বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?
আমাদের দেশের সরকারি বেসরকারি শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কি বিশ্বমানের গবেষণা হচ্ছে ? হয়ত হচ্ছে তবে তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নিরিখে আজকাল খুব একটা পাত্তা পাচ্ছে না। বৈশ্বিক জরিপে হাজারতম সিরিয়ালেও আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। নতুন কিছুর সন্ধানে রাষ্ট্র এখানে খুব আশা নিয়ে জনগণের করে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু সেই বরাদ্দ এদিক সেদিক তাইরে নাইরে করে কোন সুদূরের হাওয়ায় মিলিয়ে যায় তার আর খবর থাকে না। বঙ্গজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনকার গবেষণার বিষয়বস্তু বরং হতে পারে এটাই –অর্থের সাথে অনাচারের কেন এত সখ্য। এবং এটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু হতে পারে।
উন্নয়ন ও দুর্নীতি সমার্থক শব্দ নয়। উন্নয়নের সাথে সেবা, সুখ ও স্থিতিশীলতারই মেলবন্ধন হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের এখানে যা ঘটবার নয় তাই ঘটে চলে অবিরাম। শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণার সংখ্যা ও মান, সাইটেশন বা গবেষণার উদ্ধৃতি, গবেষণা থেকে আয় এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বা সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্ষরিক অর্থেই বৈশ্বিক শিক্ষায়তন হয়ে ওঠবার জন্য এসব মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়াটা সবচে’ জরুরি। পক্ষান্তরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আধিকারিকদের উদ্দেশ্য বিধেয় এখন একটাই ওপর থেকে টাকা আনো আর ভাগাভাগিটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাও। এইসময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যেন এর সবিশেষ উদাহরণ হয়ে ওঠেছে।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়েছে। মূলত দুটি কারণে এসব কাজ ঘিরে চরম বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, ‘পূর্ণাঙ্গ মহাপরিকল্পনা’ ছাড়াই এসব উন্নয়নকাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের ক্ষতি করা হচ্ছে বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অভিযোগ করেছে। দ্বিতীয়ত, উপাচার্য ফারজানা ইসলামের মধ্যস্থতায় ছাত্রলীগের নেতাদের বড় অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। এ অভিযোগ প্রকাশের পর ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ –এই ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ আন্দোলন শুরু করে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগেও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগরসহ অনেক আন্দোলন হয়েছে। বরাবর সত্যের পক্ষের শক্তিই তাতে জয়লাভ করেছে। কিন্তু এবারকার ঘটনা একেবারেই ভিন্নতর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ অন্যায় অর্থ বণ্টনে তিনি তার স্বামী ও সন্তানকেও কাজে লাগিয়েছেন। এই অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাই করা এই ডিজিটাল যুগে খুবই সহজ কাজ। রাষ্ট্র চাইলে তা নিমিষেই করতে পারে। আমরাও বিশ্বাস করি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী কোনো বিষয়েই অনবগত থাকেন না। অভিযোগ যেহেতু ওঠেছে এবং এই নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিত ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠছে, শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে –এমন একটা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তাঁর দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার আর কি নৈতিক ভিত্তি থাকতে পারে?
দেশের অপপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা যদিও একই তবু আমরা চাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুদ্ধি অভিযান শুরু হোক। ভিসিকে কেন, কোন পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগকে অর্থের উপঢৌকন দিতে হলো, চাঁদার শাক দিয়ে দুর্নীতির মাছ ঢাকা হলো কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। দেড় হাজার কোটি টাকার বরাদ্দের নিয়ন্ত্রকগোষ্ঠী, ঠিকাদার ও প্রশাসনিক আধিকারিকদের সব কার্যক্রম পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করতে হবে। ভবিষ্যতের পথটা স্বচ্ছ রাখবার জন্যই তদন্তে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করাটা জরুরি। এবং ছাত্রলীগকে ফেয়ার রাজনীতির পথ ছেড়ে দিয়ে কেন ও কোন পরিোপ্রক্ষিতে অবৈধ অর্থগ্রহণ করে শিক্ষার্থী থাকাকালেই ভ্রষ্ট বড়লোকী ভাবচক্করে পড়ে গিয়ে অতল অন্ধকারে তলিয়ে যেতে হয় তারও তদন্ত জরুরি। সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির জন্যই এটা দরকার।
যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিকদের জানিয়ে দিয়েছেন ভিসির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু আমরা ঘটনার মোড় ভিন্নতরই দেখতে পাচ্ছি। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের যেসব নেতা অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছেন তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে এবং মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করারও অভিযোগ এসেছে।
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক আমির হোসেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারের শিক্ষক লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক রায়হান রাইন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা, একই বিভাগের অধ্যাপক তারেক রেজা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের মোবাইল সেবা বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে। এই ছয়জনের মধ্যে আমির হোসেন উপাচার্যবিরোধী, আর পাঁচজন শিক্ষক চলমান আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
আন্দোলনরত শিক্ষকরা এসব ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবিও জানিয়েছেন। আমরা যারা চাই আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বমানের ফলপ্রসূ গবেষণা ও নৈতিক মানদণ্ডে তার আপন মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখুক তাদের সবাইকে আন্দোলনতর শিক্ষকদের এসব ন্যায্য দাবির সঙ্গে একাত্মই থাকতে হবে। অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া সত্যকে আলোয় ফেরাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা সময়ের দাবি।
শুদ্ধি অভিযান শুরুর আগে আমাদের সবার আগে এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিত জানতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?
আমাদের টাকায় গবেষণা হোক, গ্রন্থাগার নির্মাণ হোক, পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক। যাতে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা বাংলার আলো বাতাস জলে বড় হওয়া ফজলুর রহমান খানের মতো বিশ্বজয়ী স্থপতি, সুবীর চৌধুরীর মতো কোয়ালিটি গুরু, ড. তাহেরের মতো রোবট বিপ্লবী, এম জাহিদ হাসানের মতো পদার্থবিজ্ঞানী এ দেশের গবেষণাগারেই বিশ্বমানের গবেষণা করতে পারেন।
অসাধুতার দায়ে টেনেহিঁচড়ে নামানো অতীত উপাচার্যদের নিয়তির সাথে দেশের প্রথম নারী উপাচার্য ফারজানা ইসলামের ললাটলিখন মিলে যাক—এটা আমরা চাই না। আমরা চাই উপাচার্যের পবিত্র জায়গাটি নিরপেক্ষতার পরাকাষ্ঠায় সমর্পণ করে সত্যিকারের তদন্তের সুযোগ সৃষ্টি যেন করা হয়। যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানমর্যাদার সাথে উপাচার্য পদটির আত্মসম্মানও অক্ষুণ্ণ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন হতে হবে। তবে সবার আগে দরকার বোধের উন্নয়ন।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন