আবরার হত্যাকাণ্ড
যে কারণে জাতিকে চরম মাশুল দিতে হবে
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে ছাত্রলীগের কতিপয় দুস্কৃতিকারী। গতকাল টেলিভিশন টকশোতে দেখছিলাম কিছু বিশেষজ্ঞ ছাত্রলীগের এই ঘটনাকেও পূর্বের কোনো ঘটনার দ্বারা ভারসাম্য করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু পূর্বের ঘটনার ভারসাম্য এই ঘটনাকে হালকা করে দেখার প্রবণতা কোনোভাবেই শুভ নয়। ধরেই নিলাম আগের কোনো ঘটনার বিচার হয়নি। কিংবা অপরাধীদের গ্রেপ্তার পর্যন্ত করা হয়নি। কিন্তু আবরার হত্যাকাণ্ডের আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে দ্রুত। এটি একটি শুভ লক্ষণ। এতেই কি আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, আবরার হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হবে। কখনোই নয়। কারণ এর পূর্বের এমন গ্রেপ্তার কিংবা তোলপাড়ের বিষয় লক্ষ করেছি। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই অন্য একটি ঘটনা দ্বারা সেই ঘটনার চাপা পড়েছে।
আবরার হত্যাকাণ্ডের পর পরই গণমাধ্যমসূত্রে জানতে পারলাম, ঘটনার শুরুতেই তাঁরা প্রশাসনকে এ ব্যাপারে জানিয়েছিলেন। তাহলে কেন তারা এই মর্মান্তিক ঘটনা রোধ করতে পারল না? এই জবাবগুলো আমরা খুঁজতে চাইলেও সেটি কোনোভাবেই পাওয়া যাবে না। কারণ এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর পরই ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্তৃক কিছু ঘটনায় বিব্রত হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী কঠোরভাবে সেগুলোকে দমন করতে উদ্যেগী হয়েছিলেন। এখন টানা তৃতীয় মেয়াদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে প্রধানমন্ত্রীর নিজের হাতে দেওয়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ দুজনকে নিজেই প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এমন পরিস্থিতি শেষ হতে না হতেই আবারও সংবাদের শিরোনামে ছাত্রলীগ। কী একটি ভয়াবহ শঙ্কা।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কারণে শঙ্কিত। আর এই শঙ্কার অন্যতম কারণ হলো বর্তমান ছাত্ররাজনীতির হানাহানির সংস্কৃতি। প্রায়ই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর কর্মী কিংবা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্ররাজনীতির বলি হতে হয়। এ প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিনিয়ত ছাত্রসংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে কিংবা একপক্ষ কর্তৃক অন্যপক্ষকে নির্মম, অমানবিক হামলা-নির্যাতনের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। শুধু সংগঠনের কর্মী কিংবা নেতৃবৃন্দ নয়, এসব নির্মম হামলার শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। আর এ প্রবণতা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই বেশি দেখা যাচ্ছে। এর আগে লক্ষ করেছি, কখনো শিবির ছাত্রলীগের ওপর, ছাত্রলীগ ছাত্রশিবিরের ওপর আবার কখনো বা ছাত্রদলের ওপর হামলা চালিয়েছে। এখন প্রতিপক্ষদের ওপর হামলা হয় না। হামলার শিকার হয় নিজ দল কর্তক নিজ দলের কর্মীরা এবং সাধারণরা।
এমন সংস্কৃতি চলতে থাকলে দেশের গোটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি অভিভাবকেদের আস্থা ফুরিয়ে যাবে। বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে শঙ্কিত হয়ে উঠবেন। এমনকি মেধাবীদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং শিক্ষার আগ্রহও ফুরিয়ে যাবে। তাহলে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কী? কোনোভাবেই কী এমন সহিংস নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রবণতা রোধ করা যাবে না। আর এই শঙ্কার ফলেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি এখন সবার সামনে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিরাপরাধ সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রায়ই নানাবিধ হয়রানি এবং অন্যায়ভাবে মারধরের মুখোমুখি হতে হয়। আর এগুলোও ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক শক্তি প্রদর্শনের ফল। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ততা থাকা সত্ত্বেও এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আর কিছু করতে দেখা যায় না। আমাদের দেশে এমন অনেক অপরাধ সংঘটিত হয়, যেগুলোর অপরাধীদের উচ্চমহল থেকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ না দিলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় না। এবারও আবরার হত্যাকাণ্ডের পর সরকারের উচ্চমহল থেকে ঘোষণা করা হলো তাদেরতে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হবে। কিন্তু এটি কি ঘোষণার বিষয়? এক কথায় না। কিন্তু আমাদের ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। পুলিশকে নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাদের সামনে সংঘটিত কোনো অপরাধের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে কিংবা বাধা প্রদানে এক ধাপও এগিয়ে যায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে এমন দর্শক সারির বাহিনীকে সজাগ করে গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি।
বর্তমানে ছাত্ররাজনীতিতে কোনো আদর্শ নেই। আছে শুধু আধিপত্যের লড়াই এবং পদ দেওয়া নেওয়ার একটি প্রতিযোগিতা। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যে আদর্শহীন রাজনীতি চর্চা করছে ঠিক তেমনি ছাত্ররাও সেই পথে এগিয়ে চলেছে। সুস্থ চিন্তা, চেতনা ও কার্যক্রমের অভাবে অসুস্থ সন্ত্রাস ভর করেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। অসুস্থ রাজনীতি আরো বেশি নৃশংস করে তুলেছে ছাত্ররাজনীতিকে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ না করলেই নয়, অনেকক্ষেত্রে কিছু শিক্ষকও এমন নোংরা দলবাজি থেকে নিজেদের বাইরে রাখতে পারছেন না। কোনো ছাত্রকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করার মতো জঘন্য কাজ আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না। আজ যদি কোনো ছাত্র তার নিজ কক্ষে নিরাপত্তার জায়গাটি খুঁজে না পায়, তাহলে আগামী দিনের যাত্রায় জাতিকে চরম মাশুল দিতে হবে।
ছাত্রনেতা নামে যেসব প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের উদ্দেশ্যেই বলতে চাই, অভিভাবকের স্বপ্নকে বড় করে তুলতে আধিপত্যের রাজনীতি বাদ দিয়ে গঠনমূলক রাজনীতির পাশপাশি পড়ালেখা এবং অধ্যাবসায়ের বিকল্প নেই। আজ এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা রাজনীতি করতে এসে নিজের ছাত্রত্বকে বলি দিয়ে সার্টিফিকেট না নিয়ে বাড়ী ফিরতে হয়েছে। আবার কেউ কেউ নিজের জীবন উৎসর্গ করে লাশ হয়ে ঘরে ফিরে পিতা-মাতার কোল ফাঁকা করেছে । ছাত্ররাজনীতি অনেকের জীবনেই হয়েছে অভিশাপ কিন্তু আশীর্বাদ হয়েছে কয়জনের সেটা আমার জানা নেই। আর এই অভিশাপকে মুক্ত করতে ক্ষমতাসীন দলসহ সকল রাজনৈতিক দলকে ছাত্ররাজনীতির সুফল-কুফল বিশ্লেষণ সাপেক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর প্রয়োগ নিয়ে সুবিবেচনার প্রয়োজন এসেছে। এমন সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তই বাঁচাতে পারে একজন অভিভাবকের স্বপ্ন, একজন শিক্ষার্থীর জীবন এবং সুন্দর স্বপ্নময় ভবিষ্যৎকে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।