‘রংহীন ক্যাম্পাস রাজনীতি’
আবরার ফাহাদ হত্যার পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এর মাধ্যমে সেখানে ছাত্র রাজনীতিই কার্যত নিষিদ্ধ হলো। একটা প্রশ্ন এখানে সংগত কারণেই উঠবে, বুয়েটে বা সারা দেশের সব কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কি আসলে কোনো ছাত্র রাজনীতি ছিল যে তাকে নিষিদ্ধ করা হলো?
অনেকে বলছেন, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা ভেবে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা যাবে না। ছাত্র রাজনীতির অতীত সমুজ্জ্বল, বর্তমানটা দানবীয় এবং বর্তমানটা দানবীয় বলেই এর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে ক্যাম্পাসগুলোয় মৌলবাদী রাজনীতির দুর্গ হয়ে উঠবে। প্রশ্ন হলো, মৌলবাদীরা পারলে সেক্যুলাররা কেন পারবে না সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করতে?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র রাজনীতির চেয়ে শিক্ষক রাজনীতি কোনো কোনো দিক থেকে অনেক বেশি কদর্য। শিক্ষকরা রাজনীতি এবং শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্ষমতার পথ খোঁজেন অত্যন্ত নগ্নভাবে। যাঁরা শিক্ষক রাজনীতি করেন, তাঁরা নৈতিক জায়গা থেকে বলিষ্ঠ সাহস দেখিয়ে ছাত্র রাজনীতির সব অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে বা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারছেন না নিজেদের কারণেই। শিক্ষক রাজনীতিতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চেয়েও একেকটি দলের ভেতর, বিশেষ করে, সরকারপন্থী গ্রুপের ভেতর, এখন এত বেশি রাজনীতি, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজ শুধু নয়, একাডেমিক কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান সৃজন করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রজ্ঞার কেন্দ্র। কিন্তু আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন কিসের কেন্দ্র, তা সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আর প্রক্টরদের কর্মকাণ্ডেই প্রমাণিত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা, শিক্ষকরা নিজস্ব কোনো রাজনীতি করেন না। করেন বহিরাগত শক্তির রাজনীতি, মুরব্বি দলের রাজনীতি। আদর্শ থাকবে, কোনো দলের প্রতি আনুগত্যও থাকবে, কিন্তু দলের সব কর্মকাণ্ডের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য জ্ঞান নয়, লেজুড়বৃত্তির সংস্কৃতি সৃষ্টি করে।
বিশ্ববিদ্যালয় মানে মুক্তচিন্তার বিকাশ কেন্দ্র। এখানে এমন একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকবে, যেন শিক্ষার্থীরা একটি বৈষম্যহীন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ কায়েমের কথা ভেবে আগামীর জন্য তৈরি হয়। বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিবেশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে, তাতে কি এটা সম্ভব? তাহলে আমরা এই রাজনীতির মাধ্যমে কাদের তৈরি করছি আগামীর বাংলাদেশ গড়ার জন্য?
ছাত্রদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সে বিষয়ে আমাদের রাজনীতি, আমাদের নাগরিক সমাজ কোনো ভাবনা-চিন্তাই জাতির সামনে আনতে পারছে না। নানা সময়ে, নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক রং ছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীরা বড় আন্দোলন করে জনমতকে প্রভাবিত করছে, করতে পেরেছে। দলীয় সাংগঠনিক রাজনীতি সেগুলোয় ছিল না, যোগও দেয়নি কোনো কোনোটিতে।
ক্যাসিনোকাণ্ড যেমন চোখ খুলে দিয়েছে, তেমনি আমরা দেখেছি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন টাকা উড়ছে। নবীনবরণ বা উৎসব আয়োজনের খুচরা টাকা নয়, প্রভূত পরিমাণ টাকা। উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা, সিট-বাণিজ্যের টাকা, চাঁদাবাজির টাকা। সেই টাকায় অধিকার কায়েম করবার একমাত্র উপায় রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। এই দখলের রাজনীতির দৌলতে ছাত্র রাজনীতি মূলত অনৈতিকতা ও হিংসার পরিসর হয়ে উঠেছে। মাস্তানি করা, গুণ্ডামি করা, শিক্ষকদের অপমান করা, টর্চার সেল সৃষ্টি করা, অর্থাৎ সার্বিকভাবে ছাত্রসমাজের শৃঙ্খলাহীনতাকে ‘স্বাভাবিক’-এর স্বীকৃতি দেওয়ার পরিণাম পিটিয়ে আবরার হত্যা করা বা নিজেদের গোলাগুলিতে সনি মারা যাওয়া। এসব আচরণ বহুদিন ধরেই স্বাভাবিক কিংবা অনিবার্য বলেই বিবেচিত হয়ে আসছে।
এ জায়গা থেকেই ছাত্র রাজনীতি থাকা বা না থাকার প্রশ্ন এসেছে। ছাত্র রাজনীতিতে এখন যেসব ঘটনা ঘটছে, তা অতীতের ধারাবাহিকতা মাত্র। সমাধান খুঁজতে গিয়ে বুয়েট একটা পথ বেছে নিয়েছে। এর বাইরে তার কোনো উপায়ও ছিল না। যাঁরা সুস্থতা চান, তাঁরা অনেক দিন ধরেই বলছেন, ছাত্র রাজনীতি হতে রাজনৈতিক রংকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এটি কঠিন কাজ। ছাত্র সংগঠনগুলোকে শুধু খাতায়-কলমে রাজনৈতিক দল হতে বিচ্ছিন্ন করলেই হবে না, সত্যিই যেন কোনো সংযোগসূত্র না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ছাত্র রাজনীতির কথা নেই, আছে ছাত্র সংসদের কথা। আজ পর্যন্ত প্রশাসন পারল না এটা নিশ্চিত করতে যে, ছাত্র সংসদের পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে ক্লাসে উপস্থিতি, পরীক্ষায় নম্বর ইত্যাদির কথা বিবেচিত হবে। এটা হয় না, বরং দেখি ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া ছাত্র হয়ে নির্বাচন করাকে বৈধতা দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলো থেকে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ না হলে এসব পরিবর্তন আশা করা যাবে না।
যে ছাত্ররা আইন ভাঙছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তারা বিলক্ষণ জানে, বিপদে পড়লে উদ্ধার করবার লোক আছে। পুলিশ বা প্রশাসনেরও তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করবার সাধ্য হবে না। পেছনে রাজনৈতিক দলের সমর্থন না থাকলে এই ছাত্ররা ঠিকই প্রশাসনকে সমঝে চলবে। রাজনৈতিক রংহীন ছাত্র রাজনীতি কেমন হতে পারে, তা দেখতে বুয়েটের দিকে চেয়ে আছি।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।