বিজয়ের ৪৪ বছর
অর্জন অপ্রাপ্তির দ্বৈরথ
‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো’। গত ১৩ ডিসেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর এই মন্তব্য স্রেফ বাংলাদেশকে খুশি করার জন্য যে নয়, তা তিনি তাঁর বক্তৃতায় বেশ কিছু রেফারেন্স দিয়ে বলেছেন। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করেও দেখিয়েছেন। তিনি এর আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৯২ সালে। এই ২৩ বছরে মাথাপিছু আয়, জিডিপির প্রবৃদ্ধিসহ অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে, তা অকপটেই স্বীকার করে নেন এই অর্থনীতিবিদ।
পরদিন ১৪ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে একান্ত বৈঠক শেষে কৌশিক বসু সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের নতুন মাত্রা তৈরি হচ্ছে। যার নাম দিয়েছেন তিনি ‘অংশীদারত্ব’। বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন আর নিম্ন আয়ের দেশের কাতারে নেই। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ভারতও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ এখনো।’
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে আগামী অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এ বিষয়ে বসু বলেন, ‘আজকের পৃথিবীতে চারদিকে যেখানে প্রবৃদ্ধি নিম্নগামী, সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনের চিত্র সত্যিই উল্লেখ করার মতো।’
একই দিন, অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল-ইউএনডিপি ২০১৪ সালের বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন সূচকের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানেও দেখানো হয়েছে, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি আর শিশুমৃত্যুর হার কমানোয় ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়েছে। যদিও সার্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান গতবারের মতোই ১৪২তম।
কাকতালীয়ভাবে এদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ২৭ বিলিয়ন ডলার।
এই বাস্তবতায় পালিত হচ্ছে বাংলাদেশের বিজয়ের ৪৪তম বার্ষিকী। তবে অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় এবারের বিজয় দিবসের তাৎপর্য অনেক বেশি। কেননা শীর্ষ একাধিক যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের দায় মেটানোর চেষ্টা চলছে।
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে শহীদ পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, ‘তাদের কাছেও এবারের বিজয় দিবস এসেছে এক অন্য মহিমায়।’ একজন বলেছেন, যেদিন কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের খবর তিনি শুনেছেন, সেদিন একটা লম্বা শ্বাস তাঁর বুক থেকে বেরিয়ে গেছে। যেটি আটকে ছিল বহুদিন।
২.
২০০৬-২০০৯ সময়কালে বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক মহামন্দা চলছিল, তখন অনেকের মনেই এই আশঙ্কা জেগেছিল যে, এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সক্ষমতা বাংলাদেশের তো নেই-ই; বরং অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যে ভীষণ ধাক্কা খাবে, তা কাটিয়ে উঠতে বহু বছর লাগবে। কিন্তু দেখা গেল, বৈশ্বিক মন্দার সেই পরাক্রমশালী ঢেউ বাংলাদেশ অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গেই মোকাবিলা করেছে এবং ওই পরিস্থিতিতেও যে গুটিকয় দেশ সামষ্টিক আয়ের প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম।
বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন দারিদ্র্য নিরসন। ১৯৭২ সালে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিলেন শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ। ১০ বছর আগে যা ছিল ৪২ ভাগ; এখন সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ ভাগে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণও বেড়েছে। নারী এখন শুধু আয়ের উৎসই নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও তাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে আশানুরূপভাবে।
স্বাধীনতা-উত্তর চার দশকে খাদ্য উৎপাদনে যুগান্তকারী উন্নয়ন করেছে বাংলাদেশ। ১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে খাদ্য উৎপাদন ছিল ১০ মিলিয়ন মেট্রিক টন, বর্তমানে তা প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশে ১৬ কোটি মানুষ খেয়েপরে বেঁচে আছে। প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন আর কারো না খেয়ে মরার খবর মেলে না।
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরেই এখন অবস্থান বাংলাদেশের। প্রতিবছর বাংলাদেশ ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করছে, যা সামগ্রিক রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিসহ আরো নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
বলাই হয় যে উন্নয়নের মূল শর্ত উৎপাদন। আর উৎপাদনের মূল শর্ত বিদ্যুৎ-জ্বালানি। বছর কয়েক আগেও যেখানে বিদ্যুৎ নিয়ে দেশব্যাপী হাহাকার ছিল, সেই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত বছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৪৭১ মেগাওয়াট। সেখানে বর্তমানে উৎপাদনক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ২৭১ মেগাওয়াটে। সরকার আগামী বছরের মধ্যে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়। সরকারি হিসাব বলছে, বর্তমানে দেশে এক কোটি ৭০ লাখ বিদ্যুৎ গ্রাহক আছেন। এর মধ্যে কৃষিকাজে নিয়োজিত সেচগ্রাহকের সংখ্যা তিন লাখ ৬০ হাজার।
বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে অনেক সময়ই হতাশা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘জাপানের শতকরা ৭১ ভাগ কোম্পানি বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক। আর চীন চায় বাংলাদেশের সব মেগা প্রকল্পে সহযোগিতা দিতে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসেবে প্রতিবেশী দেশ ভারতও চায় বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলোর সমঝোতামূলক সমাধান।’ এ ক্ষেত্রে ছিটমহল বিনিময়ের মতো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেছে এরই মধ্যে। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে যে টানাপড়েন রয়েছে, সেটিরও দ্রুত সুরাহা হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী দুই দেশের সরকার। আর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যত আপত্তিই থাকুক না কেন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় তারা বাংলাদেশের সঙ্গে একযোগে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে একাধিকবার।
৩.
