পৌর নির্বাচন
৩০ ডিসেম্বর এবং তারপর…
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাজাহান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না, সেটি প্রমাণের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আমাদের।’ এ বক্তব্যের মাধ্যমে এটি ধারণা করা অমূলক নয় যে, ভোটের মাঠে বিএনপি হয়তো শেষ পর্যন্ত থাকবে না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো আগামী ৩০ ডিসেম্বর হতে যাওয়া পৌর নির্বাচনেরও মাঝপথে, অর্থাৎ দুপুরের পর হয়তো বিএনপি প্রার্থীরা ‘ভোট ডাকাতি হচ্ছে’ অভিযোগ তুলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন। কেননা, বিএনপি যে এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে কেবল তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলনের একটি নতুন ইস্যু তৈরির জন্য, সেটি দলের নেতাদের কথায় এরই মধ্যে স্পষ্ট। যদিও দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৫ ডিসেম্বর পৌর নির্বাচন সমন্বয়ের জন্য গঠিত বিএনপির কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলের প্রথম বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনের মাঝপথ থেকে বিএনপির সরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, ‘মাঝপথ থেকে ফিরে আসার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। একেবারে ফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত সবাই অ্যাক্টিভলি মাঠে থাকবেন বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
এটি খুবই আশার কথা। তবে মির্জা ফখরুলের এ বক্তব্যের পর সরকারের দায়িত্ব বেড়ে গেছে অনেক। এ কারণে যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি থেকে সরে এসে বিএনপি যে পৌর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছ, এটি সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। কেননা, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, যেহেতু একটি সরকার ক্ষমতায় রয়েছে এবং দেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন স্থিতিশীলতা খুব জরুরি। আর এটি সরকারের একার ওপর নির্ভর করে না। সুতরাং বিএনপি পৌর নির্বাচনের শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবে বলে যে ঘোষণা দিয়েছে, সে বক্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে, ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা এবং জনগণ যাতে নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন এবং সর্বোপরি একটি ভালো নির্বাচন হয়, সে ব্যবস্থা করা। এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে। ফলে পৌর নির্বাচন নিয়ে কেন্দ্র ও প্রান্ত—উভয় জায়গার রাজনীতি সরগরম। বক্তৃতা-বিবৃতি, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলছে ভোটের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারে বাধা ও হামলা, এমনকি কোনো কোনো প্রার্থীকে তুলে নিয়ে জোর করে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করার অভিযোগের খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। ১৪ ডিসেম্বর প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ হয়েছে। দলীয় প্রার্থীদের প্রতীক যেহেতু আগে থেকেই নির্ধারিত, তাই প্রতীক পাওয়ায় নির্বাচন প্রচারে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে স্বতন্ত্র এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের। যাঁরা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে পাননি কিন্তু ভোটের লড়াইয়ে আছেন, তাঁদের বিদ্রোহী প্রার্থী বলা হলেও বস্তুত তাঁরাও স্বতন্ত্র প্রার্থী।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর বিএনপি বিদ্রোহীদের নিষ্ক্রিয় করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নির্দেশ দিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে তারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের দল থেকে বহিষ্কার করবে না বলে জানিয়েছেন দলের একাধিক নেতা। এর একটি কারণ হতে পারে এই যে, যাঁরা মেয়র পদে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি, তাঁদের অনেকেই স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা। সুতরাং ভবিষ্যতে সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁদের প্রয়োজন হবে। সে কারণে তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করে তৃণমূলে বিএনপির শক্তি খর্ব করার ঝুঁকি নিতে চায় না হাইকমান্ড। এর আরেকটি কারণ, তৃণমূলে বিএনপি এখন খুব শক্তিশালী নয়। বিভিন্ন মামলায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অগণিত নেতাকর্মী।
এখন কথা হলো, ৩০ ডিসেম্বরের ভোটে আসলে কী হবে? বিএনপি নেতারা আগে থেকেই বলে আসছেন, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি এবং হবেও না। তার পরও তাঁরা পৌর নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, যদি বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ না নিত, তাহলে সরকার বিএনপিকে জঙ্গি দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করত। কিন্তু যখন পরপর দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যা, হোসেনী দালান, শিয়া মসজিদ ও একাধিক মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে, যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে, তখন এই জঙ্গি তকমা গায়ে মাখার ঝুঁকি নিতে চায় না বিএনপি। শুধু তা-ই নয়, এবার পৌর নির্বাচনে বিএনপির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতের সঙ্গেও তাদের কোনো ঐক্য নেই বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতা মো. শাজাহান। বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে একটা বিষয় পরিষ্কার, এই নির্বাচন সামনে রেখে তাঁরা নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি জাতীয় নির্বাচনের দাবি তুলবেন। যে দাবিতে অনেক দিন ধরে ‘ঝিমিয়ে থাকা’ দলকে চাঙ্গা করার একটা প্রচেষ্টা বিএনপির থাকবে। সেই প্রচেষ্টা নতুন করে কোনো রাজনৈতিক সহিংসতার জন্ম দেবে কি না, তা এখনই বলা কঠিন।
