পরিবেশ
কৃষি-খাদ্য উৎপাদন এবং আমাদের করণীয়
বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবাদীরা একটি বিষয়ে একমত যে সারা পৃথিবীতে যে প্রক্রিয়ায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করা হচ্ছে, তা পরিবেশ ধ্বংস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ। শক্তি ব্যবহারের এই ধরন বাতাসে বিপুল পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি করছে এবং তার ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে শক্তি ছাড়া সব অচল। আমাদের পরিবহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প-উৎপাদন, গার্হস্থ্য বিভিন্ন কাজ সব কিছুই নির্ভর করছে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর। পাশাপাশি আরেকটি জিনিস আমাদের প্রিয় গ্রহের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। তাহলো কৃষি ব্যবস্থাসহ পুরো খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া। এটা ঠিক যে জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হয়। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াও বিপুল পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন করে জলবায়ু পরিবর্তনে বিরাট অবদান রাখছে। শুধু তাই না, কৃষি ব্যবস্থা জলবায়ুসহ পৃথিবী নামক গ্রহটি যে প্রক্রিয়ায় বেঁচে থাকে তার প্রায় সব বিভাগে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
সারা পৃথিবীতে ব্যবহৃত সুপেয় পানির ৭০ ভাগ খরচ হয় কৃষিতে। মাটির উর্বরতার জন্য নাইট্রোজেন ও ফসফরাসভিত্তিক যেসব রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়, তার বেশির ভাগই কাছাকাছি থাকা সব জলাধারকে দূষিত করছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য কৃষক হারাচ্ছে জমির মালিকানা, উৎপাদনের মালিকানা। করপোরেটদের হাতে চলে যাচ্ছে পুরো কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা। ফলে সর্বোচ্চ মুনাফায় খাদ্য উৎপাদনের জন্য ভয়াবহ দ্রুতগতিতে জমির বণ্টন ব্যবস্থা, ব্যবহার প্রথাও পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। পাহাড় কেটে সমান করে ফেলা হচ্ছে, বনাঞ্চল সাফ করে কৃষিজমিতে রূপান্তর করা হচ্ছে এবং উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে বসতভিটাসহ কৃষকের মালিকানার শেষ ইঞ্চিটুকু। ফলে ওই সব এলাকার কৃষকসহ অন্যান্য পেশাজীবীরা হচ্ছেন সহায় সম্বলহীন, তাঁরা কাজের আশায় ভিড় করছেন নগরে। নগরের ভীষণ বড় সব অট্টালিকার পাশে দিনকে দিন আরো ঘন হচ্ছে বস্তিগুলো। চলছে বস্তি উচ্ছেদ কিংবা রাতের আঁধারে কারো জমি দখলের রোষানলে পুড়ে যাচ্ছে বস্তির মানুষসহ সব কিছু। অন্যদিকে সেই কৃষি এলাকার জীব, জন্তু, পশুপাখি তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে এবং পুরো বাস্তুসংস্থানই উধাও হয়ে যাচ্ছে। যেন পৃথিবীটার মালিক শুধুমাত্র করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। আর কেউ এখানে থাকতে পারবে না। মনে রাখা দরকার, পৃথিবী নামক বাসযোগ্য এই গ্রহ মানুষের একার নয়। এখানকার পানি, বায়ু, মাটি, পরিবেশ, জলবায়ু মানুষের সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক প্রাণ ভাগাভাগি করে বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার এবং বিকাশ লাভ করার অধিকার মানুষের যতটুকু আছে, অন্য সবার ঠিক ততটুকুই আছে। শক্তি, বুদ্ধির বলে মানুষ যেভাবে সবকিছুর ওপর তার দখল কায়েম করে চলছে তা প্রজাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে অনেক বেশি হুমকির সম্মুখীনও করে তুলেছে।
পরিবেশের ওপর নৃতাত্ত্বিক অন্যান্য দূষণের মধ্যে ভয়ংকরতম দূষণটি ঘটছে কৃষির মাধ্যমে। আগাছা এবং কীটপতঙ্গ দমনের জন্য যেসব রাসায়নিক কীটনাশক, আগাছানাশক ব্যবহার করা হয় তা মাটি ও পানিকে এই মাত্রায় বিষাক্ত করে তোলে যে সেগুলি আর অন্যান্য জীবের ব্যবহার উপযোগী থাকে না। ফলে আমরা দেখতে পাই, যেখানে ৩০ বছর আগে কৃষিজমিতে মৌমাছি বাসা বাঁধত, পাখ-পাখালির কলকাকলি ছিল, ছিল ধানক্ষেতে শত প্রজাতির মাছ, ব্যাঙ, কাঁকড়া এখন সেখানে ধানগাছ ছাড়া অন্য কিছুই নেই।
