হাথুরুসিংহকে নিয়ে ১০ বিতর্কিত ঘটনা
কোচ হিসেবে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে কেমন? বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের জন্য অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা। হাথুরুকে নিয়ে আগেও কম বিতর্ক হয়নি। ড্রেসিংরুমে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি, সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে দ্বন্দ্বসহ মাঠের বাইরের নানা কর্মকাণ্ড তাকে করেছে সমালোচিত। শেষমেশ কপাল পুড়ল এই লঙ্কান মাস্টারমাইন্ডের। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেয়াদ থাকলেও অনেকটা হুট করেই বাংলাদেশের কোচের দায়িত্ব হারালেন তিনি।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে হাথুরুসিংহে অধ্যায়ের শুরুটা ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর। শেন জার্গেনসনের পদত্যাগ ঘোষণার পরই দায়িত্ব নেন অখ্যাত হাথুরুসিংহে। এর আগে যার জাতীয় দলে কোচিংয়ের অভিজ্ঞতাও ছিল না। যদিও ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে ছিলেন ব্যর্থ। সেই সিরিজে পুরোপুরি হতাশ করেন ক্রিকেটাররা।
তবে, পরের বছরই ওয়ানডে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত ছাড়াও ঘরের মাঠে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয় হাথুরুসিংহের অন্যতম বড় সাফল্য। যা তার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় বহুগুন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার প্রধান কোচের দায়িত্ব পেয়ে বিসিবিকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান।
এর ঠিক চার বছর পর ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফের দ্বিতীয় দফায় তাকে দায়িত্ব দেয় বিসিবি। এবারও সাফল্যের চেয়ে বিতর্কের পাল্লা ভারী এই কোচের। চাকরি হারালেন দেড় বছরের মাথায়। অর্ন্তবর্তী কোচের দায়িত্ব পেয়েছেন ক্যারিবীয় কিংবদন্তি ফিল সিমন্স।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক হাথুরুসিংহের আলোচিত যত ঘটনা…
১.ড্রেসিংরুমে চড়কাণ্ড : দুই দফায় প্রধান কোচের দায়িত্বে ছিলেন হাথুরুসিংহে। তবে, তার ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় বিতর্কের জন্ম দেন ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে। নিউজিল্যান্ড ম্যাচের আগে জাতীয় দলের স্পিনার নাসুম আহমেদকে ড্রেসিংরুমের চড় মারার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। বিশ্বকাপের পর ঘটনাটি বেশ বিতর্কের জন্ম দেয়। হাথুরুসিংহে বিষয়টি অস্বীকার করেন। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি তার। বিসিবির তদন্ত রিপোর্টে বিষয়টির সত্যতা মেলে। যা তার দায়িত্ব হারানোর অন্যতম কারণ।
২.সিরিজ শেষে ছুটি বিলাস : যে কোনো সিরিজ শেষে হাথুরুসিংহের অনুপস্থিতি নিয়ে কম আলোচনায় হয়নি। প্রথম মেয়াদের মতো দ্বিতীয় মেয়াদেও কোনো সিরিজ শেষ হওয়া মাত্রই দলের সাথে দেশে ফিরে তিনি চলে যেতেন ছুটিতে। দলের কোথায় ঘাটতি, কোথায় দুর্বলতা, কী কী সমস্যা- এগুলো সমাধানের যে সময়টা, সেটা তিনি কখনোই কাজে লাগান না। দীর্ঘদিন ছুটি কাটানোর পর আবার তিনি ফিরেন কোনো না কোনো সিরিজ কিংবা টুর্নামেন্টের ঠিক আগ মুহূর্তে। তার বরখাস্তের পেছনেও এটিও ছিল বড় একটি কারণ।
৩.মাশরাফী-তামিমের অবসরের নেপথ্যের নায়ক : ২০১৭ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কা সফরে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে টস করার সময় টি-টোয়েন্টিকে বিদায় বলে দেন মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা। মূলত সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফীর সামর্থ্যের পাশাপাশি ফিটনেস ইস্যুতে প্রশ্ন তোলেন হাথুরুসিংহে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা অভিমানেই সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটকে বিদায় বলে দেন নড়াইল এক্সপ্রেস।
