পৌর নির্বাচন
জয়ী হোক গণতন্ত্র
উত্তরপাড়াতে নৌকা তো দক্ষিণ পাড়ায় ধানের শীষ। কেউ আবার আওয়াজ তুলবে লাঙল কিংবা অন্য কোনো প্রতীক নিয়ে। তবে সব ছাপিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু নৌকা-ধানের শীষ। গত সাত বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিএনপি নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা থাকলেও নৌকা-ধানের শীষের এমন তক্কাতক্কি শুনেনি এ দেশের মানুষ। দলীয় প্রতীক ছাপিয়ে এ সাত বছরে যা আলোচনা ছিল তার সবটুকুই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে।
সাত বছর পর মাঠে-ঘাটে শহরের অলিতে-গলিতে আলোচনা হচ্ছে নৌকা-ধানের শীষের। কথা কাটাকাটি হবে চায়ের কাপে। হয়তো শীতের মাঠ থেকে তুলে আনা ধানের শীষ, কিংবা পাল তোলা নৌকার ডামি নিয়েও চলবে নানা প্রচার-প্রচারণা। সাত বছর পর এমন নির্বাচন, মানুষের আগ্রহটা তাই একটু বেশিই।
দলীয় ভিত্তিতে পৌর নির্বাচনের প্রশ্নে সবার আগে আসে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রসঙ্গ। উপরের আলোচনা এ কারণেই প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে, কারণ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দল ৪০টি থাকলেও এবারের ভোটে নাম লিখিয়েছে মাত্র তার অর্ধেক। তাও আবার এবারের ভোট হওয়া ২৩৪টি পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে অন্য প্রায় দল সব দলই প্রার্থী দিতে পারেনি। আর দেশের প্রধান বিরোধী দলের তকমা যাদের গায়ে সেই জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিয়েছে মাত্র ৯১ পৌরসভায়।
আর বাকী ১৭টি দলের অবস্থা তো আরো করুণ। মেয়র পদে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী দিয়েছে ৬১ জন। সরকারের অংশীদার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের প্রার্থী আছে মাত্র ২৬ জন, জাতীয় পার্টি (জেপি) ৬ জন, ওয়ার্কার্স পার্টি ৯ জন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি ৪ জন, ন্যাশন্যাল পিপলস পার্টি- ১৭ জন, খেলাফত মজলিশ আটজন, ইসলামী ঐক্যজোট তিনজন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট চারজন, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি দুজন প্রার্থী দিয়েছে। এ ছাড়া বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, প্রগতিশীল গনতান্ত্রিক দল-পিডিপি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপের মাত্র একজন করে প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
মেয়র পদে মোট মনোনয়ন জমা পড়েছিল এক হাজার ২১৯টি। এরমধ্যে দলীয় ৭১১টি ও স্বতন্ত্র ৫০৮টি। সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে দুই হাজার ৬৬৮ এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দেয় নয় হাজার ৭৪১ জন প্রার্থী।
যাচাই বাছাই শেষে ৮৬৩টি মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে মেয়র পদে ১৩৫, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৫৭২ এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ১৫৬টি মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। ফলে কোথাও কোথাও মেয়র কাউন্সিলর পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও নির্বাচিত হওয়ার খবর মিলেছে। তাদের প্রায় সবাই সরকারি দল সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী।
সারাদেশে ২৩৬ পৌরসভায় ভোট হওয়ার কথা থাকলেও তফসিল ঘোষণার পর বিভিন্ন জটিলতায় হাইকোর্টের নির্দেশে মংলা ও মানিকগঞ্জের সিংগাইর পৌর নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। পরে অবশ্য সিংগাইরের নির্বাচনের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারও হয়েছে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরুতে থেকে কোনো কোনো দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও নির্বাচন কমিশনের ওপর তাদের অনাস্থার কথাও বলেছেন। কেউ কেউ আবার বলেছেন এ নির্বাচন ইসির জন্য এসিড টেস্ট। কেননা সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচনে নানা অনিয়ম-কারচুপির ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
নির্বাচনে কাগজ-কলমে ২০ দলের অংশগ্রহণ থাকলেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি। সূক্ষ্মভাবে যদি বিশ্লেষণ করা হয় মূলত এবারের পৌর নির্বাচনে পক্ষ তিনটি। তার প্রথম পক্ষ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা সরকার, দ্বিতীয় পক্ষ সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল বিএনপি। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষটি হলো নির্বাচন কমিশন; যাদের ওপর মূল দায়িত্ব নির্বাচন সুষ্ঠু করার।
প্রথম পক্ষ অর্থাৎ আওয়ামী লীগ কিংবা তার সরকার যদি বাহুবলে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা না করে নির্বাচন কমিশন সহায়তা করে তাহলে নৈতিকতার মানদণ্ডে তারাই হবে বিজয়ী। অভিযোগ আর অনুযোগ থেকে বের হয়ে এসে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে জনসমর্থন আদায় করে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে লড়তে পারাটাই হবে বিএনপির বিজয়। সে হিসেবে সুষ্ঠু ভোটের অঙ্কে দলটির পিছিয়ে থাকার কথা নয়। শেষ পক্ষ নির্বাচন কমিশনই মূল নিয়ামক। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য নির্বাচন। একে প্রশ্নবিদ্ধ না করে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে শেষ করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তারা যদি সেই কাজ করতে পারে, তাহলে এ নির্বাচনে আসল জয়ী হবে নির্বাচন কমিশন। যে জয় মূলত গণতন্ত্রেরই। ৩০ ডিসেম্বরের ভোটে জয়ী হোক গণতন্ত্র।
লেখক : সংবাদকর্মী, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।