উরুগুয়েতে বাজল প্রথম বিশ্বকাপের দামামা
দুয়ারে কড়া নাড়ছে ক্রীড়াবিশ্বের অন্যতম বড় আসর ফুটবল বিশ্বকাপ। আর মাত্র ৩০ দিন পরেই পুরো বিশ্ব মেতে উঠতে যাচ্ছে ফুটবলের উন্মাদনায়। যার আঁচটা পাওয়া যাচ্ছে এখন থেকেই। ফুটবল বিশ্বকাপ সামনে রেখে এনটিভি অনলাইনও নিয়ে এসেছে বিশেষ আয়োজন। আজ পাঠকদের সামনে হাজির করা হচ্ছে বিশ্বকাপের শুরুর গল্প। ১৯৩০ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপের অনেক অজানা কথা :
স্যার থমাস লিপটন থেকে জুলে রিমে, ১৯০৯ সাল থেকে ১৯৩০। ফিফার প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপের ভিতটা কিন্তু এখানেই দাঁড়িয়ে। লিপটন অবশ্য অনেক দেশের সেরা ক্লাবকে নিয়ে আয়োজন করেছিল এক টুর্নামেন্টের। ১৯০৯ সালের সেই ‘স্যার থমাস লিপটন ট্রফি’ থেকে ধারণা নিয়েই ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে জুলে রিমে আয়োজন করে প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপের।
বিশ্বকাপের প্রথম ফাইনালের মাঠ, এস্তেদিও সেন্তেনারিও (মন্তেভিদিও)।
কথায় বলে না, সবকিছুর প্রথমটাই কেমন যেন একটু জৌলুসহীন থাকে। প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপও ছিল তেমনই বিবর্ণ। মাত্র ১৩ দল নিয়ে মাঠে গড়িয়েছিল ফুটবলের প্রথম মহা আসর। আজ ৮৮ বছর পর যখন আরেক বিশ্বকাপ কড়া নাড়ছে দরজায়, তখন দল হয়ে গেছে ৩২। ১৭ দিনেই শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রথম আসর। আর আজ এক মাসের এক দিনের লড়াই শুরুর অপেক্ষায় ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’।
তখন আন্তর্জাতিক ফুটবল পা দিয়েছে মাত্র যৌবনে। অলিম্পিকে ‘অপেশাদার’ তকমা নিয়ে ফুটবল মাঠে গড়ালেও ঠিক ‘সবার’ ফুটবল হয়ে উঠছিল না সেটা। ফিফার তৃতীয় সভাপতি জুলে রিমে ভাবলেন তাই নতুন কিছু। অলিম্পিক থেকে আলাদা হয়ে ফিফার সব দেশকে আমন্ত্রণ জানালেন বৈশ্বিক এক টুর্নামেন্টে।
সেবার উরুগুয়ে দেশটি আবার পা রেখেছে স্বাধীনতার শততম বছরে। তাই ভেন্যু হিসেবে বেছে নেওয়া হলো দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিকেই। আর বাগড়াটা লাগল এখানেই।
আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এসে টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার মতো সময় বা অর্থ ছিল খুব কম দেশেরই। তাঁর ওপর ইংলিশরা এই আসরে অংশ নিতে জানিয়েছিল অস্বীকৃতি।
কিন্তু জুলে রিমে তো পিছিয়ে যাওয়ার মতো মানুষ নয়। উরুগুয়ে সরকার আর ফিফার সহায়তায় শেষমেশ এই ফরাসি রাজি করিয়ে ফেললেন ফ্রান্স, বেলজিয়াম, রোমানিয়া আর যুগোস্লাভিয়াকে। সঙ্গে সাত লাতিন দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, পেরু, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়াসহ স্বাগতিক উরুগুয়েও করে ফেলে নিবন্ধন। তবে আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশ থেকে যায়নি কোনো দল। উত্তর আমেরিকার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো।
ফাইনালের লড়াইয়ে লড়ছে উরুগুয়ে-আর্জেন্টিনা। ৪-২ ব্যবধানে ম্যাচ জিতে শেষ হাসিটা অবশ্য হেসেছে স্বাগতিকরাই।
ব্যস, ১৩ দল নিয়েই শুরু হয়ে ফুটবলের প্রথম মহারণ। চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে দলগুলো মাঠে নামে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরতে। মজার ব্যাপার, চার গ্রুপের মধ্যে ‘এ’ গ্রুপে ছিল চার দল, বাকি সব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ছিল তিন। সব খেলাই গড়িয়েছিল উরুগুয়ের রাজধানী মন্তেভিদিওর তিনটি মাঠে। এস্তেদিও সেন্তেনারিও, এস্তাদিও গ্রান পার্ক সেন্ট্রাল আর এস্তাদিও পোসিতোস—এই তিন মাঠেই হয়েছে বিশ্বকাপের প্রথম আসরের ম্যাচগুলো।
ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, যুক্তরাষ্ট্র ও স্বাগতিক দেশ উরুগুয়েকে রাখা চারটি আলাদা গ্রুপে। ওহ বলা হয়নি, এই আসরেই কিন্তু প্রথম ও শেষবারের মতো দলগুলো অংশ নিয়েছিল কোনো প্রকার বাছাইপর্ব ছাড়াই।
জুলাই ১৩, ১৯৩০ সাল। কার কেমন অবস্থা ছিল কে জানে, তবে জুলে রিমে যে ঘামছিলেন, সেটা কিন্তু অনুমেয়ই। আর সেটাই যে স্বাভাবিক, তাঁর এত দিনের স্বপ্ন যে সফল হতে চলল। ওই তো, মন্তেভিদিওর দুই মাঠে যে প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম দুই লড়াইয়ে নেমে গেছে ফ্রান্স-মেক্সিকো আর যুক্তরাষ্ট্র-বেলজিয়াম! অনেক অপেক্ষার সে বিশ্বকাপে প্রথম গোলটা এসেছিল ফ্রান্সের লুসিয়েন লরেন্তের পা থেকে।
ফাইনালে দুই দল নিয়ে এসেছিল দুই বল!
