আবরার হত্যাকাণ্ড
কক্ষ নম্বর ২০১১
আমরা সবাই এক ঘরে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি। মুখে কোনো উচ্চারণ নেই। চোখ খুলে রাখার দুঃসাহস নেই। অন্ধকার ঘরে বসে আছি। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না । নিজের নিঃশ্বাসও নিজের কাছে অপরিচিত । আমরা যে ঘরটিতে আছি তার চার দেয়াল রঙিন । মেঝেতে উচ্ছ্বাস, ছাদে আতশবাজি। এত ধামাকাতেও চুপসে বসে আছি আমরা। অথচ কত কথা ছিল আমাদের । কত কথা বলতে চেয়েছিলাম আমরা- সুন্দরবন সুন্দর থাকছে না । রামপালের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র দূষিত করবে নদী। মাদক পঙ্গু করে দিচ্ছে তারুণ্য। নদীখেকোরা হত্যা করছে একের পর এক নদী। সংসদ, রাজনীতি চলে যাচ্ছে বনিকদের দখলে। রাজনীতিতে তৃণমূল উপেক্ষিত। লুট হচ্ছে ব্যাংক। পাচার হচ্ছে টাকা। দেশের দক্ষ জনশক্তি থাকার পরও, ভারতীয় জনশক্তি আমদানি করে আনা হচ্ছে। দুর্নীতি সব দপ্তরে। শিক্ষা এখন শতভাগই বাণিজ্য। মান বলে কিছু নেই। শিক্ষকরা রাজনীতিকেই নিয়েছেন পেশা বলে। সব পেশাজীবীরা ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য জানাবার ইবাদতে ব্যস্ত। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দর কষাকষিতে পেরে উঠছে না বাংলাদেশ। হত্যা, ধর্ষণ, গণপিটুনি বাড়ছেই। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ নেই- এই যে এত কথা, আরো কত কথা বলার ছিল। কোনো কথাই বলতে পারিনি। আমাদের কি কেউ না করেছে কোন কথা বলতে? হয়তো বলেনি।
আমরা ভুল বুঝে এই ঘরে এসে বসে আছি। কোনো ভুল বাতাস হয়তো বলেছিল- কথা বলা যাবে না। মুখ বন্ধ। কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে না। চোখ বন্ধ করো। সেই রকম করেই আছি আমরা। আমরা ছিলাম একেকজন নানা ঘরে। নিজের মতো করেই হয়তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস হয়েছিল। তাই এই ঘরে এনে আমাদের আটকে রাখা হয়েছে। আমাদের ঘরের বাসিন্দা ছিল একজন। সে বুঝি এখন আর এই ঘরে নেই। দুদিন হয়ে গেল ওর প্রশ্বাসের ঘ্রাণ পাচ্ছি না। দুদিনে চার দেয়ালের উচ্ছ্বাস কেমন অসহনীয় ঠেকছে। ওই বাসিন্দার খবরটা জানা দরকার। ও যখন এই ঘরে ঢুকছিল, নাকি ওকে এনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন কতগুলো শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম- ছোট ফেনী নদী, ভারত, জল—এসব।
তারপর আর কিছু শুনতে পাইনি। তার মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। নিজে বন্ধ করল, নাকি বন্ধ করে দেওয়া হলো? আমরা যে ঘরটাতে আছি ঐ ঘরের নম্বর ২০১১। ওই ঘরে আমাদের সঙ্গের বাসিন্দার নাম ছিল ফাহাদ আবরার ।
ফাহাদ আবরারকে যারা স্তব্ধ করে দিয়েছে, তারা ওর সহপাঠী বা একই বিদ্যায়তনের শিক্ষার্থী। আবরার কোন মতাদর্শের ছিল সেটির সুলক সন্ধান অপ্রয়োজনীয়। কারণ রাষ্ট্রের স্বার্থ যখন প্রশ্নের মুখে পড়ে তখন যেকোনো মতের মানুষ এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার অধিকার রাখে, দায়িত্ব মনে করে প্রশ্ন করার। আবরার সেই কাজটি করেছিল । যারা তাকে হত্যা করল, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় এখন স্পষ্ট। ঐ রাজনৈতিক পরিচয়ের দূর অতীত বলছে, আবরারের মতো তারাও একই বিষয় নিয়ে তর্ক করতে পারত, নিজের কাছে , নিজ দলের কাছে প্রশ্ন রাখতে পারত। রাজনীতির শুদ্ধ অনুশীলনে তাই হতে পারত । কিন্তু রাজনীতি এখন আর সেই শুভ চিন্তার মধ্যে নেই । রাজনীতি এখন সহমতের । রাজনীতি এখন দুর্নীতির, ভাগবাটোয়ারার। রাজনীতি কেবলই এখন বন্দনা সংগীতের। চারদিকে বন্দনার সুর বইছে। এই সুর কেটে আবরার আচমকা কেন প্রশ্ন তুলবে? কথা বলবে? তাই তার শরীর অভিশপ্ত হলো নীল রঙে। স্তম্ভিত বাংলাদেশ। জেগে উঠল বাংলাদেশ। জেগে উঠবেই। কারণ বাংলাদেশ ভেবেছিল, তার জন্য দাঁড়ানোর মানুষের সবাই বুঝি সমাহিত। বাংলাদেশ যখন উত্তাল , তখনো বিদ্যায়তনের অভিভাবক, অর্থাৎ উপাচার্য দ্বিধায়, তিনি কোন পক্ষে যাবেন? ক্ষমতা না প্রতিবাদের? ২০১১ নম্বর রুম থেকে দেখলাম-পরাজিত তিনি প্রতিবাদের সামনে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন ।
আবরারকে যারা হত্যা করেছিল তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ছিল বলেই রাজনীতি নিষিদ্ধ বা বন্ধ করতে হবে এই দাবি আবেগের। ছাত্ররা রাজনীতি না করুক, রাজনীতিতে না আসুক এটিও ষড়যন্ত্রের অংশ। রাজনীতিতে অনুপ্রবেশকারীরা চায় না রাষ্ট্রে রাজনীতির শুদ্ধ অনুশীলন চলুক। তাই ২০১২ রুমে আমরা যারা আটক আছি, তাদের চোখ খুলে দিতে, মুখে প্রতিবাদের উচ্চারণ আনতে, বাংলাদেশকে ১৯৭১-এর চেতনায় অনির্বাণ রাখতে ছাত্র রাজনীতিই একমাত্র সমাধান । আবরারকে যারা হত্যা করেছে, তারা ভুল রাজনীতি, নষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা চক্রের উৎপাদন । তার দায় নেবে কে? আর শুধুই কি আবরার? দুই বছরে দেশে সাড়ে পাঁচশ মানুষকে যে হত্যা করা হলো, তাদের হন্তারক কারা? প্রায় সবাই কাছের মানুষ, স্বার্থের সংঘাতে দানব হয়ে উঠা। এই যে মানুষ দানব হয়ে উঠছে , তার দায় কিন্তু আদর্শের রাজনীতি থেকে কক্ষচ্যুত যারা তাদের। লোভ দানব উৎপাদন করে। সেই দানব কেড়ে নিলো আবরারকে। বাকি যারা ২০১১ নম্বর রুমে আছি, তাদের এখন দানবের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সময়।
লেখক : বার্তাপ্রধান, সময় টিভি।