গ্যালাপের জরিপ
আসলেই কি বাংলাদেশ নিরাপদ?
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ দেশ। এমন তথ্য পাওয়া গেল ওয়াশিংটনভিত্তিক জনমত জরিপ সংস্থা গ্যালাপের কাছ থেকে। তারা ২০১৪ সালে বিশ্বের ১৪১টি দেশের এক লাখ ৪২ হাজার মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে এ তথ্য দিয়েছে।
তিনটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সংস্থাটি এ জরিপ চালিয়েছে। বিষয়গুলো হলো পুলিশের উপর আস্থা, রাতবিরাতে চলাফেরার ঝুঁকি ও চুরি-ডাকাতির ঘটনা।
আপাতদৃষ্টিতে জরিপের তথ্য সত্য নয় বলে অনেকেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। অথবা যাদের ওপর জরিপ চালানো হয়েছে, তাদের ব্যক্তিগত পরিচিতি নিয়েও মন্তব্য করছেন তাঁরা।
তবে আমার মত হলো, এ জরিপ দ্বারা যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থার দিকে তুলনামূলক দৃষ্টিপাত করলে যথাযথ বলেই মনে হবে।
আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে। এসব জরিপের মূল গবেষণার বিষয় হলো আমজনতা বা সর্বসাধারণ।
সে হিসেবে একান্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিষয়গুলো বিবেচনার বাইরে রাখতে হবে। কারণ রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করলে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরা কষ্টসাধ্য হবে।
‘গ্লোবাল ল অ্যান্ড অর্ডার রিপোর্ট’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র শ্রীলঙ্কাই বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাপ্ত পয়েন্ট ৭৮। আর শ্রীলঙ্কার ৭৯।
যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশকে দেখানো হয়েছে ৭৭ পয়েন্টধারী হিসেবে, বাংলাদেশের পরের অবস্থানে। ফ্রান্সের প্রাপ্ত পয়েন্ট ৭৫।
৮৯ পয়েন্ট নিয়ে তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে সিঙ্গাপুর। এরপর রয়েছে যথাক্রমে উজবেকিস্তান ৮৮ পয়েন্ট ও হংকং ৮৭ পয়েন্ট।
সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা ঝুঁকির দেশ হচ্ছে লাইবেরিয়া ও ভেনেজুয়েলা। এই দুটি দেশের পয়েন্ট যথাক্রমে ৪০ ও ৪২।
আঞ্চলিক পর্যায়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকা লাতিন আমেরিকার ব্রাজিলের পয়েন্ট ৫২ ও মেক্সিকোর পয়েন্ট ৫৯।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পয়েন্ট ৬৭, পাকিস্তানের ৬০ এবং নেপাল ও ভুটানের ৭৩।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৮৭ পয়েন্ট নিয়ে ইন্দোনেশিয়া রয়েছে তালিকার শীর্ষে। এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া ৬৪, থাইল্যান্ড ৭৪ ও ভিয়েতনাম ৭২ পয়েন্ট পেয়েছে।
এবার কিছু তুলনামূলক আলোচনা করা যাক। ভারতে অবস্থান বাংলাদেশের চেয়ে দশের নিচে। রোজ খবরের কাগজ খুললেই দেশটিতে শোনা যায় যাত্রীবাহী গাড়ির মতো বাহনেও দিনের বেলায় ধর্ষণের ঘটনা। অন্যদিকে বিভিন্ন গেরিলা সংঘঠনগুলোর কার্যক্রম। শুধু সেভেন সিস্টার নয়, ভারতের অন্য এলাকায়গুলোতেও রয়েছে নানা সমস্যা। বিশেষ করে জম্মু-কাশ্মীরের কাশ্মীর অঞ্চলের শতভাগ মানুষই যে তাদের অনিরাপত্তার কথা বলবে তা কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায়। কারণ সে অঞ্চলটিতে দিনের বেলায়ও মানুষ চলা ফেরা করে অত্যন্ত সংগোপনে। সন্ধ্যার পরপরই বড় বড় শপিংমলগুলো পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। খোদ রাজধানী শ্রীনগরই এ রকম দৃশ্য।
সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে লাইবেরিয়ার কথা বলেছে সংস্থাটি। বিষয়টি যুক্তির দাবিদার। কারণ মাত্র কদিন আগেই দেশটি দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের রেষ কাটিয়ে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করল। সে হিসেবে অভ্যন্তরীণ সমস্যার রেশ তো এক নিমিষে শেষ হয়ে যেতে পারে না।
অবশ্য দক্ষিণ সুদানের মতো সদ্য স্বাধীন পাওয়া দেশের ওপর সংস্থাটি জরিপ চালাতে পেরেছে কি না তা আমার জানা নেই। হয়তো চালাতে পারেনি। কারণ দেশটি মাত্রই স্বাধীন হলো। হয়তো এসব দেশের ওপর জরিপ চালালে লাইবেরিয়ার মতো দেশের নাম বাদ যেত।
তবে একটা কথা সত্য এই জরিপের সবচেয়ে দুর্বলতা হলো সংস্থাটি শুধু দেশের ওপর জরিপ চালিয়েছে। তুলনামূলক আলোচনা করতে গেলে দেখা যাবে এ ধরনের জরিপ প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ সিঙ্গাপুর সর্বশীর্ষে রয়েছে সত্য তবে এটি একটি সিটি রাষ্ট্র। যার সঙ্গে ভারতের মতো একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের তুলনা হতে পারে না।
ফ্রান্সের কথাই বা আমরা কীভাবে বাদ দিতে পারি। আপনি হয়তো বলবেন জরিপের তথ্য তো ১৩ তারিখে সত্য প্রমাণ হলো। ব্যস্ততম স্থানে কী ধরনের হামলা হলো। শত শত লোক প্রাণ হারালো।
বস্তুত সংস্থাটি যে তিনটি বিষয়ের ওপর জরিপ চালিয়েছে, তার মধ্যে কিন্তু এসব নিরাপত্তার বিষয় নেই। কারণ এসব সন্ত্রাসী হামলার পেছনে পুলিশের দুর্বলতার প্রশ্ন খোঁজা বিতর্কের সূত্রপাত করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও জরিপে বাংলাদেশের তুলনায় নিচে দেখিয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে খোঁজ নিলে এর কিছু সত্যতা যাচাই করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের চিত্র যতখানি স্বচ্ছ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, বস্তুত দেশটির চিত্র ততখানি স্বচ্ছ নয়। সেখানে পুলিশকে তো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাও ক্ষতিয়ে দেখার মতো বিষয়। অনেক সময়ই এই পুলিশই হয়ে ওঠে কোনো নিপীড়িত নারী বা ব্যক্তির নিপীড়ক হিসেবে। ছোট্ট বাচ্চার অভিযোগের প্রাথমিক যাচাই না করে বাব-মাকে থানায় নিয়ে যাওয়া সেখানকার প্রচলিত একটি বিষয় বলে আমরা শুনে আসছি। অন্যদিকে বয়ফ্রেন্ডের জন্য স্ত্রীর অভিযোগে স্বামীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে ওখানে।
আমরা জরিপের দিকে তাকালে দেখব, বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম দিক থেকে মাঝামাঝি অবস্থানে। আমাদের দেশের পুলিশ নিয়ে জনমনে সবচেয়ে বেশি কটুকথা প্রচলিত। খবরের কাগজ খুললে দেখা যায় পুলিশ এটা করেছে ওটা করেছে। নানা রকম দুষ্কর্মের খবর।
আমাদের সোনার দেশটাকে নিরাপদ রাখা আমাদের প্রতিটা জনগণের নৌতিক দায়িত্ব। দেশের নিরাপত্তা মানেই নিজেরই নিরাপত্তা। এ কথা ভুললে চলবে না।
লেখক : শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।