বাংলাদেশের এ রকম সাফল্যের গল্প লিখতে গেলে তার ফিরিস্তি দীর্ঘই হবে। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশকে আমাদের অপ্রাপ্তির তালিকাও ছোট নয়। এই চার দশকেও আমরা দেশে আইনের শাসন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারিনি। গণতন্ত্রের নামে নিয়মিত বিরতিতে ভোট হলেও তা ব্যালটতন্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। গণতন্ত্রের যে মূল স্পিরিট পরমতসহিষ্ণুতা, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং শাসন প্রক্রিয়ায় সরাসরি জনগণের অংশগ্রহণ- তা এখনো অধরাই থেকে গেছে।
আমলাতন্ত্র আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো ঠিক জনগণের হয়ে উঠতে পারেনি। সরকারি কর্মকর্তারা এখনো নিজেদের জনগণের সেবক ভাবা শুরু করেননি। ফলে তারা যে জনগণের করের পয়সায় বেতন পান, সেই জনগণকেই সেবা দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষ নেন প্রকাশ্যে, নির্লজ্জভাবে। দুর্নীতিকে উৎসাহ দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয়ভাবেই।
সংবিধান আমাদের চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার অধিকার দিলেও ভিন্ন মত পোষণকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। লেখনীর জবাব এখনো ধারালো এবং আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে দেওয়া হয়। ধর্মীয় উন্মাদনা আর গোঁড়ামির শেকল এখনো যথেষ্ট মজবুত। আবার ভোটের হিসাব কষে তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মৌলবাদী আর কট্টরপন্থী দলগুলোর ‘সিমবায়োসিস রিলেশন’ (মিলেমিশে থাকা) এখনো আমাদের পীড়া দেয়।
আমরা মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে শিখিনি এখনো। রিকশাচালককে ‘তুই’ বলাই এখানে নিয়ম। আমাদের নাগরিক বোধ বা সিভিক সেন্স এখনো বহুদূর। আমরা মানুষের চলাচলের পথ ফুটপাতে মোটরসাইকেল উঠিয়ে দিই এবং উচ্চ আদালতকে এ বিষয়ে রুল জারি করে বলতে হয়, ‘ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানো কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না?’
আমাদের নগরীগুলো এখনো মানুষের জন্য নিরাপদ নয়। আমাদের নারীরা সন্ধ্যার পরে একা রাস্তায় বেরোলে শঙ্কায় থাকে। পাবলিক বাসে ‘পুরুষ লোকেরা’ সুযোগ পেলেই তাদের গায়ে হাত দেয়। ট্রাফিক জ্যামে বসেও আমরা অসভ্যের মতো যানবাহনের হর্ন বাজাই। আমাদের ধনীর দুলালরা মোটরসাইকলে ও প্রাইভেট কারের সাইলেন্সার পাইপ খুলে মহিষের মতো গোঁ গোঁ শব্দে ছুটে চলে। তাতে অন্য কেউ বিরক্ত হলো কি হলো না, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। তারা অনেক স্মার্ট। ইংরেজি জানে।
আমরা স্বীকার করি বা না করি, আমাদের রাষ্ট্রের ভেতরে ভেতরে ঘুণ পোকার মতো বাসা বেঁধেছে উগ্রবাদ, মৌলবাদ এবং যার পরিণতি জঙ্গিবাদ। আমরা আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের মধ্যেই রয়েছি। যার আলামত কিছুদিন পরপরই আমরা পাই। সুতরাং দেশে আইএসের অস্তিত্ব থাকুক বা না থাকুক, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ যে দেশে আছে, সেটি অস্বীকার করলে ভবিষ্যতে এর করুণ মাশুল দিতে হবে আমাদের সবাইকে। সেখানে রাজনীতিবিদ, আমলা কিংবা প্রশাসনের কেউ বিশেষ সুবিধা পাবেন বলে মনে হয় না। অতএব ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই আমাদের এই অপ্রাপ্তি আর শূন্যতাগুলো পূরণ হবে- এই আশাবাদ চুয়াল্লিশে আমাদের মায়ের কাছে।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর