সংবিধান দিবস
সংবিধানের সংশোধন ও সমালোচনা
পঞ্চদশ সংশোধনীর ফলে আমাদের সংবিধানের যে চেহারা দাঁড়িয়েছে, সেটি কোনো নেতিবাচক শব্দে ব্যাখ্যা করলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
কেননা, পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় একটি নতুন অনুচ্ছেদ (৭ক) যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে : (১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়— (ক) এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে—তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।
(২) কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত—
(ক) কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উসকানি প্রদান করিলে; কিংবা
(খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে।
(৩) এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।
এটা বুঝে নেওয়া সংগত যে, এই অনুচ্ছেদটি যুক্ত করা হয়েছে সামরিক শাসনকে নিরুৎসাহিত করতে। অর্থাৎ কোনো সামরিক জান্তা যাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার সাহস না পায়, সে জন্য। যে কারণে বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়’।
এখন প্রশ্ন হলো, নাগরিক হিসেবে যদি আমি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সমালোচনা করি, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী হিসেবে যদি আমি সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহ এবং রাষ্ট্রধর্মের সমালোচনা করি এবং যদি বলি যে, সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা রেখে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে উল্লেখ সাংঘর্ষিক, তাহলে আমার এই অবস্থান কি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মধ্যে পড়বে?
কেননা এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে তাহা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে। এখন কোনো নাগরিকের এ ধরনের সমালোচনাকে সরকার যদি সংবিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করার উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে সেই নাগরিকের রক্ষাকবচ কী? যদি রক্ষাকবচ না থাকে, তাহলে এই অপরাধের দায়ে প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। বাংলাদেশের আইনে সর্বোচ্চ দণ্ড হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।
সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা দান করা হইল।
কিন্তু কী করলে আদালত অবমাননা হবে অথবা হবে না, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো বিধান নেই। বিদেশি কোনো রাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করে বা করার উদ্যোগ নেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কিছু বললে সেটি সংবিধানের এই বিধানের লঙ্ঘন হবে কি না, সেটিও প্রশ্ন।
আবার মানহানির বিষয়টি খুবই আপেক্ষিক এবং এটি ক্ষমতাবানরা বরাবরই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন।
২.
একটি রাষ্ট্র কীভাবে চলবে, তার গঠন-প্রকৃতি কী হবে, সেখানে নাগরিকের অধিকার কতটুকু থাকবে এবং সর্বোপরি সেই রাষ্ট্রের জনগণ কতটা গণতন্ত্র ভোগ করবেন, তা নির্ভর করে ওই রাষ্ট্রের সংবিধান কতটা গণতান্ত্রিক, তার ওপর।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পরে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান। ফলে ওই দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি মহান দিবস।
কিন্তু এর পরে এযাবৎ সংবিধানে মোট ১৬ বার সংশোধনী আনা হয়েছে। এর মধ্যে কখনো কখনো সংশোধনীর নামে মূলত একে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে, স্বাধীনতার মূল চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং এগুলো করা হয়েছে বস্তুত গদি রক্ষার স্বার্থে।
সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র। জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কীভাবে গঠন করা হবে বা হয়েছে, তার দলিল। এটি দেশের সর্বোচ্চ আইন। আরো সহজ করে বললে সংবিধান হচ্ছে সেই দলিল, যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নিয়ম ও সূত্র লিপিবদ্ধ থাকে। সংবিধানে নাগরিকের যেই অধিকারের কথা বলা আছে, রাষ্ট্র যদি সেই অধিকার থেকে কোনো নাগরিককে বঞ্চিত করে, তাহলে সে আদালতের কাছে অভিযোগ করতে পারে। অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সেসব অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য, যা ওই দেশের সংবিধানে লিপিবদ্ধ আছে।
১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। এ আদেশবলে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতির পরিবর্তে মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। এর পর ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ আদেশবলে গণপরিষদের গঠন এবং কার্যপ্রণালি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়।
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। পরদিন ১১ এপ্রিল তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি করা হয়। একই বছরের ১৭ এপ্রিল থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত এই কমিটি বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করে। জনগণের কাছ থেকেও মতামত আহ্বান করা হয়। সংগৃহীত মতামত থেকে ৯৮টি সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর ড. কামাল হোসেন সংবিধান বিল গণপরিষদে উত্থাপন করেন। খসড়া সংবিধানের প্রথম পাঠ শুরু হয় ১৯ অক্টোবর এবং তা ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। দ্বিতীয় পাঠ শুরু হয় ৪ নভেম্বর এবং ৬৫টি সংশোধনীসহ ওই দিনই তা সংসদের অনুমোদন লাভ করে। এর পর ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে সংবিধান কার্যকর হয়।
৩.
