২০০ বছরের ঐতিহ্য কাইকারটেক হাট
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে কাইকারটেক হাট। এরইমধ্যে হাটটি তার বয়স পার করেছে দুই শতাব্দী। হাটটিকে ঘিরে নারায়ণগঞ্জ ও তার আশপাশের জেলার ব্যবসায়ীদের মিলনমেলা তৈরি হচ্ছে বছরের পর বছর। নদী ও সড়কপথের পাশে অবস্থিত এই হাটে ক্রেতাদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে এলেও গুরুত্ব কমেনি কোনো অংশেই। শতবর্ষী বটবৃক্ষের নিচে অবস্থিত এই হাটটি আজও তার অস্তিত্বের জানান দিয়ে আসছে।
কাইকারটেক মূলত নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার একটি গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ব্রক্ষপুত্র নদ। সড়ক ও নদীপথ ধরে ব্যবসায়ীরা তাদের পসরা নিয়ে প্রতি সপ্তাহের রোববার হাজির হন কাইকারটেক হাটে। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, নরসিংদীর ব্যবসায়ীরাও ছুটে আসেন এই হাটে। তবে সময়ের পরিক্রমায় হাটের পণ্য দোকানে পাওয়ায় ক্রেতার সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে।
হাটবারে হাটে ঢুকতেই চোখে পড়ে মসলা ও বীজের দোকান। বিভিন্ন মৌসুমি শাক-সবজি, ফসল, গাছ ইত্যাদির বীজ বিক্রি হচ্ছে। তার পাশেই কবুতর ও কবুতরের বাঁশের খাঁচা বিক্রি হচ্ছে। হাট ঘুরতে ঘুরতে মনে হবে যেন দেশের দুষ্পাপ্য সব পণ্যই নিয়ে আসা হয়েছে এই হাটে—পশুপাখি, মাছ মাংস, মসলা, মাটির হাঁড়ি, লোহার দা, বটি, কোদাল, নিড়ানি, শেকল, বাঁশের চালুন, ডুলা, কুলা, সাঝি, মাছের জাল, বরশি, রশি, কাপড়, মিষ্টিজাত খাবার, গাছের চারা, বেত, বাঁশ, নৌকা ইত্যাদি। এতসব পণ্যের মাঝে ৯০ দশকের হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন জিনিসপত্র স্মরণ করিয়ে দেবে পুরোনো দিনের কথা।
কাইকারটেক হাটে সবচেয়ে আকর্ষণীয় খাবার হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী পুতা মিষ্টি। একেকটি মিষ্টির ওজন প্রায় এক কেজি। মিষ্টির আকার অনেকটা মসলা বাটার পুতার মতো। আর সেই থেকেই এর নাম পুতা মিষ্টি। লোকমুখে শোনা যায়, শুধুমাত্র এই হাটেই পাওয়া যায় পুতা মিষ্টি। তবে হাটের এক মিষ্টি দোকানি বললেন ভিন্ন কথা।
হাটের দোকানি প্রদীপ ঘোষ বলেন, ‘এই মিষ্টি আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে বানাই। শুধু হাটে বেচাকেনা করলে তো পেট চলবো না। আমরা সোনারগাঁয়ে বহু বছর ধইরা এই মিষ্টি বানাই। কাইকারটেক ছাড়াও সোনারগাঁয়ের আনন্দ বাজার হাটে এই মিষ্টি বিক্রি হয়। অনেক নতুন ব্যবসায়ীরা ইদানিং এই মিষ্টি বানান শুরু করছে। কিন্তু আমাগো দাদার আমল থিকাই এই মিষ্টি বানানো হয়। আমাগো পারিবারিক ব্যবসা বলতে পারেন।’
শুধু মিষ্টি নয়, এই হাটে নৌকা ও ঘোড়া বিক্রি হয় বিশেষ বিশেষ সময়ে। হাট পরিচালনা কমিটির সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্ষা মৌসুমে টানা পাঁচ মাস এই হাটে নৌকা বিক্রি হয়। এখন শীত চলে আসায় আপাতত নৌকা নির্মাতারা হাটে আসেন না। আশপাশের বিল শুকিয়ে আসায় নৌকার কোনো কাজ নেই। আবার আগামী বর্ষায় নৌকা উঠবে এই হাটে। একই সাথে এই হাটে মাঝে মাঝে ঘোড়া বিক্রেতারা আসেন। বিশেষ করে মুন্সিগঞ্জ ও সোনারগাঁ থেকে ঘোড়া নিয়ে আসেন কেউ কেউ। কিন্তু কয়েকবছর ধরে তাঁরা নিয়মিত আসেন না। চার অথবা পাঁচ মাসের মধ্যে দুই-একবার ঘোড়া আনতে দেখা যায়।
হাটের মাঝে বিশাল এক বটগাছ। তার একটু কাছেই পুরোনো আমলের একটি ভাঙা দেয়াল। হাটবার হওয়ায় সেই দেয়ালটি ত্রিপলের কারণে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না। লোকমুখে শোনা যায়, বটগাছটিরও বয়স হাটের সমান। অর্থাৎ, প্রায় ২০০ বছর বয়স। কিন্তু ঠিক কারা শুরু করেছিল এই হাটের গোড়াপত্তন, তা কেউই বলতে পারেনি।
নারায়ণগঞ্জের প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক ওহিদুল হক খান বলেন, ‘ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণ গ্রন্থে লিখেছিলেন, সুবর্ণগ্রামে (সোনারগাঁয়ের আদি নাম) একটি নদী তীরের হাট থেকে তিনি দুটি কিশোর ও কিশোরী কৃতদাস ক্রয় করেছিলেন। সেই সময়ে এই হাটে তিনি হাতি বিক্রি করতে দেখেছেন। ইবনে বতুতা ব্রিটিশ শাসনের বহুপূর্বে এই দেশে ভ্রমণে এসেছিলেন। তাঁর রিহাল গ্রন্থে বর্ণনার সাথে বর্তমান কাইকারটেক হাটের বেশ সাদৃশ্য পাওয়া যায়। সেই বিবেচনায় এই হাটের বয়স ২০০ বছরের অধিক বললেও হয়তো ভুল হবে না। তবে এসব ইতিহাস সংরক্ষণ করে রাখার মতো কেউ না থাকায় কালের বিবর্তনে এর ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।