শামস আল মমীনের কবিতা
বৃষ্টি

বৃষ্টি হইলেই আমার ভিতর
কেমন রহস্য তৈরি হয়। মেঘলা আকাশ
হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠলে ভালোই তো লাগে।
অকস্মাৎ,
ছাই রং মেঘ বৃষ্টি ফোঁটা হয়ে
খাল-বিলে, খানাখন্দে
ছড়ায়ে-ছিটায়ে পড়ে,
অবিরাম ঝরে…
কারো কারো নিরস উঠানে ভালোবাসা আসে,
টলমল শিশিরের ভার কাঁধে হলুদ ঘাসেরা
উবু হয়ে পড়ে, আমিও অবাক দেখি,
চারদিক থেকে ঘন হয়ে আসা দুর্গম আঁধার।
বৃষ্টি হইলেই
কেন যে আমার এ রকম লাগে!
কিন্তু এতে বুড়াদের নির্ঘাত কষ্ট বাড়ে।
জানালার ফাঁক দিয়ে ওরা বৃষ্টি দেখে, কেউ কেউ
পশু-পাখিদের অসংকোচ ভালোবাসা দেখে
অতিশয় উচ্ছ্বসিত।
এ রকম দিনে
দেহের ক্ষুধার সাথে মনের ক্ষুধারও
চাহিদা ব্যাপক।
এই ভেজা ভেজা দিনে,
কোন কোন ঘর ভীষণ কর্মমুখর;
ইলিশ ভাজার ঘ্রাণ, আহা বর্ষা,
আয় বৃষ্টি,
বৃষ্টি হইলেই খালি এ রকম
সুখ সুখ লাগে..
খুকিদের ছোট ছোট হাত কি সোহাগে
ডাক দেয় আয় আয়,
আয় বৃষ্টি আয়। কিন্তু
এইসব দৃশ্য মনের ভেতর থেকে ঘরের ভিতর
ঘড়ির কাঁটার মতো
ঘুরেফিরে আসে, ফের আসে…
আর ওই গরিব চাষির আধপেট খাওয়া
পোঙটা পোলাপানগুলা
ভেলায় চড়িয়া
গরু-ছাগলের মতো
কচুরিপানার মতো
ভেসে ভেসে যায়, আর আমাদের, মানে
মধ্যবিত্ত আর
উচ্চবিত্ত যুবতীরা যাদেরকে জীবনে কিছুই করতে হয় না
এমনকি হাসতেও না; ওরা শুধু
নদীকূলে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে
ক্যামেরায় ছবি তোলে; আর ওই যে
আকাশের কাছাকাছি, মেয়েগুলা
জানালার শিক ধরে
ছেলেমেয়েদের ভেজাভিজি, ছোটাছুটি, হাসাহাসি দেখে;
ওদের নিত্যভাবনায়
দেহের গোপন সুরসুরি ছাড়া
জীবনের
অন্য কোনো অর্থ নাই। মনে মনে
ওরাও বৃষ্টিতে ভিজে,
ভিজে ভিজে
শিহরিত হয় কদম ফুলের মতো;
যদিও ওদের অলস ভাবনাগুলো চায়
গায়েবি হাওয়ায়
কেউ এসে মুছে দিক
ভেজা পিঠ,
খোলা ঊরু,
বুকের সমতল,
অসমতল
চাষযোগ্য করে তুলুক সকল শুষ্কজমি
ধরনীর তরে।
কেউ কেউ
এইসব দৃশ্য দেখে বিচলিত খুব, কিন্তু
ঘরে বসে বসে হিন্দি সিনেমার বিরতিতে
পেপসি খায়
কোকা-কোলা খায়, আর
মিনিটেই মাইক্রোওয়েভে হলুদ হলুদ পপকর্নগুলো
ফটফট করে ফুটে ওঠে,
ক্ষণিকের অনুতাপে
কী সুন্দর বিষণ্ণতা ধরে রাখে, চোখে-মুখে।
আমার গরিব দেশে বৃষ্টি হইলে কার কি আসে যায়?
বৃষ্টি হইলেই কি গাজায় বোমা পড়া বন্ধ হয়,
আসাদের সৈন্যরা দামেস্কে
ছেলেমেয়েদের আইসক্রিম কিনে দেয়,
বোমারু বিমানগুলো ঘরে বসে লুডু খেলে, নাকি
অং সু চি
রোহিঙ্গা নিধনে বিরত থাকে?
বৃষ্টি হইলেই খালি খালি দুনিয়ার কথা মনে হয়।
পথে পথে পরিচয়হীন
বালক-বালিকা
ওদেরও জ্বর-কাশি হয়,
ওদের মায়েরা শিয়রে বসিয়া
সারা রাত
গরম মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালে।
এ রকম মুহুর্মুহু বরষায় গ্রামীণ স্বচ্ছ সৌন্দর্যের কাছে
শহরগুলো কী নিদারুণ
মনমরা…
হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা
মুমূর্ষু রোগীর মতো মনে হয়; যেন
শহরগুলোতে...
দেয়ালে দেয়ালে
পানের পিকের মতো লেপ্টে থাকা পাপসব ধুয়ে মুছে
জগতের লাবণ্য বাড়ায়।
উদ্ভিদ ও প্রাণীদের মতো
বৃষ্টি নিয়া
বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের সীমা নাই;
তাঁরা জানে
আগের জনমে এইসব বৃষ্টিফোঁটা
বাষ্প হয়ে ছিল,
কেউ বলে বৃষ্টিরা আসলে
লাজুকও;
বরফে জমাট হয়ে হাজার বছর
নিজেকে আড়ালে রাখে। কিন্তু
বরফ অথবা বাষ্প যাই হোক
আমরা তাহাকে বৃষ্টি বলিয়াই ভালোবাসি।
বৃষ্টি হইলে বহুত কিছু, জালে
আটকা পড়া
ট্যাংরা-পুঁটির মতো ছটফট করে; মাছরাঙা,
সাদা সাদা বক
কালো কাক,
ব্যাঙ ও অন্যান্য
প্রাণীদের ক্রমাগত ডাকাডাকিতে আমরা
সবুজ সবুজ ঘাস আর প্রায় ডুবে যাওয়া
শস্যক্ষেত থেকে
অবিরাম শুনি
বহু বহু মিশ্রধ্বনি।
বৃষ্টি হইলেই
শিশুদের গায়ের ঘ্রাণের মতো
যত খুশি শুদ্ধবায়ু
বুকে ভরে নেওয়া যায়। আমাদের
কবিগণ এতদিন এসবের স্বাদগন্ধ
আমাদের পাতে তুলে দিয়ে আজও ক্লান্ত হন নাই।
আমরা আবার
পুরোনো দিনের স্মৃতি খুঁজি।
মায়ের মুখের হাসি হাসি ছবিখানি, নেই
আলনায় বাবার পাঞ্জাবি, নেই
দূরের শহরে ছেলেমেয়েদের সংসার দেখি
আর আজীবন
আমাকে আগলে রাখা হাতের ম্যাজিক টাচে
জেগে উঠি,
দেখি চারদিক বৃষ্টি,
বৃষ্টি…
এইসব বৃষ্টির পতন, এবং গুঞ্জন
ভেদ করে
গির্জার ঘণ্টাধ্বনি
আজানের সুর
শঙ্খধ্বনি
আমাদের লালসায় জল ঢালে, ঢেলে যায়।
এইসব জলকণা চিরকাল আমাদের
ভাসাইয়া নিয়া যায়,
আমাদের নিঃস্ব করে দেয়, তবু
আমরা তাহাকে বৃষ্টি বলিয়াই ভালোবাসি।
এই বৃষ্টি বৃষ্টি দিনে, প্রাণিকুলে প্রাণপণ
ডাকাডাকি,
বড়লোকদের অতিশয় মাখামাখি
ভালোবাসাবাসি… ভালো,
সবই ভালো… কিন্তু
বৃষ্টি হইলেই গরিবের ভাতে টান পড়ে
শিশুদের গালভরা হাসি ফুরাইয়া আসে…
যুবতীর বুকের কাপড় খসে পড়ে।
কোন তন্ত্রমন্ত্র কোনকালে গরিবের কামে লাগে নাই
তবু ওরা কেন যে তাকায় উনাদের দিকে
কেন যে তাকায়ে থাকে
উনাদের
দিকে…
১৫ সেপ্টেম্বর-৯ অক্টোবর ২০১৭
বেলরোজ, নিউইয়র্ক