ধারণা করা যায়, পৌরসভায় যদি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মতো ভোট হয়, তাহলে ভোটের দিন দুপুরের মধ্যেই বিভিন্ন স্থান থেকে খবর আসতে শুরু করবে যে, বিএনপি প্রার্থীরা ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এবং বিকেলে ঢাকায় দলের হাইকমান্ড একটি সংবাদ সম্মেলন করে বলবে, ‘ব্যাপক ভোট ডাকাতি হয়েছে। ফলে এটি আবারো প্রমাণিত হলো যে, এই সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’ কাছাকাছি সময়ে ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে আরেকটি সংবাদ সম্মেলনে কোনো একজন সিনিয়র নেতা বলবেন, ‘ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে।’ পরের দিন নির্বাচন কমিশন একটি হিসাব দিয়ে বলবে, এত পার্সেন্ট (অবশ্যই সেটি ৬০ শতাংশের বেশি) ভোট পড়েছে। ভোটের এই রাজনীতি এবং পৌনঃপুনিক চিত্রায়ণ দেশের মানুষের মুখস্থ হয়ে গেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, পৌর নির্বাচন বা অন্য কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারের পতন হয় না; তার পরও কেন এ নিয়ে সরকার ও বিরোধীরা এত বেশি মারমুখী ও সিরিয়াস হয়ে ওঠে? কেন তৃণমূলের এই নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে হয়ে কেন্দ্রের রাজনীতি? এর একটি বড় কারণ ‘ভয়’। সরকারের ভয় এই যে, যদি স্থানীয় নির্বাচনে বেশি সংখ্যায় বিরোধী পক্ষের প্রার্থীরা জিতে যান, সে ক্ষেত্রে সরকারের ওপর একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয় যে, তাদের জনপ্রিয়তা কমে গেছে। যেটি হয়েছিল ঢাকার আগে অন্য সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনে। ওই নির্বাচনের ফলাফল বিএনপির পক্ষে যাওয়ায় স্বভাবতই তৃণমূলে বিএনপির ‘কোমরের জোর’ বেড়ে গিয়েছিল কয়েক গুণ। যদিও বিএনপির ওই মেয়রদের পরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার পৌরসভায়ও যদি দেখা যায় ৭০ শতাংশের বেশি জায়গায় বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন, তাতে সরকার পতন হবে না ঠিকই; কিন্তু সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির যৌক্তিকতা প্রমাণ হবে এবং এটি আন্তর্জাতিক মহলেও বোঝাতে সক্ষম হবে যে, তারা যৌক্তিক দাবিতেই আন্দোলন করছে এবং জনগণ তাদের সঙ্গে আছে। ফলে সরকার চাইবে অধিকাংশ জায়গায় তাদের দলের প্রার্থীরা জিতুক।
দ্বিতীয়ত, যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় এবং বিরোধী পক্ষের লোকেরা জয়ী হয়ে মেয়র পদে বসেন, অধিকাংশই তাঁদের পৌরসভায় উন্নয়নমূলক কাজে খুব একটা মনোযোগ দিতে পারবেন না। কারণ, তাঁদের নামে এরই মধ্যে অসংখ্য মামলা রয়েছে। যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নেই, ভোটে জয়ী হওয়ার পর তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। ফলে গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁদের পালিয়ে বেড়াতে হবে। তা ছাড়া সরকারি দলের মেয়ররা তাঁদের পৌরসভার উন্নয়নের জন্য কেন্দ্র থেকে যে বরাদ্দ পাবেন, বিরোধী পক্ষের মেয়ররা যে সে পরিমাণ বরাদ্দ পাবেন না, তা মেয়ররাও জানেন। ফলে বিরোধী পক্ষের মেয়রদের এলাকার উন্নয়ন হবে সরকারি দলের মেয়রদের এলাকার তুলনায় অনেক কম। আখেরে বঞ্চিত হবে সংশ্লিষ্ট পৌরসভার নাগরিকরা। এ কারণেও সব সরকারই চায়, স্থানীয় সরকারে তাদের দলের প্রতিনিধিরাই থাকুক। আবার যদি নিজেদের দলের প্রতিনিধি রাখা সম্ভব না হয়, সেখানে একজন আমলাকে বসিয়ে দেওয়া হয় প্রশাসক হিসেবে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার সব সময়ই চায়, তৃণমূলে তার খবরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে। আর বিরোধীদের কাছে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন কী হলো-না হলো, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে তৃণমূলকে শক্তিশালী করা। ফলে ৩০ ডিসেম্বরের পৌর নির্বাচনে সরকারের মনস্তাত্ত্বিক ভয় নাকি বিএনপির আন্দোলনের নতুন ইস্যুর জয় হবে, তা এরই মধ্যে বিভিন্ন পৌরসভায় নির্বাচনী প্রচারের ধরন, প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, ভয়-ভীতি দেখানো এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে অনেকটা আন্দাজ করে নেওয়া যাচ্ছে। তবে দেশের মানুষ আশা করে, বিজয়ের মাসে হতে যাওয়া এই স্থানীয় সরকার নির্বাচন শেষ অবধি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। তারও চেয়ে বেশি প্রত্যাশা, নির্বাচনের পর একটি কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে পৌরসভাগুলো জনগণের জন্য সত্যিকারের আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠবে।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর