সামাজিক যোগাযোগ
ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড ও আমাদের ফেসবুক
২২ দিন বন্ধ রাখার পর যেদিন ফেসবুক খুলে দেওয়া হলো, সেদিনই আটক হয়েছেন ফেসবুক পেজ ‘মজা লস’-এর অ্যাডমিন রাফায়েত। গণমাধ্যমে RAB-এর পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কটূক্তি ও অপপ্রচারের অভিযোগে তাঁকে আটক করা হয়েছে।
এই ঘটনার দ্বারা এটি খুব পরিষ্কার যে, ফেসবুক খুলে দেওয়া হলেও, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের ওপর সরকারের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ আগের চেয়ে বাড়বে। উল্লেখ্য, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপসহ ইন্টারনেটভিত্তিক অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এখনো বন্ধ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েল গ্রিন সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত এগুলো খুলবে না বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখনই গ্রিন সিগন্যাল দেবে, যখন তাদের কাছে মনে হবে যে, জাতীয় নিরাপত্তায় এসব মাধ্যম হুমকি নয়।
গত ১-৪ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিয়ন শহরে জাতিসংঘের APCICTএর আয়োজনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক যে আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়েছে, সেখানে একটি কী নোট পেপারে বলা হয়েছে, ২০০০ সালে যেখানে সারা বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৪০ কোটি, ২০১৫ সালে তা হয়েছে ৩২০ কোটি। এর মধ্যে ২০০ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী উন্নয়নশীল বিশ্বের। বিশ্বের ১৯২টি দেশে এখন থ্রিজি প্রযুক্তি চালু হয়েছে, যা সারা বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে কাভার করছে। আর যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তাদের বলা যায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে।আর এই ব্যবহারকারীদের জন্য রয়েছে প্রায় ১০ লাখ অ্যাপস যা এরই মধ্যে ১০ হাজার কোটি বারেরও বেশি ডাউনলোড হয়েছে।
আইডিয়াকর্পের প্রধান নির্বাহী ইমানুয়েল সি লালানা তাঁর ‘কি নোট’ পেপারে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ২০১৪ সালে সারা বিশ্বে প্রতি মিনিটে ২০৪ মিলিয়ন অর্থাৎ ২০ কোটি ৪০ লাখ ইমেইল আদান-প্রদান হয়েছে, ফেসবুক পোস্ট আপলোড হয়েছে ২০ লাখ ৪৬ হাজার, টুইট হয়েছে দুই লাখ ৭৭ হাজার আর ইউটিউবে নতুন ভিডিও আপলোড হয়েছে ৭২ হাজার।
এই যখন সারা বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের চিত্র, তখন কোনো যুক্তিতেই ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্য বন্ধ করে দেওয়ার সুযোগ নেই। ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম কেবল সেই সব দেশেই বন্ধ, যেসব দেশ বস্তুত রক্ষণশীল ও কট্টরপন্থী বলে পরিচিত এবং যেখানে ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজমান। সুতরাং একটি উদার গণতান্ত্রিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের সরকার যখন ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেয় জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে, তখন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের একটি নেতিবাচক ব্র্যান্ডিং তৈরি হয় এবং এটি মনে করার সঙ্গত কারণ তৈরি হয় যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকিতে রয়েছে; যা রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের ভীত করে তোলে।
তবে এটি ঠিক যে, জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মানবিতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেওয়ার পরে তাকে চাঁদে দেখা গেছে বলে যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যার ফলে কিছু মানুষের প্রাণও গেছে, সেই হুজুগ ও গুজব ছড়িয়ে দেওয়ায় কাজে লাগানো হয়েছিল ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকেই। ফলে এবারও যখন অত্যন্ত প্রতাপশালী রাজনীতিবিদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হলো, তখনও তাঁদের অনুসারীরা সাঈদীর মতো কোনো গুজব ছড়িয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে-এমন আশঙ্কা থেকেই সম্ভবত সরকার ফেসবকু বন্ধ করে দেয়। ১০ ডিসেম্বর দুপুরে ফেসবুক খুলে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার পরই এ নিয়ে নানারকম প্রতিক্রিয়া ও রসিকতা করে স্ট্যাটাস দেন নানা শ্রেণিপেশার মানুষ।
কেউ কেউ এমনটিও লিখেছেন যে, মাথা ব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলা কোনো সমাধান হতে পারে না। বরং মাথা কেন ব্যথা হয় সেটির কারণ বের করতে হবে। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বন্ধ রেখে আর যাই হোক ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না। প্রযুক্তিকে এড়িয়ে নয়, বরং আমাদের এগিয়ে যেতে হবে প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে।
আবার যেহেতু এই ২২ দিন বিকল্প উপায়ে অর্থাৎ ভিপিএন নামে একটি প্রক্সি সার্ভার দিয়ে ফেসবুক ব্যবহার করেছেন, তাই ফেসবুক খুলে দেওয়ার পর অনেকে রসিকতা করে লিখেছেন, ‘গুডবাই ভিপিএন’। অনেকে ভিপিএনকে ‘দুঃসময়ের বন্ধু’ বলেও উল্লেখ করেছেন। যদিও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, এই বিকল্প উপায়ে ফেসবুক ব্যবহার করা বেআইনি। অথচ একই সময়ে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী এবং নীতি নির্ধারকও বিকল্প উপায়ে ফেসবুক ব্যবহার করেছেন। এমনকি জাতীয় সংসদেও ফেসবুক খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন একাধিক সংসদ সদস্য। তা ছাড়া ভিপিএনও যেহেতু একটি প্রযুক্তি, তাই কেউ যদি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফেসবুক ব্যবহার করে, সেটিকে অবৈধ বলা যাবে কি না- তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
তবে বিকল্প উপায় থাকলেও যেহেতু বহু সংখ্যক মানুষ এই ২২ দিন ফেসবুক থেকে দূরে ছিলেন, ফলে এর দ্বারা অনেকেই অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে যারা অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসা করেন, তারা তাদের ক্রেতাদের কাছে যেতে পারেননি। ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য ও সেবার বিপণন করা প্রতিষ্ঠানের বিক্রি প্রায় ৬০ শতাংশ কমে যায় বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
অথচ ইন্টারনেট তথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মূল দর্শনই হলো মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ানো। সুতরাং কিছু দুষ্কৃতকারী, কিছু খারাপ লোকের ভয়ে ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়ার ফলে যে নিরপরাধ মানুষগুলো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হলো, তাদের ক্ষতিপূরণের কোনো ব্যবস্থা নেই।
এখন বলাই হয়, Social media is not only about connection, but about sharing… অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম কেবল এক ধরনের সম্পৃক্ততাই নয়, বরং এর মূল লক্ষ্য আদান-প্রদান। এই আদান-প্রদান চিন্তার, এই আদান-প্রদান ভাবের, দর্শনের এবং ভিন্ন মতের।
ভিন্ন মতই হচ্ছে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সুতরাং সরকার যদি মনে করে যে, সবাই শুধু তার কাজের প্রশংসাই করবে, তাহলে তার ভুলগুলো আড়ালেই থেকে যাবে এবং জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের ভিত্তি হবে ভয়। ভয়ের সংস্কৃতি চালু রেখে কখনো প্রকৃত উন্নয়ন হয় না।
সুতরাং চিহ্নিত কিছু খারাপ লোকের ‘ভয়ে’ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া কোনো সমাধান নয়; বরং এই মাধ্যমকে কীভাবে আরো বেশি শক্তিশালী করা যায়, সরকার এই মাধ্যম ব্যবহার করে কীভাবে আরো বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে যেতে পারে, কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়াকে সরকার তার স্বচ্ছতা ও জবাবিদিহিতা নিশ্চিতের একটি মাধ্যম এবং সরকার ও জনগণের একটি অভিন্ন প্লাটফর্ম হিসেবে গড়ে তোলা যায়- এখন বরং সেই ভাবনাটাই জরুরি।
এখন উন্নত বিশ্বই শুধু নয়, তথ্যপ্রযুক্তিতে মোটামুটি অগ্রসর দেশগুলোও সুশাসন প্রক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে এত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে যে, এ নিয়ে রীতিমতো নানা গবেষণা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সরকার এখন ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তাদের একটি অন্যতম বড় তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করছে; যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের কাছ থেকে সরাসরি মতামত ও পরামর্শ নেওয়া সম্ভব। সেইসাথে উন্নয়ন তথা নীতি নির্ধারণেও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হচ্ছে এবং সরকারের সব বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনগণের একটি আন্তসম্পর্ক তৈরি হচ্ছে; যেটি টেকসই উন্নয়নের একটি অন্যতম প্রধান শর্ত।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর