অর্থনীতি
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের গুরুত্ব ও স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো
অবশেষে নতুন বেতন কাঠামোর গেজেট হয়েছে গেল সপ্তাহে। ডিসেম্বর মাসের বেতন নতুন হিসাবে পাওয়ার আশায় দিন গুনছেন ১১ লক্ষাধিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। যদিও বাড়ি ভাড়াসহ ভাতা মিলবে দুই ধাপে আগামী জুলাই ও ডিসেম্বরে। পে কমিশনের সুপারিশের পর থেকে এ নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলনসহ একের পর সংশয়-দোলাচলে দুলতে থাকে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে। শিক্ষকদের বিষয়টি সুরাহা হলেও এখনো টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে গভর্নর ড. আতিউর রহমান দুঃখ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাতের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো না হওয়ায়। ব্যাংকিং খাতের জন্য এটা জরুরি ছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ব্যাংকের জন্য আলাদা পে স্কেল ‘দরকার নেই’ বলে ওই দিন তা উড়িয়ে দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ব্যাংকের কর্মকর্তারা কাজ বন্ধ করে আন্দোলনে নামতে পারেননি বলেই একবাক্যে তা নাকচ করে দেওয়া সহজ হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর বিষয়টি নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে মুলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এমনকি ব্যাংকের স্বতন্ত্র পে স্কেলের জন্য একটা খসড়া প্রস্তাব জমা পড়েছিল। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এখন তো সেই কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিলেন অর্থমন্ত্রী নিজেই।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ভারসাম্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ভূমিকা অত্যন্ত জোরালো। ২২ বছর পর বাংলাদেশ সফরে এসে এমন মন্তব্য করেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু। আপাদমস্তক পুঁজিবাদী চিন্তার ধারক-বাহক ও বেসরকারীকরণের উদ্বুদ্ধকারী অন্যতম প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকের অবদান তুলে ধরেন গণবক্তৃতায়। যদিও দেশের মধ্যে কেউ কেউ সোনালী, জনতাসহ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর বেসরকারীকরণের সুর তুলছেন। তাঁদের মতে, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ‘বেসরকারীকরণ’ই একমাত্র পথ! সরকারের নীতিনির্ধারকরাও মাঝেমধ্যে এমন আভাসে তাল মেলান। বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেতন-ভাতা অর্ধেকের কম পেয়ে আসছেন এসব ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী। অথচ যোগ্যতা সমান এবং সেবার ধরন একই রকম। একদিকে নিম্নস্তরের বেতন কাঠামো, অন্যদিকে অনলাইনসহ প্রযুক্তির আধুনিকায়ন না হওয়ায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলো। দক্ষ মানবসম্পদ পেতে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বেতন কাঠামোর বিকল্প নেই। এ জন্যই দীর্ঘদিনের যৌক্তিক দাবি ছিল, ব্যাংকগুলোর জন্য আলাদা বেতন কাঠামো প্রণয়নের। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের গতি আগের চেয়ে ভালো হতো। গ্রাহকসেবার মানও বাড়ত। কিন্তু আমলাদের কূটনীতির কাছে সেই সম্ভাবনা বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোকে সাধারণ ব্যাংকিং ছাড়াও রাষ্ট্রের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে তিন হাজার ৫৮৭টি শাখার মাধ্যমে। এর বাইরে বেসিক ও বিডিবিএলের শাখা রয়েছে আরো ১০০। মুক্তিযোদ্ধা-ভাতা, বয়স্ক-ভাতা, বিধবা-ভাতা প্রদান, সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর প্রকল্প, সরকারের বিভিন্ন ধরনের বিল গ্রহণ, বেতন-ভাতা প্রদানে ব্যস্ত থাকতে হয় তাঁদের। এ জন্য বসার জায়গা বৃদ্ধিসহ বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। ফলে গাদাগাদি করে কোনোরকমে বসে কাজ সারতে হয়, যেখানে ব্যাংকিং সেবা প্রদানের উপযুক্ত পরিবেশ থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা, এসব লেনদেনকারীর একটা অংশ অশিক্ষিত ও বয়োবৃদ্ধ, যাদের চেক লেখা থেকে ফরম পূরণে সহযোগিতা করতে হয় ব্যাংকারদের। সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা অনেক বেশি হলেও বিপরীতে লেনদেনের অঙ্কটা তুলনামূলক কম। হালে দু-একটি বিল গ্রহণ ছাড়া বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে এসব সেবা দিতে হয় না। সুসজ্জিত অফিস ও কম্পিউটারভিত্তিক অনলাইনে লেনদেনে দ্রুত গ্রাহকসেবা প্রদানের সুযোগ রয়েছে। বেতন বৈষম্যসহ এসব বিষয় আমলে না নিলে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তুলনামূলক আলোচনায় অনেক খণ্ডচিত্রই উঠে আসে।
সামাজিক দায়দায়িত্বের পাশাপাশি আরেকটি দিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো, বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের জন্ম হয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চারটি ব্যাংকের টাকায়। শত শত কোটি টাকার সম্পদের অধিকারী অনেকের পেটেই আছে এসব ব্যাংকের টাকা। তাঁদেরই অনেকেই সুর তুলছেন ব্যাংক বেসরকারীকরণের। ব্যাংকিং খাতের প্রতিযোগিতায় ভারসাম্য রাখছে এই সরকারি ব্যাংকগুলো—কৌশিক বসুর বক্তব্যের সমর্থনে ফি ও চার্জ-সংক্রান্ত দু-একটি তুলনামূলক তথ্য উপস্থাপন জরুরি। সরকারি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট চার্জ ২৫ টাকা। বিপরীতে বেসরকারি ব্যাংকে তা ন্যূনতম ২৫০ টাকা। যদিও এ তথ্য সংরক্ষণে বাড়তি কোনো খরচ নেই, প্রিন্ট খরচ ছাড়া। একইভাবে ডিমান্ড ড্রফট-ডিডি ও পে অর্ডারের মাধ্যমে এক হাজার টাকা পাঠাতে সরকারি ব্যাংকের চার্জ ২০ টাকা, বেসরকারি ব্যাংকে তা ৫০ থেকে ১০০ টাকা। তার পরও সব বেসরকারি ব্যাংকের সব শাখায় পে অর্ডার করতে অনীহা দেখা যায়। অ্যাকাউন্টে পাঁচ হাজার টাকার নিচে থাকলে মেইনটেন্যান্স ফি কাটা হয় না সরকারি ব্যাংকে। ৫ থেকে ২৫ হাজার পর্যন্ত বছরে ২০০ টাকা, এর বেশি হলে ৬০০ টাকা কাটে। অথচ বেসরকারি ব্যাংকের প্রতিটি অ্যাকাউন্ট হোল্ডারকে গুনতে হয় ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা। চলতি বা সিডি অ্যাকাউন্টের জন্য ন্যূনতম চার্জ দুই হাজার টাকা, যা সরকারি ব্যাংকের দ্বিগুণ। বিদেশ ভ্রমণে পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করতেও চার গুণ বেশি ফি নিয়ে থাকে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। উদাহরণ না বাড়িয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই দ্বিগুণ-তিন গুণ ফি ও চার্জ নিয়ে থাকে এসব ব্যাংক। অনেকেই ভাবতে পারেন, বছরে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ১০০/২০০ টাকা বেশি নিলে এ আর খুব কি বেশি? নিশ্চয়, একজনের ক্ষেত্রে এটা কম। কিন্তু যাদের গ্রাহক সংখ্যা পাঁচ লাখ, ১০ লাখ বা তার চেয়ে বেশি, তখন সেই অঙ্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
