও দায়িত্ব আছে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোকই মুসলিম। শতকরা নব্বই ভাগ লোকই মুসলিম। তাহলে তাদের মধ্যেও যদি ইসলামের নামে যেগুলো হচ্ছে সেগুলো যে বাংলার মুসলমান সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করছে না, সেই কথাটাও তাদের সমাজকে বুঝাতে হবে, মুসলিম সমাজের লোকজনদেরই।
তারপর রাষ্ট্রের কথা। এইটা যে আমি বলছি, সামাজিক আন্দোলনের একটা স্তর। আমাদের স্কুলে, আমাদের কলেজে বোঝাতে হবে, আবুল কাসেম ফজলুল হক যেভাবে বলেছেন, সমস্যা শেষ বিচারে আদর্শগত। বর্তমানে প্রথমেই মনে হচ্ছে, এটা একটা আইনশৃঙ্খলার সমস্যা। সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। এটা আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বটেই। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলেই আমরা সবাই মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারি না। আমাদেরও দায়িত্ব আছে। কারণ আমাদের সবারই এ বিষয়ে দায় আছে। দায় থেকে দায়িত্ব আসে। দায়টা কেন? যেহেতু আমাদের সমাজে একাত্তর থেকে যে বিভাজন হয়েছে, যেটার জন্য যুদ্ধাপরাধীর বিচার এখনো শেষ হয়নি এটা একটা।
আরেকটা কথা বলি, ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর এই দেশে জেলখানার ভিতরে দেশের যে শীর্ষস্থানীয় চারজন নেতাকে জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ আর কাকে বলে, যদি এটাকে না বলেন? তাহলে সেটা হয়েছে কীভাবে এখন এটা পরিষ্কার। সেটার জন্য কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে দায়ী করার চেয়ে বেশি দায়ী করতে হবে তৎকালীন রাষ্ট্রকে। খোদ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের সেখানে দায় ছিলে, আরো রাষ্ট্রের আরো অন্যান্যের দায়ও ছিল। আমি সেই কথাটি বলছি যে, এটি একটি ঐতিহ্য।
আমরা আশা করেছিলাম, আমাদের এখানে সভ্য মানব সমাজ হবে। অর্থাৎ আমরা রাষ্ট্রের ওপর কিছু ভার দিয়ে রাষ্ট্রকে কর দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারব। কিন্তু, আমি আগেও বলেছি, ষোল আনা নিশ্চিন্তে থাকা যায় না। কিন্তু আমরা পনেরো আনা থাকতে পারব। এখন সমস্যা হচ্ছে আমরা যদি বারো আনাও থাকতে না পারি, আট আনাও থাকতে না পারি, তাহলে এখানে সরকারের দায় আছে। শেষ বিচারে আমি বলব ফিরে এসে, আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, যে কথাটি তিনি বলেছেন, তিনি একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী। তিনি ড. আহমেদ শরীফের ছাত্র ছিলেন এবং তাঁর সহকর্মী ছিলেন। আহমেদ শরীফ একজন শুভ বুদ্ধির লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু আহমেদ শরীফকেও আক্রমণ করা হয়েছিল। নাস্তিক হিসেবে। সেজন্যই বলেছি এখানে নিরাপত্তার জায়গা অনেক কম। তবুও আবুল কাসেম ফজলুল হক তাঁর পুত্রের মৃত্যুর পর মানসিক ধৈর্য রক্ষা করে যে কথা বলেছেন, সেজন্য আমি তাঁকে স্বাগত জানাই এবং আমি তাঁকে অভিনন্দন জানাই যে, তিনি সাথে সাথে প্রতিশোধের কথা না বলে, তিনি শুভবুদ্ধি উদয়ের কথা বলেছেন। আমি মনে করি এটা হলো দীর্ঘমেয়াদি দূরদর্শিতার পরিচয়।
