গতির মহারাজ শোয়েব আখতার

২০০৩ সালের বিশ্বকাপ। কেপটাউনের নিউল্যান্ডে পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ড ম্যাচ। প্রথম ইনিংসের চতুর্থ ওভারের শেষ বল। সীমানার কাছ থেকে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এসে বল ছুড়লেন শোয়েব আখতার। ফুল লেন্থের বুলেট গতির ডেলিভারিটি ইংলিশ ওপেনার নিক নাইটকে বাধ্য করল ডিফেন্স করতে। নিজের অজান্তেই শোয়েব নাম লেখালেন ইতিহাসের চূড়ায়। বনে গেলেন গতির মহারাজা। ঘণ্টায় ১৬১.৩ কিলোমিটার গতির সেই বলটি আজও ক্রিকেট ইতিহাসের দ্রুতগতির ডেলিভারি। এ ডেলিভারিতেই প্রথম বোলার হিসেবে ১০০ মাইল (১০০.২৩ মাইল) গতি দেয়াল টপকে যান এ পাকিস্তানি সাইক্লোন।
পরবর্তী সময়ে ব্রেট লি এবং শন টেইট ১০০ মাইলের বেশি গতিতে বল করলেও শোয়েবকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি কেউই। এ দুই অস্ট্রেলিয়ানেরই বলের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৬১.১ কি.মি. (১০০.১ মাইল)। ক্যারিয়ারে দুই বার ঘণ্টায় ১০০ মাইলের বেশি গতিতে বল করেছেন শোয়েব। এ ছাড়া ঘণ্টায় ১৫৯.৩ কি.মি., ১৬০ কি.মি., ১৫৯ কি.মি এবং ১৫৮.৪ কি.মি. গতিতেও বল করেছেন শোয়েব।
১৯৯৭ সালের নভেম্বরে ঘরের মাঠ রাওয়ালপিন্ডিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক। শেষ ম্যাচের প্রতিপক্ষও ভারত। ২০০৭ সালে বেঙ্গালুরুতে শেষ করেন মাত্র ১০ বছরের ক্যারিয়ার। এর মধ্যে খেলেছেন মাত্র ৪৬টি ম্যাচ। ২৫.৬৯ গড়ে নিয়েছেন ১৭৮টি উইকেট। ব্যাট হাতে করেছেন ১০.০৭ গড়ে ৫৪৪ রান।
টেস্ট অভিষেকের তিন মাস পর হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে রঙিন পোশাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখেন এ গতি তারকা। এরপর ১৬৩ ম্যাচে ২৪.৯৭ গড়ে নিয়েছেন ২৪৭ উইকেট। ব্যাট হাতে করেছেন ৮.৯৫ গড়ে ৩৯৪ রান। এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক টানা ১২ ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ডটিও শোয়েবের। জাতীয় দলের হয়ে ১৫টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে নিয়েছেন ১৯ উইকেট। ১৩৩ প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৪৬৭ উইকেট এবং ২২১ লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে নিয়েছেন ৩৩৮টি উইকেট।
পেসার তৈরির কারখানা পাকিস্তানের দুই কিংবদন্তি ওয়াসিম আকরাম এবং ওয়াকার ইউনিসের পর্দা ঠেলে ঠিকই মাথা তুলেছেন, ক্রিকেটকে রাঙিয়েছেন নিজের আলোয়। কেবল বোলিং অ্যাকশনই নয়, বল করার সময় তার রানআপটাও ছিল দর্শনীয়। সীমানার কাছ থেকে বুক চিতিয়ে ছুটে আসা এ টর্নেডোকে দেখে পিলে চমকায়নি এমন ব্যাটসম্যান তখন কমই ছিল। টেস্ট অভিষেকের পরের বছর ইডেন গার্ডেনে প্রথম দেখায় ভারতীয় কিংবদন্তি শচিন টেন্ডুলকারকে ভড়কে দেন শোয়েব। প্রথম মোকাবিলার প্রথম বলেই শোয়েবের ইয়র্কারে লণ্ডভণ্ড হয় শচীনের উইকেট। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো গোল্ডেন ডাক মেরে ফিরতে হয় লিটল মাস্টারকে।
বাইশ গজে পা রাখার পর থেকে গতির সঙ্গে কখনো আপস করেননি। তাই ইনজুরি ছিল নিত্যসঙ্গী, আর ছিল বিতর্ক। ২০০৩ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপে দলের বাজে পারফর্মেন্সের কারণে শোয়েব সাবেক স্বদেশি কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার ওয়াকার ইউনুসের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ান। একই বছর শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে ক্রিকেটের দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে বল টেম্পারিংয়ের প্রমাণ মেলে। সেই বছরই আরেকবার দক্ষিণ আফ্রিকার স্পিন বোলার পল এডামসের সঙ্গে অশোভন আচরণের দায়ে একটি টেস্ট ও দুটি ওয়ানডে ম্যাচে নিষিদ্ধ হন।
২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে শোয়েবকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০০৬ সালে পারফর্মেন্সবর্ধক ড্রাগ নেওয়ার দায়ে দুই বছরের জন্য ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হন। পরে আপিলে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর আবার বিতর্কে জড়ান শোয়েব। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে সতীর্থ মোহাম্মাদ আসিফকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করে স্কোয়াড থেকে বাদ পড়েন। পরের বছর জনসম্মুখে বোর্ডের সমালোচনা করায় পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞায় পড়েন। লাহোরের হাইকোর্ট সে নিষেধাজ্ঞাকে অবৈধ ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের বিচারপতি রানা ভাগওয়ান্দা একটি স্টেটমেন্টে বলেছিলেন, ‘শোয়েব পাকিস্তান ক্রিকেটের একজন লিজেন্ড’।
২০১১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর ১৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানেন শোয়েব। এর পর থেকে ছোটপর্দায় বিভিন্ন রিয়েলিটি শো এবং ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসেবে প্রায়ই দেখা যায় তাঁকে। ১৯৭৫ সালে পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডিতে জন্ম নেন এ সাইক্লোন। রোববার ছিল এই পেসারের ৪২তম জন্মদিন।