ছাদ বাগানের গাছ কাটা ও আমাদের সিটিজেন জার্নালিজম
সাংবাদিকতা শব্দের সঙ্গে সব শ্রেণির মানুষের পরিচয় থাকলেও, সিটিজেন জার্নালিজম সম্পর্কে হয়তো ধারণা নেই অনেকরই। স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বপ্রণোদিত হয়ে গণমানুষের বা আম-জনগণের খবর ও তথ্য সংগ্রহ, পরিবেশন, বিশ্লেষণ এবং প্রচারে অংশগ্রহণ হচ্ছে সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতা। যখন একজন সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছায় খবর বা তথ্য সংগ্রহ করে ব্লগ, ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইত্যাদিতে প্রকাশ করে থাকে, তখনই সে সিটিজেন জার্নালিজমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।
মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অনেক ঘটনার খবর কিংবা চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা আজকাল ব্লগ ব বা সামাজিকমাধ্যমে জানা যায়। আর এর পরই তৈরি হয় হইচই। সম্প্রতি সাভারের একটি বাড়ির ছাদের উপরে এক নারীর গাছ কাটার দৃশ্যটি আলোচনায় এসেছে দেশের শীর্ষ সংবাদ মাধ্যমগুলোতে। প্রতিবেশীর লাগানো গাছ কাটার দায়ে এরই মধ্যে সাভারের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে সেই নারীকে।
নারীর গাছ কাটার দৃশ্যটি সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হওয়ার আগে লাখ, লাখ মানুষ তা দেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দৃশ্যে দেখা যায় গ্রেপ্তার হওয়া নারী গাছ কাটছেন, আর গাছের মালিক চিৎকার করে কান্নাকাটি করছেন আর দৃশ্যটি ভিডিও করছেন। ফেসবুকে ভিডিওটি আপলোড হওয়ার পরবর্তী ঘটনা আমরা সবাই দেখেছি।
ঘটনাটির পর আমার মনে হয়েছে, নাগরিক হিসেবে আমরা সচেতন হচ্ছি। নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিচার চাইতে পারছি আমরা। আর এর মাধ্যমেই আমরা সিটিজেন জার্নালিস্ট হয়ে উঠছি। এখন তো কোনো জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটলে টিভি চ্যানেল পৌঁছানোর আগে ফেসবুকে লাইভ দেখাতে পারেন যেকোনো আগ্রহী নাগরিক সাংবাদিক। নাগরিক সাংবাদিকতার যুগে সাধারণ ব্যক্তিও এখন খবর জোগান দিতে পারছেন। তা ছাড়া ইদানীং অনেক প্রথম শ্রেণির সংবাদমাধ্যম নাগরিকদেরও খবর সংগ্রহ করে পাঠানোর ব্যবস্থা রেখেছে। তাই এখন আমাদের চারপাশের সচেতন সব মানুষই এক একজন সংবাদ সংগ্রাহক হয়ে কাজ করছেন।
সাংবাদিকতার কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই অনলাইনভিত্তিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কেউ তার চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনা, বিষয় বা নিজস্ব মতামত কিংবা সঠিক তথ্য-উপাত্ত লেখা, তথ্যচিত্র, খুদেবার্তা, অডিও, ভিডিও বা অন্য কোনোভাবে জনস্বার্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশ করে থাকে। তবে জনকল্যাণেই তার একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে। পাঠকের মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরে নাগরিক সাংবাদিকতার প্লাটফর্ম তৈরি করে অনেক গণমাধ্যম। দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও রয়েছে চিঠিপত্র ও মতামত কলাম। তবে ফেসবুকই এখন নাগরিক সাংবাদিকতার প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে দৈনিক সমকালের একটি সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারি মুক্তিযোদ্ধা মন্তাজ আলীর কথা। যিনি চিকিৎসাসেবা না পেয়ে মৃত্যুর দিন গুনছিলেন। টাকার জন্য চিকিৎসাও বন্ধ তার। পাঁচ মাস ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী। তার জীবনের এই সমস্যা তুলে ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সাহায্যের আবেদন করেন তার পাশের বাড়ির এক ছেলে। আর এই আবেদনে সারা দেয় বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ।
চলতি বছরের ২৬ জুন বরগুনায় রিফাত শরীফ নামের এক ব্যক্তিকে তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনেই কুপিয়ে হত্যা করে একদল লোক। ঘটনার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়ালে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। আর এই ভিডিওর মাধ্যমেই পুলিশের আসল অপরাধীদের শনাক্ত করা এবং ধরা সহজ হয়েছে।
একটি রিকশা ভ্যান চুরির অভিযোগ তুলে ২০১৫ সালের ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে ১৩ বছর বয়সী রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা কারো ভোলার কথা নয়। মূল আসামি কামরুলের সহযোগী নূর মিয়া সেদিন রাজনকে পেটানোর দৃশ্য ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেন। ওই ঘটনায় সারা দেশে তৈরি হয় তীব্র ক্ষোভ। আর এই ভিডিও পরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়ে গ্রেপ্তার করে আসামিদের।
ওপরের সবই সিটিজেন জার্নালিজমের অংশ। আপনার কাছে বলার জন্য কথা আছে। তথ্য আছে। আপনার নিজের, আশপাশের, মানুষের গল্প আছে। আপনি সেটা মানুষকে সহজেই জানাতে পারেন। আপনার সে কথা , সেই গল্প সমাজের বা রাষ্ট্রের নয়, একইসঙ্গে শুনবে, জানবে পুরো বিশ্ব। আপনি নিজে সেটার স্থপতি। স্থপতি যেভাবে ভবন নির্মাণের জন্য কাজ করবে। সেখানে গল্প থাকবে, প্রশ্ন, উত্তর থাকবে। যুক্ত হতে পারে ভিডিও, অডিও বা ছবি। আরো থাকতে পারে নির্দেশনা।
সিটিজেন সাংবাদিকতা বর্তমান সময়ের এক নতুন শক্তির নাম, এতকাল মানুষ শুধু একতরফাভাবে খবর পড়েছে। এখন খবর পড়া এবং সরবরাহ করা দুদিকেই অবস্থান নেওয়ার অভূতপূর্ব সুযোগ মানুষকে আরো শক্ত অবস্থান দিয়েছে। এ সুযোগের সঠিক ব্যবহার ও গঠনমূলক চর্চা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার এ ‘ফোর্থ এস্টেট’কে শক্তিশালী করবে। সত্যিকারের সুফল ভোগ করতে সব পক্ষকেই আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
তবে নাগরিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সব ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা এর বড় চ্যালেঞ্জ। মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমের মতো তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে। মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের যেভাবে জবাবদিহিতার জন্য দায়িত্বশালী কর্তৃপক্ষ রয়েছে, নাগরিক সাংবাদিকতায় অনেক ক্ষেত্রেই সেটি উপেক্ষিত। কাজেই নাগরিককে যেমন দায়িত্বশালী হতে হবে, তেমনি নাগরিক সাংবাদিকতায় জবাবদিহিতা ও বস্তুনিষ্ঠতা বাড়ানোর উপায় নিয়ে ভাবারও সময় এসেছে।
লেখক : সাংবাদিক, আমাদের সময়।