তামিমের দিকে তাকিয়ে থাকবে বাংলাদেশ
দিনটা ছিল ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের ‘বি’ গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছে শক্তিশালী ভারত ও বাংলাদেশ। টস জিতে ব্যাটিং বেছে নেওয়া রাহুল দ্রাবিড়ের ভারতকে মাত্র ১৯১ রানে অলআউট করে দেয় বাংলাদেশের বোলাররা। জবাবে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশ দলের ওপেনার শাহরিয়ার নাফীস মাত্র দুই রান করে ফিরে গেলেও ১৮ বছর বয়সী আরেক ওপেনার খেলতে থাকেন একের পর এক বিস্ফোরক শট। তাঁর মারকুটে ব্যাটিংয়ের জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায় ধারাভাষ্যকার এবং দর্শকরা। দারুণ আস্থার সঙ্গে খেলে ভারতীয় বোলারদের দিশেহারা করে তুলে নেন চমৎকার এক অর্ধশতক। ৫৩ বলে ৫১ রানের ইনিংসে সাতটি চারের পাশাপাশি মারেন দুটি বিশাল ছক্কা। নিজের ট্রেডমার্ক লফটেড শটে ভারতীয় বাঁহাতি পেসার জহির খানের বল পোর্ট অব স্পেনের গ্যালারিতে আছড়ে ফেলা সেই তামিম ইকবাল এখন বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান।
এক যুগ আগে মাত্র ১৮ বছর বয়সে নিজের প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে যে আগমনী বার্তা শুনিয়েছিলেন তামিম ইকবাল, সেই তিনি আজ অনেক পরিণত। ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় এবারের আসর হতে যাচ্ছে তাঁর চতুর্থ বিশ্বকাপ। নিজের চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে প্রতিনিয়ত নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। সব ফরম্যাটের ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এখন তিনিই। গত এক যুগে বাংলাদেশ দলের অপরিহার্য সদস্য এবং ‘নাম্বার ওয়ান’ ওপেনার হিসেবে তামিমের বিকল্প আর কেউ হতে পারেননি।
২০০৭ সালে ক্যারিবীয় বিশ্বকাপের মাসখানেক আগে হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হয় তামিম ইকবালের। এরপর এক যুগের ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত খেলেছেন মোট ১৯৩টি ৫০ ওভারের ম্যাচ। ১১টি সেঞ্চুরি এবং ৪৬টি অর্ধশতকসহ ৩৬.২৬ গড়ে ৬,৬৩৬ রান করা তামিমই টাইগারদের পক্ষে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ডানেডিনে ২০০৮ সালে টেস্ট অভিষেক হয় তামিমের। ৫৮ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৩৯.৯৮ গড়ে ৪,৩২৭ রান করে বাংলাদেশিদের মধ্যে সবার ওপরে তিনিই। দ্বিশতকের সর্বোচ্চ ২০৬ রানের ইনিংসটিসহ টেস্টে ৯টি শতক এবং ২৭টি অর্ধশতক রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া ৭৫ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে একটি সেঞ্চুরি এবং ছয়টি অর্ধশতকসহ ১,৬১৩ রান আছে তাঁর। বলা বাহুল্য, এই ফরম্যাটেও বাংলাদেশিদের মধ্যে সর্বোচ্চ রান তাঁরই।
তবে পরিসংখ্যানের চেয়েও তামিমের সবচেয়ে বড় অবদান, বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনিই প্রথম প্রতিপক্ষের বোলারদের বিপক্ষে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলার সংস্কৃতি চালু করেন। বোলারদের নামকে সমীহ না করে ম্যাচের পরিস্থিতি এবং দলের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাট করে নিজেকে বিশ্বমানের ওপেনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইংল্যান্ড সফরে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১০ সালে উইজডেন ক্রিকেটার ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটারের মর্যাদা পান বাংলাদেশের বাঁহাতি এই ওপেনার। নিজের পারফরম্যান্সের কল্যাণে কাউন্টি ক্রিকেটসহ বিশ্বের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলেও বাংলাদেশের সম্মান বাড়িয়েছেন তামিম।
ইংল্যান্ডে এবার নিজের চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলবেন বাঁহাতি এই ওপেনার। তবে এর আগের তিন বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে সেরা তামিমকে পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত বিশ্ব আসরে মোট ২১ ম্যাচ খেলে ২৩ গড়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৪৮৩ রান করেছেন তিনি। বিশ্বকাপে তিনটি অর্ধশতক করা তামিমের সর্বোচ্চ স্কোর ৯৫। তবে এবারের আসরে নিজের সেরা ফর্মটা দেখাতে উন্মুখ হয়ে থাকবেন তিনি। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের সেরা ১০ ব্যাটসম্যানের একজন তামিম। শেষ চার বছরে তাঁর ব্যাটিং গড় ৫৮, ওপেনারদের মধ্যে কেবল ভারতের রোহিত শর্মার গড়ই এর চেয়ে বেশি। এ ছাড়া ইংল্যান্ডের মাটিতে তামিমের রেকর্ডও দুর্দান্ত। সেখানে ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে চার ম্যাচে এক সেঞ্চুরি ও দুটি অর্ধশতকসহ ২৯৩ রান করে টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন এই বাংলাদেশি ওপেনার। তাঁর দুর্দান্ত ব্যাটিং নৈপুণ্যে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। এবার ক্যানভাসটা আরো বড়, ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর ওয়ানডে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। আর এই মেগা আসরে সেরা সাফল্য পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ দল এবং অগণিত ক্রিকেটভক্ত অনেকাংশেই তাকিয়ে থাকবেন তামিম ইকবালের দিকে।