৩৯ এ রোনালদো, গল্প যার অল্প নয়!
‘যখন বসন্ত আসে
আমি মরেও যাই যদি,
ফুলগুলো আগের মতো ফুল হয়েই ফোটে!
গাছগুলোও গত বসন্তের চেয়ে নয় কম সবুজ
দুনিয়া যেন আমাকে সহজেই গেল পাশ কাটিয়ে!’
পর্তুগিজ কবি আলবার্তো কাইয়েরোর কবিতার এই পঙতিমালা কখনও কি জপেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো? ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে গেলেন। কথায় বলে, শিশু আর বুড়োরা না কি এক রকম! রোনালদোর বেলায় অদ্ভুতভাবে মিলে যাচ্ছে তা। তরুণ সিআরসেভেন আর বুড়ো ক্রিস্টিয়ানো— দুজনই অপ্রতিরোধ্য। খেলবেন আর কটা দিন। এখনও, তিনি ক্ষুধার্ত। বুড়িয়ে যাওয়া বসন্তেও সবুজ ঘাসে তার ফুলগুলো ফোটে সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে। বয়স বুঝি নিছক সংখ্যা? কুঁড়িতে বুড়ি, চল্লিশে চালশে বানিয়ে ফেলা বাঙালি এক রোনালদোতে অবাক হয় বারংবার। বয়সকে থামিয়ে তিনি ছুটছেন।
ফিরে যাই মাদেইরায়। যেখানে সাধারণ এক পরিবারে ৩৯ বছর আগে জন্ম নিয়েছিল এক শিশু। যাকে, অভাবের কারণে পৃথিবীর আলো দেখাতে চাননি মা! এসেই যখন পড়েছেন স্বার্থপর পৃথিবীতে, কিছু তো করতে হবে। ফুটবলকে বেছে নিলেন। রোনালদোর সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্কটা বোধহয় চমৎকার। কাউকে না কাউকে পাঠিয়ে দেন তার জন্য। আলবার্তো ফ্যান্ত্রাওয়ের কথাই ধরা যাক। নিশ্চয়ই চেনেননি? চেনার কথা নয়। এতটুকু জেনে রাখুন, রোনালদো আজকের গ্রেটেস্ট অব অলটাইম হয়ে উঠেছেন ফ্যান্ত্রাওয়ের একটি বিখ্যাত পাসের কারণে।
ফ্যান্ত্রাও পর্তুগালের এক সাদামাটা মানুষ। আপনি তার বাড়িতে গেলে কথাটি অবশ্য বিশ্বাস করতে পারবেন না। একবার একজন সাংবাদিক তার বাড়িতে গিয়ে রীতিমত অবাক বনে যান। আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ বাড়ি, লেটেস্ট মডেলের গাড়ি— ফ্যান্ত্রাওয়ের মতো একজনের এতটা বিলাসি হওয়ার সুযোগই নেই। সাংবাদিকের কৌতূহল মেটালেন ফ্যান্ত্রাও। জানালেন, সবই রোনালদোর দেওয়া। রোনালদো সবসময় মাথার ওপর ছায়া হয়ে পাশে আছে। কিন্তু কেন?
একাধিক সাক্ষাৎকারে পর্তুগিজ মহাতারকা বন্ধু ফ্যান্ত্রাওয়ের গল্পটা বলেছেন। রোনালদো ও ফ্যান্ত্রাও তখন মাদেইরার অ্যাকাডেমির ছাত্র। স্পোর্টিং লিসবনের স্কাউটরা এলেন, জানালেন ম্যাচে যে বেশি গোল করবে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে লিসবনের অ্যাকাডেমিতে। ম্যাচের প্রথম গোলটা রোনালদোর, দ্বিতীয়টি ফ্যান্ত্রাওয়ের। তৃতীয় ও শেষ গোলে প্রতিপক্ষ রক্ষণকে ভেঙে ফ্যান্ত্রাও এমন জায়গায় ছিলেন, সেখানে কেবল গোলরক্ষক ও তিনি। গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়ানোটা সেই মুহূর্তে তার কাছে সহজতর ছিল। কিন্তু, তিনি শটটা নিলেন না। পাশে থাকা রোনালদোকে বাড়িয়ে দিলেন। সুযোগ হাতছাড়া করেননি সিআরসেভেন। গোল করলেন, পাড়ি দিলেন লিসবনে। বন্ধুর এই উদারতা কখনও ভোলেননি রোনালদো। ফ্যান্ত্রাওকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন তুমি বলটা আমায় দিলে? চাইলেই সহজেই গোলটা দিতে পারতে। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ক্রিস, তুমি আমার চেয়ে সেরা।
সেই থেকে সেরার যাত্রাটা শুরু। সমকালের সেরার স্বীকৃতিটা লিওনেল মেসি ছিনিয়ে নিয়েছেন বটে, তাতে রোনালদোর গল্পে ভাটা পড়েনি এতটুকু। তরুণ প্রজন্মের একটা বিশাল অংশের কাছে তিনি আদর্শ। পরিশ্রম, হার না মানার মানসিকতা, নিজেকেই নিজে সেরা হওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া আর ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে প্রবল প্রতিপক্ষের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে তাকে সাধুবাদ জানানো রোনালদোকে আদর্শ না মানার উপায় খুব একটা নেই।
‘আমি আমার অনুশীলনের প্রতিটি মুহূর্তকে ঘৃণা করি’— মোহাম্মদ আলীর কথা। তারপরের বাক্যে অনুপ্রেরণা। ‘আমি জানি, এই অনুশীলন, পরিশ্রমই আমাকে বিশ্বসেরা করবে।’ প্র্যাকটিসকে ঘৃণা করে মোহাম্মদ আলী গত শতাব্দীর সেরা অ্যাথলেট নির্বাচিত হয়েছিলেন, প্র্যাকটিসকে প্রাণপণে ভালোবাসা রোনালদোর সেরা হওয়াই তো স্বাভাবিক। লিসবন থেকে ম্যান ইউনাইটেড, তারপর মাদ্রিদ, জুভেন্তাস হয়ে ফের ইউনাইটেড অধ্যায় শেষে নতুন ঠিকানা সৌদি ক্লাব আল-নাসের। দীর্ঘ যাত্রায় কখনও ক্লান্ত হননি সিআরসেভেন, হার মানেননি। প্রবল নিন্দুককেও দিয়েছেন ভালোবাসা। নিন্দুকের নিন্দাই যে তাকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দেয়, বলেছেন অকপটে।
রোনালদোর অদ্ভুত এক গুণ আছে। অদম্য সাহসে ভর দেওয়া আত্মবিশ্বাস। এতে ভর দিয়ে প্রতিপক্ষকে বহুবার তছনছ করেছেন। অথচ, তারাই তাকে দলে ভিড়িয়েছে। ম্যান ইউনাইটেডে ২০০৮ সালে রোনালদো বলেকয়ে এক মৌসুমে গুণে গুণে ত্রিশখানা গোল দিয়েছিলেন! সেই তখন এক মৌসুমে ৩০ গোলের ভাবনা দুঃস্বপ্নেও ভাবার দুঃসাহস হতো না কারও। রোনালদো ভেবেছিলেন, বলেছিলেন, করে দেখিয়েছিলেন। স্পোর্টিং সিপির সবুজ সাদা ডোরাকাটা কৈশোরে লাল শয়তানদের তছনছ করেছেন। কী অদ্ভুত! তারাই ভালোবেসে নিয়ে এলো তাকে পর্তুগাল থেকে ইংল্যান্ডে। পর্তুগিজ সাম্রাজ্য পেরিয়ে, ইংরেজ সাম্রাজ্য জয় করে স্প্যানিশ ম্যাটাডোর হতে পাড়ি জমালেন রিয়াল মাদ্রিদে।
এক, দুই, তিন...গোল আসছিল, সাফল্য নয়। বুভুক্ষ রোনালদো সামনের সারিতে বসে প্রিয়তম প্রতিপক্ষের বিজয়, চারপাশে বিষাদের সুর ছড়ানো করতালিতে কান্না জমিয়েছেন। ব্যালন ডি’অরের পোডিয়ামে বৃষ্টি হয়ে ঝড়েছে জমানো কান্না। ’তোমাদের ভালোবাসা আমাকে মনোবল দেয়, ঘৃণা দেয় অপ্রতিরোধ্য হওয়ার জোগান’— সেপ ব্ল্যাটার থেকে ইব্রার সুইডেন, উল্ফসবার্গ থেকে পিএসজি; ঘৃণার স্তুপে দাঁড়িয়েই তিনি বাজিয়েছেন উল্লাসের বাঁশি! সেই রোনালদো, ২০১৬ ইউরোতে যিনি দেশকে এনে দিয়েছেন আরাধ্য সম্মান। ফাইনালে মাঠ ছাড়ার সময় কান্না মুছতে উড়ে আসা প্রজাপতি তো স্বয়ং ফুটবল দেবের পাঠানো দূত। গোটা দেশ সমস্বরে গেয়ে উঠেছে, পর্তুগালের আজ একজন রোনালদো আছেন। যিনি কথা রাখতে জানেন।
আরব কবি তারাফা তার কবিতায় লিখেছেন—
‘যখন আমায় দেখা দেবে তুমি, এগিয়ে দেব সুবাসিত মদিরা
তোমার অজুহাতে আমি ছুঁড়ে দেব সাহস,
তুমি সেটি পান করো উষ্ণ কৃতজ্ঞতায়
এরপর আবার মেতো আমায় নিয়ে ঘৃণার বন্দনায়!’
পথ চেনানো মৃদু আলোতে একজন রোনালদোকে নিয়ে আলাপ উঠতে বাধ্য! নক্ষত্রের পাশে আরেকটি অমরাবতীকে বসিয়ে রেখেছেন তাকে মনে রাখতে। সাত, সৌভাগ্যের প্রতীক। প্রেরণার পর্বত। ইতিহাসের প্রথম অ্যাথলেট, যিনি নামের আদ্যক্ষর আর জার্সি সংখ্যা মিলিয়ে ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছেন।
রোনালদো হয়তো সর্বকালের সেরা নন। হয়তো সমকালেও পিছিয়ে। তবু তাকে মনে রাখতেই হবে। সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতাকে, একটা প্রজন্মের ভেতর জয়ের ক্ষুধা দেওয়া আদর্শকে, গোটা একটা দেশ ছাপিয়ে ব্যক্তি বড় হয়ে ওঠা রোনালদোকে মনে রাখতেই হবে।
৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫, কালের পাতায় সাধারন দিনটি রোনালদোর আগমনী সুর বাজিয়েছে নিরবে। ৩৯ বছর পেরিয়ে যা আজ ভীষণ সরব। ৩৯তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা, পর্তুগিজ মহারাজ।