৮ম বেতন কাঠামো
বেতন নিয়ে অসন্তোষ
গত ৭ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভায় অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো অনুমোদন হয়েছে। এই অনুমোদিত বেতন কাঠামোতে সরকারি চাকরিজীবীরা যতটা না স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে, তারচেয়েও বেশি ফেলছে দীর্ঘশ্বাস। দেশের সব সরকারি চাকরিজীবীকে যদি সরকার রুষ্ট করে তার পরিণতি ভালো নাও হতে পারে।
চাকরির একই বিজ্ঞপ্তি, একই যোগ্যতা, একই পরীক্ষা দিয়ে শুধু এক-দেড় নম্বর কম পাওয়ার কারণে যাঁরা বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের চাকরি পছন্দ করেও পাননি, তাঁদের বেশির ভাগই চাকরি জীবনে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার চেয়ে চার ধাপ নিচে থাকবেন। যাঁরা প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার চেয়েও বেশি নম্বর পেয়েছেন, কিন্তু টেকনিক্যাল ক্যাডার হওয়ার কারণে কিংবা অন্য ক্যাডার পছন্দ করে প্রশাসন ক্যাডারে যাননি তাঁরাও একই ভাবে প্রশাসন ক্যাডারের একজন চাকরিজীবীর চেয়ে চার ধাপ নিচে থাকবেন। প্রশাসন কাডারের সাথে বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো দূরীকরণের জন্য প্রকৃচির (প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক) আন্দোলন ছিল। সরকারি কলেজের শিক্ষকদেরও দাবি ছিল তাঁদের পর্যায়ক্রমে উন্নয়ন করা হোক। অন্য যেসব ক্যাডারের দাবি ছিল না তারাও বঞ্চিত ছিল। যখন প্রশাসন ক্যাডারের সাথে দূরত্ব কমানোর আন্দোলন চলছিল, ঠিক তখনি সরকার প্রশাসন ক্যাডারে চাকরিজীবীদের আরো ওপরে আসীন করে দূরত্ব বৃদ্ধি করল। এই দূরত্ব বৃদ্ধি করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও তারা নিচে নামিয়ে দিয়েছে।
বর্তমান বেতন কাঠামোতে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তদের চেয়ে অন্যান্য ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দুই রকম বঞ্চনা তৈরি হলো। প্রথমত, তাদের আর্থিক ক্ষতি হবে। দ্বিতীয়ত, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী তাদের সম্মান কমবে। মনে হতে পারে, সম্মান তো কাগজে উল্লেখ করে হয় না। যদি তাই হবে তাহলে রাষ্ট্রের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স রাখাই চলে না। যত দিন ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স থাকবে তত দিন কাগজে উল্লেখ করা সম্মানটুকুও দিতে হবে। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ২২তম গ্রেডে। সিলেকশন গ্রেড পাওয়া একজন অধ্যাপক ১৯তম গ্রেডে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকেন ১৭ নম্বর গ্রেডে। যদি সিলেকশন গ্রেড না থাকে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ১৯তম গ্রেডে আর যেতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সারা জীবনে একবারই মাত্র টাইম স্কেল এবং একবারই সিলেকশন গ্রেড পেতেন— তাও বন্ধ করা হলো।
সরকার বর্তমান বেতন কাঠোমো বাস্তবায়নে কিছু শিশু ভোলানো যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যেমন এ বছর ২০টি গ্রেডে বেতন কাঠামো নির্ণয় করা হয়নি, করা হয়েছে ২২টি গ্রেডে। কিন্তু সংখ্যায় বলা হচ্ছে গ্রেড ২০টি। তাহলে ১ নম্বর গ্রেডের ওপরে যে জ্যেষ্ঠ সচিব ও মুখ্য সচিব বলে দুটি পদ আছে সেগুলো কোন গ্রেডে পড়ে? নাকি তারা সাধারণ সব গ্রেড অতিক্রম করে এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যাকে আর গ্রেড দিয়ে মূল্যায়ন করা যায় না!
সরকার আরো বুঝিয়েছে শতকরা হারে প্রবৃদ্ধি হলে টাইম স্কেল এবং সিলেকশন গ্রেড প্রয়োজন নেই। সেই সাথে এও বলা হয়েছে, এখন থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয়ের বদলে গ্রেড দিয়ে পরিচিতি হবে। কিন্তু এ কথা বলেনি যে, বেতন বৃদ্ধির সাথে যারা যে গ্রেড অতিক্রম করবে তারা সেই গ্রেড অনুযায়ী পরিচিতি পাবে। উদারহরণ স্বরূপ- শিক্ষা ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা ৪র্থ গ্রেডে ৫০ হাজার টাকা মূল বেতন পাবেন। শতকরা বার্ষিক বেতন বৃদ্ধিতে যখন তিনি ৫৬ হাজার টাকা অতিক্রম করবেন তখন তিনি তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত হবেন এমন কথা বলা হয়নি। যদি সেটা বলা হতো তাতেও সমস্যা অনেকটা দূর হতো।
সরকার নতুন বেতন কাঠামোতে একটি ক্যাডারভুক্তদের খুশি করতে গিয়ে প্রজাতন্ত্রের অন্য সব চাকরিজীবীর সাথে বৈষম্য বৃদ্ধিমূলক বেতন কাঠামো করেছে। বেতন দ্বিগুণ হয়েছে মর্মে যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তাও ঠিক নয়। বেতন বাজার-মূল্যের সাথে সমন্বয় করা হয়েছে, বৃদ্ধি করা হয়নি। গত কয়েক বছরে বর্ধিত বাজার মূল্যের সাথে এই সমন্বয়। সেই সমন্বয়ের হার পদ বিশেষে প্রায় ৬০ শতাংশ। বেতন দ্বিগুণ বৃদ্ধির ধোয়া তুলে বাজারের সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে সরকারি চাকরিজীবীদের অবস্থা আগের মতোই রাখা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে অসংলগ্ন মন্তব্য করে আবার দুঃখ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। দুঃখ প্রকাশ করলেও সাবেক এই আমলার যে অমলাপ্রীতি রয়েছে সেটা পরিষ্কার।
২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে যেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করা হবে, সেই সরকার মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে শিক্ষকদের সম্মানের ওপর এমন নির্মম ছুরি বসাতে পারে- এটা কল্পনাও করা যায় না।
এরই মধ্যে সরকার বিভিন্ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদটি ১ নম্বর গ্রেড করার ঘোষণা দিয়েছে। যেমন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদটি এক নম্বর গ্রেডের করা হচ্ছে। আর শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকরা হবেন সর্বোচ্চ ৪র্থ গ্রেডের। শিক্ষা ক্যাডারে যেহেতু এক নম্বর গ্রেডের কেউ থাকবে না, তখন সরকার সচিবদের মহাপরিচালক পদে আসীন করবে বলে যে সন্দেহ করা হচ্ছে তাও হয়তো অমূলক নয়।
কারমাইকেল কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক সুজন শাহ-ই ফজলুল বলেন, ‘একই পদ্ধতিতে চাকরিতে যোগদান করে একটি নির্দিষ্ট ক্যাডারকে যেভাবে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে তাতে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা কাজের স্পৃহা হারাবেন।’ আমলাদের ষড়যন্ত্রের কারণে এই অবস্থা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সরকার অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোর মধ্য দিয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে, তা দ্রুত সমাধান করতে না পারলে সরকারের জন্য অষ্টম বেতন কাঠামো শুভ কিছু বয়ে আনবে না।
সরকারিভাবে বেতনবৈষম্য দূরীকরণে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা কেবলি দেখানোর জন্য, নাকি বাস্তবে বেতম-বৈষম্য দূর হবে তাই এখন দেখার বিষয়। চাকরিজীবীদের ন্যায্য প্রাপ্তি প্রদান করলে সরকারের জন্য তা সুনামই বয়ে আনবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।