১৭৯৮ সালে ইংরেজ চিন্তাবিদ থমাস রবার্ট ম্যালথুস তার প্রিন্সিপালস অব পপুলেশন গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন, ‘মানবজাতির প্রবণতা অনুযায়ী জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়, আর প্রকৃতির ধরন অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে। ফলে একটা সময় আসবে যখন মোট উৎপাদিত খাদ্যও মানুষের প্রয়োজন মিটানোর জন্য যথেষ্ট হবে না। অর্থাৎ পৃথিবীর সক্ষমতা অনুযায়ী তা মোট মানবজাতির জন্য খাদ্য উৎপাদন করতে পারবে না। প্রকৃতি তখন জনসংখ্যা এবং খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে আসবে। অর্থাৎ যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এগুলোর মধ্যদিয়ে ভারসাম্যটি প্রতিস্থাপিত হবে।’ যদিও ম্যালথুসের অনুমান অনেকটা ভাববাদী চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল তথাপি তা পরবর্তীতে ডারউইন এবং আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বকে ব্যাপক প্রভাবিত করে। ম্যালথুস নিজের জীবদ্দশায় বিজ্ঞানের অভাবনীয় আবিষ্কারগুলো দেখে যাননি। আমরা দেখেছি। আমরা জানি বর্তমানে পৃথিবীর মোট চাহিদার প্রায় দ্বিগুণের বেশি খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে। ম্যালথুসের এই ভবিষ্যদ্বাণীর পর মেন্ডেলের জেনেটিকস, মাটির মধ্যে থাকা উদ্ভিদের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান, ক্ষয় হয়ে গেলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য রাসায়নিক সার, সবুজ বিপ্লব, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বহু কিছুর আবিষ্কার হয়েছে; যা তার এই ভবিষ্যদ্বাণীকে করে তুলেছে অর্থহীন। কিন্তু অন্যদিক থেকে চিন্তা করলে আমরা এখনো ম্যালথুসের ভবিষ্যৎবাণীর সীমাবদ্ধতার ভেতর আটকে পড়ে আছি। বিজ্ঞানের অভাবনীয় এসব আবিষ্কার ৭২০ কোটি মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন সহজ করে দিলেও (যদিও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফলস্বরূপ সারা বিশ্বে ১৫০ মানুষ কোটি মানুষ এখনো অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটায়) তা পরিবেশবান্ধব উপায়ে হচ্ছে না। ভাবতে অবাক লাগে, যদি সুপেয় পানির সরবরাহ শেষ হয়ে যায়, যদি রাসায়নিক সারের কারণে আশপাশের সব জলাধার আক্ষরিক অর্থে মরে যায় তখন কী হবে! ফলে ম্যালথুসকে সত্যিকার অর্থে খারিজ করতে হলে আমাদের এমন খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় যেতে হবে যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে।
আমাদের ভেবে বের করা দরকার ঠিক কী কী পদ্ধতি অবলম্বন করলে আমরা যথাযথ পরিমাণে খাদ্য উৎপাদন পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রাখতে পারি। ম্যালথুসের ভবিষ্যৎবাণী অসাড় প্রমাণের জন্য আমাদের সারা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যাকে পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ করতে হবে একই সঙ্গে সেই উৎপাদন হতে হবে পরিবেশবান্ধব উপায়ে। পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলে নয়। শুধু উৎপাদন নয়, আমাদের খাদ্যাভ্যাসও এমনভাবে বদলে ফেলা দরকার যাতে কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশ কিংবা জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে না পড়ে। প্রতিদিন বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু অঞ্চলেই বিলুপ্তপ্রায় বন্য প্রাণী, মাছ, পাখি নিধনের খবর দেখা যায়। এসব থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এবং খাদ্যাভ্যাস দুটিই বদল করা অত্যন্ত জরুরি।
দেখা যাক ঠিক কী কী উপায়ে আমরা খাদ্য উৎপাদনের ভেতর দিয়ে পৃথিবীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছি। প্রথমত, খাদ্য ব্যবস্থা নিজেই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের এক বিরাট উৎস। যেমন চাষ করা, ফসল সংগ্রহ, মজুদ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন প্রক্রিয়া, নাইট্রোজেন এবং ফসফরাসভিত্তিক সার উৎপাদনে বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয়। আমরা দেখেছি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বাতাসে প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হচ্ছে, কিন্তু এর পাশাপাশি কৃষিকাজের মাধ্যমে আরো দুটি ভয়ানক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়। এগুলো হলো মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড। মিথেন কয়েকভাবে আসে। যেমন বন্যা, অতিবৃষ্টির ফলে কোথাও ফসলের মাঠ, তৃণভূমি কিংবা বনাঞ্চল ডুবে গেলে, ডুবে যাওয়া ফসল পচে বিপুল পরিমাণ মিথেন নির্গমন হয়। এ ছাড়া গবাদি পশু যখন খাবার হজম করার জন্য জাবর কাটে, তাদের পেট থেকেও বাতাসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মিথেন নির্গত হয়।