গ্রুপ পর্বের লড়াই শেষ করে আর্জেন্টিনা, যুগোস্লাভিয়া, উরুগুয়ে আর যুক্তরাষ্ট্র টিকেট পায় সেমিফাইনালের। দল কম হওয়ায় আর রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতিতে খেলা গড়ানোয় ছিল না কোনো কোয়ার্টার ফাইনাল বা শেষ ষোলোর ঝক্কি। সেমিফাইনালের আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল যুক্তরাষ্ট্র, স্বাগতিক উরুগুয়ে পেয়েছিল যুগোস্লাভিয়াকে। বিশ্বকাপের আসরে সবচেয়ে বেশি ট্রফি রয়েছে ব্রাজিলের ঘরে। পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা কিন্তু প্রথম আসরে পেরোতে পারেনি গ্রুপ পর্বের গণ্ডিই!
প্রথম সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা দলের নিদারুণ আক্রমণে দিশেহারা যুক্তরাষ্ট্র ৬-১ ব্যবধানে বিদায় নেয় বিশ্বকাপ থেকে। কাকতালীয়ভাবে দ্বিতীয় সেমিফাইনালেও উরুগুয়ে একই ব্যবধানে পরাজিত করে যুগোস্লাভিয়াকে। ৬-১ ব্যবধানের বড় জয় নিয়ে ফাইনালে আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয় স্বাগতিকরা।
জুলাই ৩০, ১৯৩০। কী দারুণ মিল সাল আর তারিখের! আর এমন দিনেই এস্তেদিও সেন্তেনারিওতে গড়ায় প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের লড়াই। ম্যাচের শুরুতেই অদ্ভুত এক ঝগড়া! দুদলই নিয়ে এসেছিল আলাদা দুটি বল। কার বল দিয়ে খেলা শুরু হবে, সে নিয়ে ঝগড়া করতে করতেই দেরি হয়ে যায় খেলা শুরু করতে।
সিদ্ধান্ত হলো, দুই অর্ধে দুই দলের দুই বল দিয়ে মাঠে গড়াবে খেলা। বিবর্ণ এক বিশ্বকাপ ফাইনালে ৯৩ হাজার দর্শক মাঠে এসে অবশ্য জানান দিয়েছিল রঙের ছটায় রঙিন হতে খুব বেশিদিন সময় নেবে না বিশ্বকাপ ফুটবল। তা হয়েছেও, রাশিয়ায় যে আসছে বিশ্বকাপের দুই মাস আগ থেকেই আলোর ছড়াছড়ি!
বিশ্বকাপের প্রথম ট্রফি।
৪-২ গোলের জয়ে আর্জেন্টিনাকে কাঁদিয়ে প্রথম বিশ্বকাপের শিরোপা উঁচিয়ে ধরে স্বাগতিক উরুগুয়েই। জুলে রিমে ‘বিশ্বকাপ ট্রফি’ উরুগুয়ের হাতে তুলে দিলেও ফরাসি এই ফুটবল সংগঠকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সে ট্রফির নামটাই রেখে দেওয়া হয় ‘জুলে রিমে ট্রফি’।
তবে রানার্সআপ হয়ে আর্জেন্টাইনরা কষ্টটা বোধ হয় একটু বেশিই পেয়েছিল। যেখানে উরুগুয়েতে বিশ্বকাপ জয়ের পরের দিনকে ঘোষণা করা হয়েছিল ছুটির দিন হিসেবে। সেখানে আর্জেন্টিনার উরুগুয়ে দূতাবাসে কি না পাথর ছুড়ে মনের ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছিল আর্জেন্টিনাবাসীরা!