অর্থনীতি
অলস টাকার পাহাড় ও বিনিয়োগ ভাবনা
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চারটিসহ দেশের ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকা বা অলস টাকার পাহাড় জমেছে—এমন খবরই পত্রিকায় দেখা গেল কদিন আগে। কত শত হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে, সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। সদ্য শেষ হওয়া ব্যাংকিং মেলায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে পাওয়া কাগজপত্র তুলে ধরে সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, এই অঙ্ক প্রায় ৫৭ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা। কেউ কেউ বলছে, এই সংখ্যা আরো বেশি, যা দিন দিন বাড়ছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সংখ্যাটা এর চেয়ে অনেক কম! তবে কমবেশি যা-ই হোক না কেন, বিনিয়োগহীন টাকা বা অলস টাকা ব্যাংকিং খাতের জন্য সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। আর সহসা বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হবে, ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়বে, সে সম্ভাবনা নেই। কমবেশি প্রতিটি ব্যাংকই এ নিয়ে খানিকটা অস্বস্তিতে আছে বলা বাহুল্য। তাই অলস টাকার অঙ্ক নিয়ে বিতর্কের চেয়ে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিকল্প উদ্যোগগুলো বের করা। হুটহাট করে নয়, পর্যায়ক্রমে কী কী উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া এখন বেশি প্রয়োজন।
বিনিয়োগ মন্দার কারণে ব্যাংকে অলস টাকা বেড়ে যাওয়ায় অনেক নেতিবাচক প্রভাবের মুখোমুখি হতে হবে। গ্রাহকের আমানত নিয়ে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের কাঙ্ক্ষিত ঋণ দিতে না পারায় ব্যাংকের মুনাফা তুলনামূলকভাবে কমবে, সেটাও নিশ্চিত। যার সিংহভাগই আসে এর মাধ্যমে। মুনাফায় আঘাতের পাশাপাশি প্রতিদিনই খরচ বাড়ছে। যদিও কিছু ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি ফি ও চার্জ নেওয়ার। আমানত ধরে রাখতে গ্রাহককে নির্দিষ্ট হারে সুদ দিয়ে যেতে হচ্ছে। যা চাইলেই কমিয়ে দিতে পারে না ব্যাংক। ফলে খরচ কমানোর ভিন্ন কোনো উপায় আছে কি ব্যাংকগুলোর কাছে?
ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ১২ শতাংশ হলেও শেষ পর্যন্ত তা গিয়ে ঠেকে ১৫/১৬ শতাংশে। অবশ্য বিশেষ কিছু খাতওয়ারি ঋণ রয়েছে, যেগুলোর সুদহার তুলনামূলক কম। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীসহ সব মহলই সুদের হার কমানোর দাবি জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশে শ্রম যত সস্তা হোক না কেন, এত চড়া সুদে ব্যবসা করা সত্যিই দুরূহ। আর বাংলাদেশে ব্যবসা করার খরচ প্রতিবছরই বাড়ছে, যেটা আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে পিছিয়ে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ব্যবসাবান্ধব সূচকে দুই ধাপ অবনমন হয়েছে বাংলাদেশের। সবচেয়ে বড় বিষয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা কমলেও অনিশ্চয়তা এখনো দূর হয়নি। বিনিয়োগকারীরা কখনো এক-দুই বছরের চিন্তা করে বিনিয়োগ করেন না। নিদেনপক্ষে ১০/১২ বছরের কথা মাথায় রেখে বিনিয়োগ করেন। পুঁজির নিরাপত্তা না পেলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন, কিন্তু নতুন বিনিয়োগে যাবেন না কেউই। পুঁজির ধর্মই তাই। ঋণ পরিশোধসহ মুনাফা অর্জনের পথে হাঁটতে এর চেয়ে কম সময়ে সম্ভব নয়। আর দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ না হওয়ায় বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না বিদেশিরাও। আবার বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে প্রভাবিত হয় দেশের বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই রসায়ন খুবই মেনে চলেন দেশি-বিদেশিরা।