নাইট্রাস অক্সাইডের একটা অংশ আসে শিল্প উৎপাদন এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। এ ছাড়া ফসলে ব্যবহৃত নাইট্রোজেনভিত্তিক সারের উদ্বৃত্ত অংশ মাটিতে মিশে গিয়ে পুনর্বিন্যস্ত হয়। তখন সেখান থেকেও নাইট্রাস অক্সাইডের নির্গমন হয়। পানিদূষণেরও অন্যতম বড় কারণ নাইট্রোজেন। জমিতে যে নাইট্রোজেনভিত্তিক সার যেমন ইউরিয়া দেওয়া হয়, তা গাছ সরাসরি নিতে পারে না, হয় তা বাতাসে মিশে যায় অথবা পানিতে দ্রবীভূত হয়ে কিছু গাছের উপকারে লাগে, বাকি বেশির ভাগটাই ভূগর্ভস্থ জলাধার কিংবা কাছাকাছি থাকা খাল, বিল, নদী বা সাগরে প্রবাহিত হয়। ভিন্ন ভিন্ন গবেষণার ফলাফল একত্র করে দেখা গেছে কৃষির কারণে ১. গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হচ্ছে ২. জমির ব্যবহার পদ্ধতি এবং মানুষের সঙ্গে তার পারিপার্শ্বিক অঞ্চলের সম্পর্ক বদলে যাচ্ছে, ৩. অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য পতিত জমি ব্যবহার করে ফেলা, কৃষি কিংবা কাঠের প্রয়োজনে বনাঞ্চল ধ্বংস করে ফেলায় বন্য প্রাণীর খাদ্যের উৎস, আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে সেগুলো ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
আরেকটি ভীষণ বিকৃত দখলদারিত্ব সৃষ্টি হয় কৃষিতে আগ্রাসী প্রজাতির প্রাণী অথবা উদ্ভিদ আমদানির মাধ্যমে। যেমন অধিক কিংবা বাণিজ্যিক উৎপাদনের লক্ষ্যে মানুষ কোনো একটি প্রজাতিকে পৃথিবীর এক এলাকা থেকে নিয়ে ভিন্ন একটি পরিবেশে প্রতিস্থাপন করে। যেখানে এরই মধ্যে বৈচিত্র্যময় জীবজন্তু উদ্ভিদ আছে এবং এসব প্রজাতিসমূহের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিযোগিতা নাই, সেখানে নতুন প্রজাতিটি প্রতিস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশের ভারসাম্য সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। যদি সেটি প্রাণী হয় তাহলে সেটি সেখানে ভয়ানক বন্য আচরণ করে এবং অন্যান্য আদিবাসী প্রজাতিকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। যেমন বাংলাদেশে আফ্রিকান মাগুর আনার পর এটি পুকুরের সব মাছ খেয়ে ফেলে। আবার এটি যদি কোনো উদ্ভিদ বা আগাছা হয় তাহলে দেখা যায় প্রতিযোগিতাহীন পরিবেশ পেয়ে এটি ব্যাপক জলাধার কিংবা জমি দখল করে ফেলে এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্য বাস্তুসংস্থানকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এসব আগ্রাসী প্রজাতি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে জেনে অথবা না জেনে কোনো একটি এলাকার লাখ লাখ বছর ধরে তৈরি হওয়া বাস্তুসংস্থান আমরা নতুন করে নির্মাণ করছি, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
সবুজ বিপ্লবের নামে শস্য উৎপাদনের জন্য জমিতে এত বেশি পরিমাণে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস ব্যবহার করা হয় যে তা পানির মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে ভূগর্ভস্থ জলাধার এবং উন্মুক্ত জলাশয়ে গিয়ে জমা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি ঘটে নদী ও সাগরের মোহনায়। সারা দুনিয়ার সব মোহনায় (যেখানে নদীর স্বাদুপানি এবং সমুদ্রের লোনাপানির মিলন ঘটে) বহুরকম জীববৈচিত্র্য-সমৃদ্ধ আশ্চর্যজনক সব বাস্তুসংস্থান দেখা যায়। কৃষিজমি থেকে চুইয়ে আসা মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া এবং ফসফরাস এসব জায়গায় জমা হয়ে পানির পুষ্টির ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। ফলে প্রথমেই এখানে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে শ্যাওলা এবং অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ জন্মায়। সময়ের বিবর্তনে এসব শ্যাওলা এবং জলজ উদ্ভিদ মারা যায়। একসময় এসব মৃত শ্যাওলায় ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে পচন শুরু হয়। এ অবস্থায় ব্যাকটেরিয়া পানির অক্সিজেন ব্যবহার করতে থাকে। ফলে শ্যাওলা পচনের এলাকায় পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা যায়। একপর্যায়ে মোহনায় অক্সিজেন ঘাটতিজনিত একটি এলাকা সৃষ্টি হয়। যাকে বলে হাইপক্সিক জোন। অর্থাৎ অক্সিজেন সংকটজনিত এলাকা। হঠাৎ করে হাইপক্সিক জোনে মাছ, কাঁকড়া, শামুকসহ অন্য সব পূর্বতন জলজ প্রাণী অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় বা দূরে কোথাও চলে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং পুরো হাইপক্সিক জোন একটি প্রাণহীন জলাভূমিতে পরিণত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর ১৩০টি মোহনায় শুধুমাত্র কৃষিজমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহারের কারণে এ রকম হাইপক্সিক জোন সৃষ্টি হয়েছে।
অপরিকল্পিত কৃষি এবং খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার কারণে নতুন নতুন রোগ সৃষ্টির উদাহরণও কম নয়। যেমন ধরা যাক পোলট্রি খামারে কিংবা বড় ডেইরিতে হাজার হাজার গরু, হাজার হাজার মোরগ-মুরগি এক জায়গায় থাকছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব জায়গায় জিন, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের পুনর্বিন্যাস ঘটে। এসব গরু, মুরগি যখন খোলা জায়গায় অন্য গরু-মুরগির সঙ্গে মিলিত হয়, সেখানে আরো পুনর্বিন্যাস ঘটে। একপর্যায়ে সার্স বা এ রকম ভয়াবহ সব রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটে। ফলে পৃথিবীজুড়ে গত ৫০ বছরের বাণিজ্যিক কৃষি, পোলট্রি, ডেইরি আমাদের নিত্যনতুন প্রাণসংহারী রোগের মুখোমুখি করেছে। এর সঙ্গে আছে বনাঞ্চল থেকে মাত্রাতিরিক্ত ফসল সংগ্রহ, সম্পদ আহরণ, কাঠ কাটা, তৃণভূমি ধ্বংস, অতিরিক্ত পরিমাণে মৎস্য আহরণ। মাছের বেশির ভাগ অভয়ারণ্য আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিংবা অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণের কারণে এখন প্রায় শূন্য।
খাদ্য উৎপাদনের জন্য ভূগর্ভস্থ জলাধারের পানি উত্তোলনের ফলে সেগুলিও আছে ঝুঁকির মধ্যে। কারণ সেচের জন্য প্রতিবছর যে পরিমাণ পানি উত্তোলিত হচ্ছে সেই পরিমাণ পানি আবার সেখানে জমা হতে পারছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচের পানির জন্য নদীশাসন এবং গতিপথ পরিবর্তনের কারণে বেশির ভাগ নদীই এখন আর সাগরের দেখা পাচ্ছে না। ফলে পদ্মা, বোরাক, তিস্তাসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ নদীর যে নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিচালন পদ্ধতি ও বাস্তুসংস্থান ছিল তা ধ্বংসের পথে। আমরা জানি মানুষসহ সব জীবের ভালো থাকা, বেঁচে থাকা, সুস্থ থাকার জন্য পানি কী ভীষণ জরুরি। বহু জায়গায় নদীসহ সব স্বাদুপানির মজুদের অতিরিক্ত ব্যবহার একদিকে যেমন জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখছে, তেমনি মানুষসহ সকল জীবের প্রাণ ধারণ করে তুলেছে কষ্টকর।
যেকোনো জায়গার কৃষি এবং খাদ্য উৎপাদন স্থানীয় আবহাওয়া, জলবায়ু, মাটি, পানির ধরন, বৃষ্টিপাত, পরিবেশ, সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতি অনুযায়ী আলাদা। এই অবস্থায় পৃথিবীর প্রত্যেক অঞ্চলের আঞ্চলিক বাস্তবতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ, কৃষিসহ পুরো খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন ভাবনা দরকার। দরকার নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন – যা খাদ্য উৎপাদন তথা কৃষিব্যবস্থাকে একটি টেকসই দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাবে। এমন একটি পৃথিবী নির্মাণ জরুরি যেখানে মানুষের খাদ্য উৎপাদনের জন্য অন্য সব প্রজাতি অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে না। যেখানে স্রেফ খাদ্য উৎপাদনের কারণে জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে যাবে না, পরিবেশদূষণ ঘটবে না কিংবা মহামারীও সৃষ্টি হবে না।
লেখক : তড়িৎ প্রকৌশল ও নবায়নযোগ্য শক্তি বিশেষজ্ঞ