বিশ্লেষণ
খাদের কিনারে বাংলাদেশ
গত কয়েক সপ্তাহে অসহিষ্ণুতার ফলে বাংলাদেশে খুন-খারাবির হার ভীতিকর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ঢাকায় ইতালির নাগরিক তাভেলার হত্যার মধ্য দিয়ে এটি শুরু হয়। এর ঠিক কয়েক দিন পরই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিভাগীয় শহর রংপুরে খুন করা হয় জাপানি নাগরিক হোশিও কুনিকে। এর পর পবিত্র আশুরা উপলক্ষে ২৪ অক্টোবর শিয়াদের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় কয়েক দফায় বোমা নিক্ষেপ করা হয়। অনেকে আহত হন। নিহত হয় ১৬ বছরের যুবক সাজ্জাদ হোসেন সঞ্জু।
এবং গত সপ্তাহে দুটি পৃথক হামলায় দুজন প্রকাশক এবং দুজন ব্লগারের ওপর মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্বৃত্তরা। একজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন, অন্যরা শঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন।
সম্প্রতি হামলাগুলো চলতি বছরের শুরুর দিকে পাঁচজন মুক্তমনা ব্লগার এবং আন্দোলনকর্মী—রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় ও নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় হত্যার অমীমাংসিত ঘটনার কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। হামলার শিকার হওয়া আহমেদ রশীদ টুটুল ও ফয়সল আরেফিন দীপন ছিলেন অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক। সম্প্রতি হামলার ধরন দেখে আমাদের গা শিউরে উঠেছে। খুনিরা আক্রান্তদের অফিসকক্ষে প্রবেশ করে চাপাতি দিয়ে মাথা ও কাঁধে কুপিয়ে কক্ষের দরজা আটকে রেখে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছে। নিশ্চিত করতে চেয়েছে যেন আক্রান্ত ব্যক্তি রক্তপাত হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
চেসারে তাভেলার মৃত্যুর পরপরই এসব খুনের পেছনে কারা জড়িত, তা নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি মহল এবং বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দাবি করছে, বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের সদস্য থাকার পর্যাপ্ত প্রমাণাদি সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বারবার বলে আসছে, আক্রমণটা দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থান থেকে হচ্ছে। তাদের অভিযোগ, ধর্মীয় মৌলবাদীরা বিরোধী দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে। এর সঙ্গে দেশের বাইরের কোনো জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা নেই। এটা সত্য যে, দেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা মৌলবাদী উগ্রপন্থীরাই অতীতকালে দেশে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা পূর্বপ্রমাণিত।
এ ধরনের আক্রমণ যত বাড়বে, সরকারের এই অবস্থান তত প্রশ্নবিদ্ধ হবে। গত সপ্তাহের পর আরো একজন প্রকাশককে হত্যা-হুমকি দেওয়া হয়েছে। অথচ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, যেকোনো দেশেই ঘটতে পারে।
এ ধরনের উদাসীনতার মুখে আমরা হাল ছেড়ে দিয়ে কেবলই বলতে পারি, আমরা চরমপন্থী এবং রাষ্ট্রের মাঝখানে পড়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। কিন্তু আমরা অনেক কিছু পারি এবং করা উচিতও।
প্রথমত, বাংলাদেশি জনগণকে জানতে হবে, যে আদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে আদর্শ আমরা এখনো ধারণ করি কি-না। হ্যাঁ, এটা ঠিক, বাংলাদেশ হলো ঐতিহ্যগতভাবে নানা মত ও বিশ্বাসের সমন্বিত একটি দেশ। এখানে ইসলামের সৌহার্দ্য ও সহিষ্ণু সংস্করণ অনুসরণ করা হয়। নিশ্চিত করেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত ভিন্নতার মধ্য থেকেই। হ্যাঁ, আমাদের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ; এবং হ্যাঁ, প্রতি জাতীয় নির্বাচনে আমরা ধর্মীয় আইন নয়, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে ভোট প্রদান করে এসেছি।
কিন্তু হালের পরিস্থিতি থেকে মনে হচ্ছে, আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগত অবস্থান থেকে সরে এসেছি। আমরা আর হয়তো বলতে পারব না যে, আমরা সহিষ্ণু এবং ধর্মনিরেপক্ষ। এখন সময় হয়েছে, স্বীকার করে নেওয়ার, বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা চরমভাবে খর্ব হচ্ছে। এর জন্য রাষ্ট্র, জনগণ এবং দেশ বা দেশের বাইরে যেসব প্রগতিশীল সংগঠন আছে, তারা সবাই কমবেশি দায়ী।
কয়েকটি বাস্তবতা আমাদের ভেবে দেখা উচিত, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ, সেটি এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশে। এর প্রধান কারণ হলো, প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য, বিদ্যমান হিন্দুবিরোধী মানসিকতা এবং রাজনৈতিক ঔদাসীন্য। যেখানে আমরা সকলে মনে করছি যে, আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করছি, সেখানে চট্টগ্রামে সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বাস্তুভিটা দখল করে নিচ্ছে বাঙালি অধিবাসীরা। এসব ঘটছে সেনাবাহিনীর চোখের সামনেই। ২০০৪ সালে, একটি স্বীকৃত ইসলামিক গোষ্ঠীর আন্দোলনের মুখে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় আহমদিয়ার প্রকাশনা সংস্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। যদিও সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু আন্দোলন হয়েছিল, তবে সাধারণ জনগণ এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারের বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করেছে।
এত কিছুর পরও আমাদের বহুজাতিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এখনো টিকে আছে। এ বছর হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে ধুমধাম করে পালন করেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। মন্দিরে কিছু বিচ্ছিন্ন হামলার পরও হাজার হাজার মানুষ দেবী বিসর্জনে রাজপথে নেমে এসেছে। রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর তীর এবং পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে দেবীভক্তদের ঢেউ নেমেছে। আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আমাদের সংস্কৃতির সহজাত বৈচিত্র্যকে। এর কিছুদিন পরেই আবার শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে বর্বর আক্রমণ আমাদের সব ঐতিহ্যকে লীন করে দেয়।
সব সময় দেখা যায়, কেউ হয়তো অন্যজনকে জিজ্ঞেস করছে, সে ইসলামের যে সংস্করণ অনুসরণ করছে, সেটি ঠিক কি না। ব্লগারদের ওপর হামলা শুরু হওয়ার পর জনগণ তার নিন্দা জানিয়েছে, পরমূহূর্তেই অবস্থান পরিবর্তন করে বলেছে, ব্লগাররাও তো ধর্মের অবমাননা করেছে। এটা তখনই ঘটে যখন আমরা সংখ্যালঘুদের প্রতি যে প্রচলিত বৈষম্য সেটিকে গ্রহণ করি—সেটি হতে পারে হিন্দু, শিয়া অথবা কোনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী।
যারা আমাদের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে থেকে হুমকি দিয়ে আসছে, তারা সেই ধারাকে ভিত্তি হিসেবে নিয়েছে, যেটি আমাদের জনগণ সহ্য করে নিয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে অনুমোদনও দিয়েছে। বিদেশি নাগরিক এবং মুক্তচর্চার মানুষের ওপর আক্রমণ প্রমাণ করে, দেশটা রক্ষণশীল ইসলামিক জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ হয়ে উঠছে। যদি আমরা এটা মানিয়ে নিতে চাই, তবে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে intolerance begins at home, অর্থাৎ অসহিষ্ণুতা ঘর থেকেই শুরু হয়।
লেখক : প্রবাসী বাংলাদেশি কথাসাহিত্যিক।
(৪ নভেম্বর-২০১৫ তারিখে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তাহমিমা আনামের এই কলামটি বঙ্গানুবাদ করেছেন মোজাফ্ফর হোসেন।)