এ রকম বুদ্ধিজীবী সমাজে খুব একটা বেশি দেখা যায় না। সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আমি একটা কথাই বলি। অনেক ধরনের সন্ত্রাস আছে। আমি ব্যবসায়িক সন্ত্রাস ইত্যাদিকে বাদ দিয়ে বলছি, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, যেটাকে বলে গুপ্তহত্যা এটা আমাদের ইতিহাসে কখন দেখা দিয়েছিল? আমি আগে যাব না। এই ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে এ দেশে যখন সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি খুব বেড়ে গেল, ইউরোপে তখন ফ্যাসিবাদের যুগ। মুসোলিনি, হিটলারের যুগ। আমাদের এখানে তখন স্বাধীনতা সংগ্রামী যারা, যারা স্বদেশি আন্দোলনের সময় থেকে এসেছিল, যাদের ইংরেজরা বলত সন্ত্রাসবাদী আর আমরা বলতাম বিপ্লবী, তারা এখন স্মৃতিকথা লিখছেন- ‘কেউ বলে ডাকাত, কেউ বলে বিপ্লবী’, লিখেছেন অনন্ত সিং, তাঁদের ওপর লেখা বইগুলোতে দেখা যায়, তারা যে পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলেন, বেছে বেছে সরকারি কর্মকর্তা হত্যা এবং যাদের তারা পছন্দ করে না সেই বিদেশিদের হত্যা। সেটার পরিণতি কিন্তু ভালো হয়নি। ভারতের বেশির ভাগ মানুষ সেটাকে সমর্থন করেনি। তখন আরেকটি খারাপ বিষয় হয়েছিল, হিন্দু মুসলমান দুটো সম্প্রদায়ের বিরোধ বেড়ে গিয়েছিল। এখন এই ধরনের পরিস্থিতি পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। যদিও বা এখন উদ্যোগটা হচ্ছে মুসলিম সমাজের কিছু তরুণের হাতে।
ভারতে এই মুহূর্তে কী চলছে? আজকে দিল্লিতে সেমিনার হয়েছে। প্রফেসর রমিলা থাপার যার বয়স আশির ওপরে, প্রফেসর এরফান হাবীব, ডি এন ঝা, আরো নামকরা যারা আছেন ঐতিহাসিক ভারতে, এমনকি উপিন্দার সিং ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে, তাঁরা সবাই অংশ নিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, বর্তমান বিজেপি সরকার সেখানে এরকম সিলেক্টিভ হত্যায় অংশ নিচ্ছে বা তাকে উৎসাহিত করছে। বিশেষ করে আরএসএস। এরফান হাবীবের বিবৃতিটা আমার খুব ভালো লেগেছে, তিনি বলেন, আরএসএস এবং আইএসআইএস (ISIS), তারা পরস্পরের কাছে আসছে এবং ভারতে যে নীতি অনুসরণ করছেন মোদি সরকার, সেটিকে অনুমোদন না করে তার বিরুদ্ধে আজকে বিবৃতি দিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর এবং রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। অর্থাৎ ভারত যে বহুত্ববাদী, সেটা থেকে সরে এসে যে একাত্ববাদী করার চেষ্টা করছে, এটা এরফান হাবীব বলছেন, পাকিস্তানের ইমেজ হয়ে উঠছে।
আমি মনে করি, আমাদের এখন যে সন্ত্রাসবাদ চলছে, এটা ১৯৩০-এর দশকের ভারত সন্ত্রাসবাদের ইমেজ হয়ে উঠছে। কিন্তু পার্থক্য এরমধ্যে একটা, ১৯৪৭-এর আগে যে দেশপ্রেমের দরকার ছিল আরএসএস সে দেশপ্রেম দেখায়নি। তারা শুধু মুসলিমদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। আমি বলব, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, বর্তমানে সরকারের অব্যবস্থা এবং দেশে গণতান্ত্রিক অধিকারের কিছু সীমাবদ্ধতা, সাংঘাতিক ক্ষেত্রে অনুপস্থিতির কারণে এটা বাড়তে পারে। কিন্তু তবুও আমাদের মনে রাখতে হবে, আমি যে চারটি অধিকারের কথা বলেছিলাম, ফরাসিদের স্বীকৃত স্বাধীনতার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার। আর দুটি একই সাথে আসে নিরাপত্তা ও নির্যাতন বা নীপিড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অধিকার।
এখন আমাদের অবস্থা হচ্ছে শাখের করাতের মতো। সরকারের তরফ থেকে যে পীড়নটা আসে সেটাকে বলে অপ্রেশন, সেটার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হয়। আবার এই যে বেসরকারি নানা মহল থেকে যে আক্রমণ আসে, লেখকদের ওপর, সাহিত্যিকদের ওপর, শিল্পীদের ওপর অথবা যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ওপর, তখন এটিকে বলা হয় সিকিউরিটির অভাব। আমরা একদিকে নিরাপত্তাহীনতা, আরেকদিকে অত্যাচার দুটোর মুখোমুখি পড়েছি। এখন এর থেকে সম্ভাব্য পরিত্রাণের পথটা কী? অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
একে মোকাবিলার জন্য এটার গোড়ায় যেতে হবে। গোড়া মানে কারণটা কীভাবে তৈরি হয়েছে? সমাজের পলিটিক্যাল এলিয়েনেশন, যে বিচ্ছিন্নতা সেটা দূরীভূত করার উদ্যোগ নিতে হবে। সেজন্য বলছি, নেতৃত্বের ভার রাষ্ট্রের হাতে। এর পর্যায়ে আমি শুধু এতটুকুই বলব, আমি যে অধ্যায়টা আওড়ালাম, সেটি ফরাসি বিপ্লবের যে ১৭টি দাবি ছিল, সেগুলোর মধ্যে দুই নম্বরটি। তিন নম্বরটি হলো, সভরেনটি বা স্বার্বভৌমত্বে সর্বোচ্চ ক্ষমতাটি কার? এটা শুধু জাতির, কোন ব্যক্তির নয়। সভরেনটি বিলংস টু দ্য নেশন। তাহলে আইনগত কর্তৃত্ব কার হাতে থাকবে? জনগণের দেওয়া, স্পষ্টভাবে দেওয়া, পরিষ্কারভাবে দেওয়া ক্ষমতা যার হাতে শুধু সেই এটা প্রয়োগ করতে পারে। অর্থাৎ, এক্সপ্রেসলি ইমেনেটিং ফ্রম দ্য ন্যাশন, তারাই এখানে অথরিটি ব্যবহার করতে পারে। আমাদের এখানে সংকটটা এখানেই। ফরাসি বিপ্লবের আগে, যেসব রাজনীতিতে রাজাদের কর্তৃত্ব ছিল, তাঁরা মনে করতেন রাজাই সভরেইন। ফরাসি একজন রাজার বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘রাষ্ট্র কে? সে তো আমি’, ফরাসি ভাষায়- ‘লে তা সে মোয়া’, আমরা এখন বলি কোনো ব্যক্তি এটা বলতে পারে না। রাষ্ট্র মানে হচ্ছে গোটা জাতি, গোটা জাতি যাকে আইনসিদ্ধ উপায়ে কর্তৃত্ব দিবে, তিনিই কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারবেন।
আমি মনে করি, শেষ পর্যন্ত আমাদের ওখানে ফিরতে হবে এবং সে জায়গাটিতে যদি আইনসিদ্ধ কর্তৃত্বে কোনো প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলে সবচেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে সেটার মীমাংসা করা এবং সেটার মীমাংসা করলে আমি মনে করি, আমাদের যে রাজনৈতিক সংকট তার অর্ধেকটা এমনিতেই কমে যাবে। এর মানে তখন সমাজ এবং রাষ্ট্র মিলিতভাবে এটার প্রতিরোধ করতে পারবে। আমাদের সংকটটা হচ্ছে এই জায়গাতেই।
আজকে দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিও প্রচারিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বিএনপি পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ মারার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে এখন গুপ্তহত্যার আশ্রয় নিয়েছে। এখানে বিএনপিকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিএনপির তরফ থেকে একজন নেতা তাঁদের বলেছেন, বিরোধী দলীয় নেতার প্রতিনিধি হিসেবে, যে একটি সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন। এই ডাকার মধ্যে তো কোনো অন্যায় নেই। কিন্তু আপনি যদি মনে করেন, সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে, তাহলে আপনি ডাকবেন কেন?
সমস্যা হচ্ছে বিএনপি এবং সরকার যদি মিলিতও হয় তবুও এ ধরনের সন্ত্রাস চলতে পারে। মানে এটা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু তাতে দেখা যায়, এই যে পেট্রলবোমার যে আক্রমণ শুরু হয়েছিল, ২০১৫-এর গোঁড়ার দিকে, সেটা এখন কমে গেছে কেন? এটাকে সরকার পক্ষের কেউ কেউ দাবি করছেন, এটা তাদের সাফল্য। আমি মনে করি, এই সাফল্যের যদি আরো উদাহরণ আপনি উপস্থাপন করতে চান, এক ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতার দরকার। কিন্তু রাজনৈতিক সমঝোতার পরও যা থেকে যাবে তা হলো আইনগত সমস্যা। সেটার সমাধান তখন একসাথে করা যাবে।
বর্তমানে আমি একটি দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলি, আজকে সব পত্রিকার হেডলাইনে দেখলাম যে, দীপন নিহত হয়েছে, সেখানে তাকে অভিজিতের বন্ধু বা অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক, এভাবে বলা হয়েছে, দীপনের বাবা যেভাবে বলেছেন। একটি পত্রিকা হেডলাইন দিয়েছেন ব্লগার দীপনকে হত্যা। অর্থাৎ দীপনের পরিচয়টা যুগান্তর পত্রিকায় লিখেছে দীপন ব্লগার। দীপন ব্লগার হতেই পারে। কিন্তু তার অন্য পরিচয় প্রকাশকও লিখেছেন সবাই। একজন মানুষের অনেক পরিচয় থাকে। আপনি কোনটাকে বড় করছেন? আমি মনে করি এখানে একটি কথা পরিষ্কার বলা দরকার, আমাদের সমাজের দিক থেকে এই জিনিসটা পরিষ্কার হচ্ছে না। সবাই বলছে মুক্তমনা ব্লগারদের হত্যা করা হচ্ছে। আমেরিকানরাও সেজন্য বিবৃতি দিচ্ছে। অন্যান্য দেশও বিবৃতি দিচ্ছে। সেই বিবৃতি দেওয়াকে আমরা যদিও বা স্বাগত জানাব, তবুও বলব যে এর মধ্যে ব্যাখ্যার একটা ভাব আছে। এর প্রথমত আমাদের নাগরিক। তারা যদি অপরাধ করে থাকে রাষ্ট্র তাদের বিচার করবে। এটাই হচ্ছে আইনসম্মত পদ্ধতি। যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের আস্থা আছে। রাষ্ট্রের কাছে বিচার প্রর্থনা করতে হবে। রাষ্ট্র যদি তাদের বিচার না চায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে। কিন্তু আমরা আইন নিজের হাতে কেউ তুলে নিতে পারি না। এটা আইনশুদ্ধ অধিকার নয়। সুতরাং এ হত্যাকাণ্ডে যে বা যারা জড়িত হচ্ছেন, তারা আসলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে।
এখন রাষ্ট্র যদি মনে করেন বিদেশি হত্যা করলে আমি তার দ্রুত ব্যবস্থা নেব। ঐ যে সৌদি আরবের এক কূটনীতিক নিহত হয়েছেন, সেটার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছেন। বিচারের রায়ে আমরা বুঝতে পারছি সেটা একটা সাধারণ ছিনতাইয়ের ঘটনা ছিল। এখন যে দুই বিদেশির ঘটনা ঘটেছে তাঁরাও আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ ব্যক্তি। ভাগ্যচক্রে সেখানে পড়ে গেছেন তাঁরা। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত কারো ক্ষোভ আছে এখন পর্যন্ত কেউ বলেনি। সেজন্য বলছি নেহায়েত ভাগ্যের ফেরে পড়ে তাঁরা নিহত হয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশের যে নাগরিকরা, যাঁরা লেখক, প্রকাশক, যুবক, যাঁরা আক্রমণের স্বীকার হচ্ছেন, তাঁদের একটা বিশেষ পরিচয় আছে। তাঁরা লেখক, তাঁরা প্রকাশক। ব্লগার কথাটি আমি ব্যবহার করতে চাই না। এটা হচ্ছে লেখার একটি মাধ্যম মাত্র। সাংবাদিকও লেখক, উপন্যাসের লেখকও লেখক। কিন্তু লেখার মাধ্যমটা একটু বদলেছে। আগে লোকে পুঁথি লিখত, ওইগুলোকে আমরা পাণ্ডুলিপি বলতাম। পাকিস্তান আমলে অনেক পণ্ডিত এর নাম দিয়েছিল কলমিপুথি। এগুলোকে তারা পাণ্ডলিপি বলবে না। মুসলমানের শব্দ বলবে না তারা। আহমেদ শরীফ যেখানে পাণ্ডুলিপি লিখতেন, সেখানে অধ্যাপক আলী আহমেদ লিখতেন কলমিপুথি। শাহজাহান মিয়ার বইতেও দেখবেন লেখা কলমিপুথি।
যাইহোক। আসল কথাটি এবার বলি। একটা সমস্যা আমাদের সমাজে রয়েছে। সেটি হচ্ছে আমাদের আলেম সমাজ। রাজনীতিতে তারা একটি ভূমিকা পালন করেছে। আলেমদের দুটি বড় সংগঠন ছিল। একটা হলো তবলিগ জামাত, আরেকটা হলো জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, ১৯২১ সালের দিকে তারা কিন্তু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করছিলেন, পাকিস্তান তাঁরা সমর্থন করেননি। ১৯৪১ সালের জামায়াতে ইসলামী, মাওলানা মওদুদির, তারাও কিন্তু পাকিস্তানকে সমর্থন করেননি। পাকিস্তান হওয়ার পর তাঁরা মত বদলেছিলেন এবং পাকিস্তানে অংশ নিয়েছিলেন। আমি কথাটি এ জন্য বলতে চাচ্ছি, আমাদের আলেম সমাজের একটি ভূমিকা আছে। সম্প্রতি আমি একটু অবাক হলেও ড. জাফরউল্লাহ চৌধুরীর গণবিশ্ববিদ্যালয়, তারা একটা সেমিনার করার জন্য চেষ্টা করছেন। সেটা হচ্ছে যে- ‘রাজনীতিতে আলেম সমাজের ভূমিকা’। আমি একটি বিশ্বস্ত সূত্রের খবর পেয়েছি। একটা বইয়ের ওপর ভিত্তি করে তাঁরা আলোচনাটি করবেন। খুবই ভালো কথা। আলেম সমাজের এখানে একটি ভূমিকা আছে। আপনারা এই মুক্তমনা ব্লগারের নামে, ইংরেজি শিক্ষিত বা বিজ্ঞান শিক্ষিত বনাম মাদ্রাসার ছাত্র বা আলেম সমাজ- এই বিরোধটা আমাদের জন্য শুভ নয়। আমি বরং অনুরোধ করব, ভেবে দেখতে বলব, আমাদের বন্ধুদের, আলেম সমাজে যারা চিন্তাশীল আছেন তাদেরও বলব, এটা আপনাদেরও ভেবে দেখতে হবে- বলতে হবে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, হত্যার বিরুদ্ধে আলেম সমাজ। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, হত্যার বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজ। এটা বললে দোষ কী? মুসলিম বলিয়া তো লজ্জা নাই। হায়াৎ মাহমুদ একটি বইতে লিখেছেন, ‘বাঙালী বলিয়া তো লজ্জা নাই।’ এই কথা ধার করেই বলছি- মুসলিম বলিয়া তো লজ্জা নাই। আমি মুসলিম বলে গৌরববোধ করি কি না। বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ইকবাল আহমেদ, পাকিস্তানের, ১৯৯৯ সালে মারা গেছেন, ইসলামাবাদের একটি হাসপাতালে হার্ট অপারেশন হওয়ার পর। তখন তাঁর মৃত্যুর সময় আত্মীয়স্বজনরা এসে কুরআন পাঠ করছিলেন, তখন তাঁর এক ধর্ম নিরপেক্ষ বন্ধু বললেন, আপনি ওটা বন্ধ করতে বলেন। এই বন্ধুর নাম পারভেজ, রাওয়ালপিন্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক। তিনি ইকবালের ভাতিজাও হন। তাঁকে ইকবাল বললেন, পারভেজ আই অ্যাম এ মুসলিম এবং এই বলে তিনি মারা যান। উনি বলেছেন, আমি যে সংগ্রাম করেছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে এবং লাদেনদের বিরুদ্ধে, করেছি মুসলিম বলেই। এই কথাটির ওপর আমি গুরুত্ব দিতে চাই।