যদিও অর্থনীতির সাধারণ হিসাব-নিকাশ বলছে, চাহিদা কমলে দাম কমবে। কিন্তু বাংলাদেশ যেন উল্টো পথে হাঁটছে! চাহিদা নেই, নগদ টাকার সয়লাবের পরও সুদের হার কমার লক্ষণ নেই। অস্বস্তিকর এই পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ব্যবসায়ীদের নেওয়া বিদেশি ঋণ। এখন পর্যন্ত কমবেশি আট বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। যার সুদ হার বলতে গেলে দেশীয় ব্যাংক ঋণের সুদের হারের চার ভাগের এক ভাগ! ব্যবসায়ীদের জন্য এটা সুখের হলেও দেশের জন্য হতে পারে ঝুঁকিপূর্ণ। সময়মতো পরিশোধ না করলে খারাপ ঋণে পরিণত হলে ভাবমূর্তি নষ্ট হবে দেশের। আর উল্টো দিকে সুদের হার ন্যূনতম ৪ শতাংশ হলেও তা পরিশোধ করতে হবে ডলারে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরে কিছুটা হলেও চাপ তৈরি করবে। অথচ হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে প্রায় এক কোটি প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই তরতর করে বাড়ছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ, যা ২৬ থেকে ২৭ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে। অনেকেই হয়তো মনে করতে পারেন, এতে ব্যাংক উদ্যোক্তারা চাপে পড়বে আর এর মাধ্যমে ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনতে বাধ্য হবে! এ ভাবনা খুব বাস্তবসম্মত হবে বলে মনে হয় না।
সাধারণভাবে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকাটা জরুরি। বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের বেশি সময় আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। ফলে রিজার্ভ মুদ্রার একটা অংশ দেশে বিনিয়োগের দাবি জোরালো হচ্ছে। এতে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা কমত। বিদেশে রাখা বাংলাদেশি বৈদেশিক রিজার্ভ থেকে মাত্র ১ শতাংশ বা তার চেয়ে কম সুদ পাওয়া যায়। অন্যদিকে বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণের সুদহার ৪ শতাংশ। ফলে রিজার্ভের কিছু অংশ দেশে ঋণ দেওয়া অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। নিশ্চয় ঝুঁকি আছে, তবে বিদেশি ঋণের চেয়ে অনেক কম। তার মানে যেনতেন কাউকে নয়, প্রকৃত বিনিয়োগকারী এবং টেকসই বিনিয়োগের খাত দেখেই এ ঋণ দিতে হবে।
ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণে আগ্রহী করতে তুলে দুই সপ্তাহ ধরে রিভার্স রেপোর মাধ্যমে টাকা নেওয়া বন্ধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংবাদমাধ্যমে আসা সেই খবর নতুন করে চাপ তৈরি করবে ব্যাংকগুলোর ওপর। একদিনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো টাকা ধার নেয়, তাকে বলে রেপো। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে সুদ গুনতে হয় ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। একইভাবে ব্যাংকগুলোও বাড়তি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে, যাকে বলে রিভার্স রেপো। এতে ২ শতাংশ কমে সোয়া ৫ শতাংশ সুদ পায় রিভার্স রেপোতে টাকা রাখা ব্যাংকগুলো। সাময়িক এই বন্ধের কারণে অলস টাকা নিয়ে আরো বেশি সংকটে পড়বে ব্যাংকগুলো। কারণ, গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া আমানতের সুদ দিতে হয় ন্যূনতম সাড়ে ৬ শতাংশ। প্রতিটি ব্যাংকেই অলস টাকার এই ছড়াছড়িতে ব্যাংকে টাকা ধার নেওয়ার মার্কেট বা কলমানির বাজারও বেশ মন্দা। ধার ব্যবসাও বন্ধ। সব মিলিয়ে চতুর্মুখী সংকটে ব্যাংকিং খাত। ব্যাংক যে আমানত সংগ্রহ করে, তার কিছুটা জমা রাখতে হয় বিধিবদ্ধ নিয়মের কারণে। ১০০ টাকা সংগ্রহ করলে ১৯ টাকা জমা রেখে বাকি ৮১ টাকা ঋণ দিতে পারে ব্যাংক। কিন্তু বিনিয়োগ না হওয়ায় সেই ৮১ টাকার জায়গায় ৭০ টাকাও ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো, যা বাড়িয়ে দিচ্ছে অলস টাকার আকার।
সাম্প্রতিক বছরগুলো খেলাপি ঋণ বেশ আগের চেয়ে যথেষ্ট বেড়েছে। সুদের হার উসকে দেওয়ার পেছনে অনেকাংশে দায়ী এই ঋণ লোপাট সংস্কৃতি। সেই পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি না হলে ঋণ দেওয়ার হার বাড়বে না। আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা পুরোপুরি দূর না হলে জোর করে বিনিয়োগে আসবে না ব্যবসায়ীরা। ফলে জোর করে ঋণ বিতরণে বাধ্য করার ফলাফল খুব বেশি সুখকর হবে, তা বলা যায় না; বরং বিদ্যমান সংকট আরো ঘনীভূত হওয়ার শঙ্কাও আছে। আর ব্যাংকিং খাতের নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো অর্থনীতিতে।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, যমুনা টেলিভিশন।