আমে-দুধে মিশে যাবেই, আঁটি গড়াগড়ি খাবেই
এমনটা যে হবে আমি জানতাম। একসময় সবই ঠিক হবে। এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, এফবিসিসিআই, আড়তদার, ট্যানারি মালিক—সবাই সক্রিয়, সবাই মাঠে। দেশের চামড়াশিল্পকে বাঁচাতে হবে। অবশ্যই বাঁচাতে হবে। কিন্তু ভাইয়েরা আমার, ঈদের সময় আপনারা কোথায় ছিলেন? সিন্ডিকেট করে যখন এতিমের হক মেরে দেওয়া হলো, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? এখন তো মনে হচ্ছে, আপনারা সবাই এই অশুভ চামড়া সিন্ডিকেটের সদস্য। আপনারা অপেক্ষায় ছিলেন, গরিব-এতিমদের রিজিক মারা শেষ হলে মাঠে নামবেন। এখন আপানারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে বসে উত্তপ্ত ঝগড়া করেন, সাজানো আপস করবেন; তাতে এতিমদের কিচ্ছু যায় আসে না।
এবার চামড়া নিয়ে যা হলো, তা নজিরবিহীন হলেও আমার কাছে কেন যেন মনে হচ্ছে এটা পূর্বপরিকল্পিত। কারণ, চামড়া বিপর্যয়ের জন্য যে কারণগুলোকে দায়ী করা হচ্ছে, তার একটিও নতুন নয়, সবই সবার জানা এবং পুরোনো। আড়তদারদের দাবি, ট্যানারি মালিকরা তাদের এবার চামড়া কেনার জন্য টাকা তো দেনইনি, আগের বকেয়া টাকাও দেননি। তাই হাতে টাকা ছিল না বলে তারা চামড়া কিনতে পারেননি। এটাই আসল কারণ, আড়তদাররা চামড়া কেনার ব্যাপারে কম আগ্রহ দেখিয়েছে বলেই চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। আড়তদারদের দাবি মিথ্যা নয়। আসলে ট্যানারি মালিকরা চামড়া কেনার জন্য আড়তদারদের টাকা দেয়নি। ট্যানারি মালিকদের দাবি, তাদের হাতেও টাকা নেই। হাজারীবাগ থেকে সাভার গিয়ে তারা সব টাকা বিনিয়োগ করে ফেলেছেন। আর ব্যাংক তাদের চামড়া কেনার টাকা দেয়নি। বাহ, কী চমৎকার। ট্যানারি মালিক এবং আড়তদাররা বংশপরম্পরায় ব্যবসা করছেন, কিন্তু পুরোটাই হাওয়ার ওপর। তাদের ব্যবসার সবচেয়ে বড় মৌসুম।
অথচ সবাই ব্যবসা করতে মাঠে নেমেছেন শূন্য হাতে। আমার ধারণা, আড়তদাররা ট্যানারি মালিকদের শিক্ষা দিতে চামড়া নিয়ে এই প্রহসনটা করেছে। আর ট্যানারি মালিকরা সরকারকে শিক্ষা দিতে চেয়েছে। দুই পক্ষের এই শিক্ষা শিক্ষা খেলায় জন্মের শিক্ষা হয়েছে এতিমদের। সারা বছর যারা এই কোরবনির ঈদের আশায় বসে থাকে। আসলে ঈদ নয়, এতিমরা বসে থাকে কোরবানির চামড়ার আশায়। চামড়ার বাজার ভালো থাকলে তাদের মুখে হাসি ফোটে। কিন্তু সরকারের উদাসীনতা এবং আড়তদার আর ট্যানারি মালিকদের টানাহেঁচড়া তাদের সেই হাসি কেড়ে নিয়েছে। ঈদের সময় ঘুমিয়ে থাকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও জেগেছে। ট্যানারি মালিকদের শিক্ষা দিতে আড়তদাররা এবার তাদের কাছে চামড়া বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