ধরা যাক, একটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট পাঁচ লাখ, ১০০ টাকা করে বেশি নিলে বাড়তি আয় আসে পাঁচ কোটি টাকা! ৪৮ বেসরকারি ব্যাংকের মোট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা যোগ করলে তা শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে! দেশের ব্যাংকিং খাতে অলস টাকার পাহাড় জমলেও ব্যাংকের মুনাফায় টান পড়ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, চার্জ ও ফি খাত থেকে মুনাফা বৃদ্ধির হার বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। এতে বোঝা যায়, আমানতকারীসহ গ্রাহকদের পকেট কাটছে এসব ব্যাংক, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। উল্লেখ্য, বছর দেড় আগে গণমাধ্যমের সংবাদের কারণে গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নেওয়া ২৬ কোটি টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছিল একটি বেসরকারি ব্যাংক।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, অষ্টম পে স্কেলে বাড়তি বেতন পাবেন বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফলে তাদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো কেন জরুরি? মনে রাখতে হবে, সরকারের অন্য পেশার চেয়ে ব্যাংকিং খাতের গুরুত্ব একটু আলাদা। একদিকে সরকারি সেবা মফস্বল শহরসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে নিজেদের অর্জিত আয়ে ব্যয় নির্বাহ করে সরকারি কোষাগারে কোটি কোটি টাকা জমা দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহে টাকার জোগানে ঋণের ভরসাস্থল বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি ব্যাংকগুলো। আবার বিপিসি, পেট্রোবাংলা, তিতাস, ডিপিডিসিসহ বড় বড় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের গ্যারান্টার হিসেবে কাজ করে জাতীয় অর্থনীতিতে রাখছে বিশাল অবদান। সঙ্গে ঈদসহ বড় উৎসবের আগে সরকারের অন্য পেশার লোকজন ছুটিতে গেলেও তৈরি পোশাক শ্রমিকসহ আমদানি-রপ্তানির স্বার্থে ব্যাংকের শাখা খোলা রাখতে হয় ব্যাংকারদের।
পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এমন দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে অন্যরা যখন প্রিয়জনের সান্নিধ্যে পেতে সবাই নাড়ির টানে ছুটলেও তারা অন্যদের সেবা দিতে অফিস করে। বিপরীতে তাদের দেওয়া হয় না বাড়তি কিছু। ঈদের দুটি বোনাসের বাইরে সরকারি ব্যাংকে দুটি বা আড়াইটি বোনাস দিলেও বেসরকারি ব্যাংকে তা ন্যূনতম তিন বা চারটি দেয়। ফলে মানবিক দিক দিয়েও ব্যাংকের অবদান বিবেচনার দাবি রাখে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংকের ঋণ লোপাটের মতো দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো আলোচনার দাবি রাখে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া পরিচালনা পর্ষদের লোকজন জড়িত। তাদের প্রত্যক্ষ মদদেই ব্যাংকের সহযোগিতায় অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর দায় যতটা ব্যাংকারদের, তার চেয়ে বহুগুণে বেশি সরকারের। বাংলাদেশ ব্যাংক অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিলেও রাজনৈতিক কারণে তারা সবটা প্রতিপালন করতে পারেনি। তবে এর মানে এই নয় যে, বেসরকারি ব্যাংকে ঋণ-অনিয়মের ঘটনা নেই। দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে ব্যাংকার আলাদা কোনো গ্রহের মানুষ নয়। ফলে তারাও এখান থেকে মুক্ত থাকবে, এমন ভাবনা বৃথা। একই যোগ্যতা দিয়ে যখন কেউ দ্বিগুণ বেতন পায়, তখন বঞ্চিতদের মধ্যে লোভ কাজ করবে, সেটা স্বাভাবিক। হু-হু করে বেড়ে চলা বাড়ি ভাড়া ও দ্রব্যমূল্যের বাজারে পরিবার-পরিজন নিয়ে টিকে থাকা সত্যিই দুরূহ। ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে চাইলে উপযুক্ত বেতন দিতে হবে। এই সত্য এতদিন উপেক্ষা করেছে সরকারের নীতিনির্ধারকরা। বঞ্চনা-বৈষম্য দূর না করলে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দানা বাঁধবে। যেকোনো সময় তা ফুঁসে ওঠার শঙ্কা থাকে।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, যমুনা টেলিভিশন