আমাদের পূর্বপুরুষ ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করেন, সেখানে একটি গণতান্ত্রিক এবং সব মত-জাতি ও ধর্মের মানুষের জন্য একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণেরই প্রত্যয় ছিল। যদিও বিশেষজ্ঞদের অনেকে এমনটাও মনে করেন যে, বাহাত্তরের মূল সংবিধানে যে চারটি মূলনীতি (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) ছিল, তার মধ্যে কেবল ‘গণতন্ত্র’ই যথেষ্ট।
কিন্তু দেখা গেল, জিয়াউর রহমানের সরকার পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সেই মূলনীতিও পরিবর্তন করে। এর পর আরেক সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ আরো এক ধাপ এগিয়ে সংবিধানে যুক্ত করেন রাষ্ট্রধর্ম।
এর আগে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমেও সংবিধানে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। আর ২০১০ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এখানে আমূল পরিবর্তন আনা হয়। এই সংশোধনীর সবচেয়ে বড় দিক হলো, এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানের মূল চেতনা তথা চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু সে সঙ্গে এই সংশোধনীর মাধ্যমে আরো এমন কিছু বিধান যুক্ত ও বিযুক্ত করা হয়, যা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করা নিয়ে যে রাজনৈতিক জটিলতার শুরু হয়েছে, বলা যায় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণও সেটি।
এভাবে নানা সময়েই সরকারগুলো সংবিধান সংশোধন করেছে। কিন্তু এই সংশোধন কতটা জনস্বার্থে আর কতটা নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, সে প্রশ্নের উত্তর সচেতন নাগরিকমাত্রই আন্দাজ করতে পারেন।
বারবার সংবিধানকে এ রকম পরিবর্তন ও কাটাছেঁড়ার মধ্য দিয়ে নাগরিকরা আসলে কী পেয়েছে? এসব সংশোধনীর ফলে কি আমাদের সংবিধান আরো বেশি গণতান্ত্রিক হয়েছে, নাকি গণতন্ত্রবিচ্যুত হয়েছে, সে প্রশ্নও সংগত।
আমাদের সংবিধানের অনেক জায়গায় অসংগতি রয়েছে। সেসব অসংগতি দূর করার উদ্যোগ কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। তবে এ ক্ষেত্রে কিছুটা আশার আলো জ্বেলেছিল ২০১০ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী। কেননা, প্রথমবারের মতো ওই সংশোধনীর প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়েছিল দেশের নাগরিক প্রতিনিধিদের। দেশের বিচারপতি, আইনজ্ঞ, শিক্ষক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের জাতীয় সংসদ ভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংশোধনীর বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছিল ওই সংশোধনীর জন্য গঠিত বিশেষ কমিটি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিশিষ্টজনরা যেসব পরামর্শ কমিটিকে দিয়েছিলেন, তার অধিকাংশই গৃহীত হয়নি। ফলে প্রশ্ন ওঠে, ওই বৈঠকের কি আদৌ দরকার ছিল?
৪.
আমাদের রাজনীতিবিদরা, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা বরাবরই সংবিধানের দোহাই দেন। যেমন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আমরা অনেক করেছি, সংবিধানের মূল চেতনায় আমরা উদ্বুদ্ধ, সংবিধানের বাইরে একচুলও যাওয়ার সুযোগ নেই… ইত্যাদি গালভরা বুলি শুনে নাগরিকরা অভ্যস্ত।
কিন্তু ১৫৩টি অনুচ্ছেদসংবলিত আমাদের দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানকে আমরা কতটুকু গণতান্ত্রিক করতে পেরেছি, এ সংবিধান কতটুকু নাগরিকের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশেষ সংবিধানের অনেক জায়গায় অসংগতি রয়ে গেছে, যেগুলো নিয়ে কথা বলা দরকার। তবে সেই কথা বলার জন্য প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম এবং যে নির্ভয়ের সংস্কৃতি, যেখানে সবার মধ্যে সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা থাকবে।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও উপস্থাপক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।