রোববার সচিবালয়ে এক মধ্যস্থতা বৈঠকে সে সিদ্ধান্ত থেকে তারা সরে এসেছে। শর্ত হলো, ট্যানারি মালিকরা নগদ টাকায় এবারের চামড়া কিনবে। আর বকেয়া আদায় করে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে এফবিসিসিআই। আগামী ২২ আগস্ট পরবর্তী বৈঠকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। আর ট্যানারি মালিকরা যাতে নগদ টাকায় চামড়া কিনতে পারে, সে জন্য ব্যাংক লোনেরও ব্যবস্থা হচ্ছে। তার মানে সবার সব দাবি-আবদার মানা হচ্ছে, মাঝখান থেকে মুছে গেল এতিমদের মুখের হাসি। একেই বলে আমে-দুধে মিশে যাওয়া। আর আঁটির চিরকপাল গড়াগড়ি খাওয়ার। তাই খাচ্ছে। আড়তদারদের টাকা আদায় করে দেবে এফবিসিসিআই। ট্যানারি মালিকরা ব্যাংক থেকে লোন পাবে। কিন্তু সেই মৌসুমি ব্যবসায়ী আর এতিমদের পাশে কেউ নেই। তাদের যে ক্ষতি, তা পুষিয়ে দেওয়ার জন্য কেউ নেই। যে আড়তদাররা টাকা নেই বলে হাহাকার করেছে, সেই আড়তদাররা নিশ্চয়ই এখন গোপনে পার্টি দিচ্ছে। কারণ ২০০ টাকায় কেনা চামড়া এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিক্রি করবে ১২০০ টাকায়। লাভই লাভ। এবার চামড়ার দাম ঠিক করে দিয়ে দায়িত্ব সেরেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাদের উদাসীনতা আর নিষ্ক্রিয়তায় সবার সামনে লুটপাটটা হয়ে গেল। কিন্তু ভেজাল লাগিয়ে দিয়ে বাণ্যিজ্যমন্ত্রী ব্রাজিলে। আমি বুঝি না, দেশের এত সমস্যা ফেলে মন্ত্রীদের এত বিদেশে যেতে হয় কেন। ডেঙ্গু যখন পিকে, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী পারিবারিক সফরে মালয়েশিয়া চলে গিয়েছিলেন। পরে সমালোচনার মুখে সফর ফেলে ফিরেও এসেছেন।
এখন দেশজুড়ে যখন চামড়া নিয়ে হাহাকার, তখন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ব্রাজিলে। তাঁর বদলে সমস্যা সমাধান করতে এলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। অবশ্য সমস্যা যা হওয়ার তা হয়েছে ঈদের দিনে। এখন আর কোনো সমস্যা নেই, এখন তো সব ফ্রেন্ডলি ফায়ার, কী মেটাবেন। তাও শিল্পমন্ত্রী নিলেন পুরোনো কৌশল—অস্বীকার প্রবণতা। তার দাবি আবহাওয়ার কারণে এবার হাজার দশের চামড়া নষ্ট হয়েছে। গতবারও নাকি হয়েছিল পাঁচ হাজারের মতো। তার দাবি, এটা মোট চামড়ার দশমিক শূন্য ৫ ভাগ। অথচ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টিতে এবার অর্ধেকের বেশি চামড়া নষ্ট হয়েছে, যার বাজারমূল্য ২৪২ কোটি টাকা। চট্টগ্রামে চামড়া পুঁতে ফেলার কথা বলে হলে শিল্পমন্ত্রী নির্বিকারভাবে বলে দিলেন, সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে বিএনপি চামড়া কিনে পুঁতে ফেলেছে। এটা শুনে আসলে তব্দা খেয়ে গেছি। একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী যদি এমন কথা বলতে পারেন, তাহলে চামড়া নিয়ে আর কিছু লেখা বা বলার মতো রুচি আমার নেই। খালি একটা কথা বলি, মাননীয় মন্ত্রীরা ভয় দূর করুন, একটু সাহসী হোন। অস্বীকার না করে, পালিয়ে না গিয়ে মোকাবিলা করুন। ১৩ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা, চেয়ারপারসন কারাগারে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে পলাতক, যাদের নেতাকর্মীদের মনোবল শূন্য; এমন একটা দলকেও যদি আপনারা এখনো ভয় পান; তাহলে দেশ চালাবেন কীভাবে। বিএনপি চামড়া কিনে পুঁতে ফেলে সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষতি করল আর আপনারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমালেন?
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।