শুধু মাশরাফী নয় এই তালিকাতে আছেন দেশসেরা ব্যাটার তামিম ইকবালও। ২০২৩ সালে ঘরের মাঠে আফগানিস্তান সিরিজের মাঝপথে হুট করে অবসরের ঘোষণা দেন তামিম ইকবাল। মূলত, তামিমের ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন হাথুরু। যা ভালোভাবে নেননি তামিম। অভিমানে তিনিও অবসরের ঘোষণা দেন। দেশসেরা এই ওপেনার পরবর্তীতে অবসরে ভেঙে দলে ফিরলেও তাকে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে না রেখে নতুন বিতর্কের জন্ম দেন হাথুরুসিংহে।
৪.শততম টেস্টে রিয়াদকাণ্ড : সময়টা ২০১৭ সালের মার্চ। শ্রীলঙ্কার মাটিতে শততম টেস্ট খেলার অপেক্ষায় বাংলাদেশ দল। সেই সফরে প্রথম টেস্টে রান না পাওয়ায় রিয়াদকে দেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন হাথুরুসিংহে। পরবর্তীতে তৎকালীন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের অনুরোধে রিয়াদকে স্কোয়াডে রাখলেও একাদশে রাখেননি হাথুরু। যা নিয়ে সেসময় বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন হাথুরু।
৫. দ্বি-স্তর বিশিষ্ট নির্বাচক কমিটি : বিসিবির বর্তমান সভাপতি ফারুক আহমেদ হাথুরুর দায়িত্ব পালনের প্রথম দফায় ছিলেন প্রধান নির্বাচকের দায়িত্বে। সেসময় খেলোয়াড় নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে হাথুরু গঠন করেন দ্বি-স্তর বিশিষ্ট নির্বাচক কমিটি। যা মেনে নিতে পারেননি ফারুক আহমেদ। দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান এই সাবেক ক্রিকেটার।
৬.সাকিব-হাথুরু দ্বন্দ্ব : শুধু তামিম, মাশরাফী কিংবা মাহমুদউল্লাহ নয়, সাকিবের সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন হাথুরুসিংহে। ২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ থেকে লম্বা সময়ের জন্য ছুটি চেয়েছিলেন সাকিব। গুরুত্বপূর্ণ সিরিজের আগে সাকিবের এমন ছুটি চাওয়া মেনে নিতে পারেননি হাথুরু। সেসময় সাকিবের আত্ননিবেদন নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই লঙ্কান কোচ।
৭.বিশ্বকাপে অকারণে ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন : ভারতে অনুষ্ঠিত ২০২৩ বিশ্বকাপে ৯টি ম্যাচ খেলে মাত্র ২টিতে জিতেছে বাংলাদেশ। এরচেয়েও বড় বিষয় ছিল, প্রতিটি ম্যাচেই দলের ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন করেন হাথুরুসিংহে। কেন এমন এক্সপেরিমেন্ট এমন প্রশ্ন তোলা হলেও, তার কোনো সঠিক উত্তর দেননি এই কোচ। সেসময় বিষয়টি বেশ বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।
৮.হাথুরু-সুজন দ্বন্ধ : ২০২৩ বিশ্বকাপের সময় বিসিবি সাবেক পরিচালক ও টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান হাথুরুসিংহে। সেসময় দলের সঙ্গে থাকলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো ক্ষমতা ছিল না সুজনের। পরবর্তীতে গণমাধ্যমে বিষয়টি জানান তিনি। এসময় হাথুরুর স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তোলেন তিনি।
৯.সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে মতবিরোধ : বাংলাদেশের কোচ হিসেবে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে হাথুরুসিংহের সঙ্গে বেশ কয়েকজন তারকা ক্রিকেটারের মতবিরোধের বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। পঞ্চপাণ্ডবের পাঁচ ক্রিকেটার ছাড়াও তরুণ ক্রিকেটাররাও তার বিতর্কিত সব সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা সময়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। যদিও কখনও মতবিরোধের বিষয়টি স্বীকার করেননি হাথুরুসিংহে।
১০.বিপিএলকে সার্কাসের সঙ্গে তুলনা : সদ্য বিদায়ী এই কোচ সরাসরি এই টুর্নামেন্টের কার্যকারিতা আর মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই কোচ কোনো রাখঢাক না রেখেই বলেছিলেন, বাংলাদেশের যথাযথ বা কার্যকর কোনো টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট নেই। টেলিভিশনে বিপিএল দেখার সময় কখনো কখনো তিনি টিভিই বন্ধ করে দেন। আইসিসির এখানে হস্তক্ষেপ করা উচিত। অবশ্যই কিছু নিয়ম থাকতে হবে। একজন খেলোয়াড় একটা টুর্নামেন্ট খেলছে, পরে আরেকটা খেলছে। এটা সার্কাস।