আবদুল্লাহ আল মোহনের ‘দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টির ভারতভ্রমণ’
‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে’... শুধু নজরুল কেন, জগৎটাকে দেখার আকুতি কমবেশি সবারই থাকে। তবে সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় করে সবার পক্ষেই সে সাধ চরিতার্থ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। সে ক্ষেত্রে কিন্তু দুধের স্বাদ ঘোলে আস্বাদন করা যেতেই পারে। অর্থাৎ ভালো মানের একটি ভ্রমণকাহিনি পাঠ করে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা অসম্ভব কিছু নয়। অতি সম্প্রতি পাঠ করা সে রকম একটি ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের গল্প বলার জন্যই এত কথার অবতারণা।
কিছুদিন আগে ব্যক্তিগত বইয়ের তালিকায় যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু নতুন বই। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম ৫ জুন হাতে পেয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজ এবং স্নেহভাজন প্রিয় সহকর্মী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক, আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’খ্যাত আবদুল্লাহ আল মোহনের লেখা ‘দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টির ভারতভ্রমণ’ বইটি।
ভারতের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল হিসেবে পরিচিত দিল্লি, আগ্রা আর রাজস্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বইটির মূল উপজীব্য। আমাদের ভ্রমণটা আরও কতই না আনন্দময় এবং জ্ঞানানুসন্ধানী হতে পারত।
‘দৃষ্টি আর অন্তর্দৃষ্টির ভারতভ্রমণ’ নামকরণের মধ্যেই রয়েছে বইটির তথা লেখকের মূল কারিশমা। দর্শনীয় স্থানগুলোর সৌন্দর্য দৃষ্টিসীমায় যতটা ধরা পড়েছে তার থেকেও বেশি অনুভূত হয়েছে অন্তর্লোকে। বইটির আসল আকর্ষণ এখানেই। নামের সাথে রচনার সম্ভারের সৌন্দর্যে আমি অভিভূত। ভ্রমণস্থানের সাথে মিল রেখে ছবিগুলোর সংযোজনও অনবদ্য। দিল্লি, আগ্রা আর রাজস্থানের ঐতিহাসিক এবং উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানসমূহ ভ্রমণের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং সৌন্দর্য বর্ণনাই নয়, লেখক ইতিহাস-ঐতিহ্য-ভূগোল এবং ইতিহাসের পেছনের ইতিহাসকেও তুলে ধরেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে, যা রীতিমতো সাহিত্য হয়ে উঠেছে। অন্য অনেক ভ্রমণসাহিত্য থেকে বইটির স্বাতন্ত্র্যধর্মীতা এখানেই।
নামে ভ্রমণগ্রন্থ হলেও ইতিহাসের চরিত্রগুলোর পাশাপাশি লেখক ভারতের মরমি-আধ্যাত্মিক-ধর্মীয় গুরু, কবি-সাহিত্যিকদের জীবনীও বর্ণনা করেছেন, যে জন্য বইটিতে স্থান-কাল-পাত্রের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। মির্জা গালিব, খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী (র.), হজরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (র.) তো আছেনই, বাদ পড়েননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশও। অবিভক্ত ভারতবর্ষের কোঁচবিহার রাজবংশের রাজকন্যা জয়পুরের তৎকালীন রাজা দ্বিতীয় সোয়াই মানসিংহের প্রভাবশালী, বিদূষী বাঙালি রাজমহিষী গায়ত্রী দেবীর সঙ্গেও লেখক পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সুমধুর ভাষা-ছন্দে, কুশলী ইতিহাসের উপস্থাপনায়। যাদের শ্রমে-ঘামে নান্দনিক, শিল্পসমৃদ্ধ স্থাপনাগুলো তৈরি হয়েছিল, পেছনের সেই মানুষগুলোকেও লেখক স্মরণ করেছেন শ্রদ্ধাভরে।
‘পিংক সিটির আরও গল্প’ অধ্যায়টি বর্ণনার ঠাঁসবুননে রোমাঞ্চ আর রহস্যের জগতে পৌঁছে যায় যেন পাঠক। রাজা প্রতাপ সিং তাঁর প্রিয়তমা মহিষী রাঠোরজীকে ঘোড়ার পেছনে বসিয়ে প্রথম বারের মতো হাওয়া মহলে যখন নিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই যাত্রাপথের অনুপম বর্ণনা পড়ে মনে হচ্ছিল ভ্রমণকাহিনি নয়, ইতিহাস আশ্রিত কোনো উপন্যাসই যেন পাঠ করছি।
বইটি নিছকই ভৌগোলিক স্থানের বর্ণনা-সংবলিত ভ্রমণকাহিনি নয়, তথ্যবহুলও বটে। তবে তথ্যভারে ভারাক্রান্ত নয়, সাবলীল এবং সরস ভাষাগুণে। রেলগাড়ি সম্পর্কে আগ্রহী পাঠকগণ রেলগাড়ির পুরো ইতিহাসটাই পেয়ে যাবেন বইটিতে সংযোজিত রেলগাড়িবিষয়ক দুটো অধ্যায়ে। বাড়তি পাবেন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের ঝংকারও। জাদুঘর যে বিশ্ববিদ্যালয়সম শিক্ষাক্ষেত্র হয়ে ওঠে, তার প্রমাণ মেলে দিল্লির রেল জাদুঘর নিয়ে সবিস্তারে রচনায়। প্রতিটি জনপদের সাহিত্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টি-রসনা বিলাস-জীবনাচরণ সবটাই উঠে এসেছে বইটিতে। বাদ যায়নি পুরোনো এবং সমসাময়িক বিখ্যাত চলচ্চিত্রপ্রসঙ্গও।
নতুন দর্শনার্থী হিসেবে দর্শনীয় স্থানগুলোতে একজন দর্শনার্থী কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন, লেখক তার ফিরিস্তিও তুলে ধরেছেন। ভারতের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ভ্রমণে আগ্রহী দর্শনার্থীদের, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের জন্য বইটি অনন্য প্রয়োজনীয় গাইড হিসেবে সহায়তা করবে বলে আমার গভীর বিশ্বাস। প্রাঞ্জল এবং সাবলীল ভাষা ও বর্ণনাগুণে বইটি সকল শ্রেণির পাঠকের কাছেই সুখপাঠ্য হবে বলে আশা করি। দর্শনীয় স্থানের বেশ কিছু ছবি বইটিতে সংযোজিত হয়েছে, তবে ছবির নিচে স্থানের নামটি অনুল্লিখিত রয়েছে। নাম উল্লেখ থাকলে পাঠকের পক্ষে জায়গাটি সহজেই চিনে নেওয়া সম্ভব হতো। অর্থাৎ ছবিগুলোর নিচে ক্যাপশন বা বর্ণনা দেওয়া হলে পাঠকের জন্য আরও বেশি সহায়ক হতো।
আবদুল্লাহ আল মোহন রচিত প্রবন্ধের বইগুলো পাঠকমহলে যেভাবে সাড়া জাগিয়েছে, সদ্য প্রকাশিত ভ্রমণকাহিনিটিও পাঠকদের নিরাশ করবে না বলে দৃঢ় বিশ্বাস আমার। সেইসঙ্গে অতিমারি করোনাকালের সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে ও নিজেকে সমৃদ্ধ করতে আমরা বই পড়ার প্রতি আরও বেশি মনোনিবেশ করব, এই প্রত্যাশাও করছি।