বর্তমানের বিনাশ ও ভবিষ্যতের আয়োজন
আর বছরের আগের বছর লন্ডনে ভারত-পাকিস্তানি লেখক সালমান রুশদির একটি মাঝারি মাপের উপন্যাস ছাপা হয়েছে—নাম ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ অথবা মধ্যরাত্রির ছেলেমেয়ে। বলা যায় বইটি মধ্য-রজনীতে ব্রিটিশ দখলদারদের হাত থেকে ক্ষমতা সংগ্রাহক পাকিস্তানি ও হিন্দুস্তানি শাসকশ্রেণির তিন দশকব্যাপী কদর্য কার্যকলাপের একপ্রস্ত সরল দর্পণ।
এই বইয়ের সুবাদে বিদগ্ধ মহলে লেখকের খুব নামডাক হয়েছে। অনেকেই লেখকের অনেক বেশি তারিফ করেছেন। অভিযোগও উঠেছে লেখক যা এঁকেছেন তা সত্য অনুসন্ধিৎসায় অনিন্দ্য হলেও তাঁর মীমাংসা বড় হতাশায় আক্রান্ত। এই দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশে উদ্ধারের কোন আশাই যেন আর নেই। এর মধ্যে উজ্জীবনের কোন মশালচী তাঁর চোখে পড়েনি। লেখককে গুণ্টার গ্রাস ও গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে বলেই বোধ করি আরেকটি পাকিস্তানি ধুরন্ধর—তারিক আলি—এই মহাদেশের সাহিত্যকর্মের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তারিক আলির মতে আশার আলোকবর্তিকা অন্তত এই ক্ষেত্রটিতে আজও নিবে যায়নি।
পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশে নৈরাশ্যের বোধও আজ সর্বব্যাপী, এই বোধ ধুরন্ধরতম ঔপন্যাসিকের কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি দ্রুতগতির। পুরাতনের ভাঙ্গন আর নতুনের অপ্রাপ্তির মধ্যে এই নিরাশার প্রকাশ। সালমান রুশদির মতো ‘বাইরে থেকে’ দেখলে মনে হবে এই হয়তো স্বাভাবিক। তারিক আলি রুশদির সমজদারদের ভিতর থেকে চিত্রটি তখন কেমন দাঁড়ায় তার দিকে তাকাতে বলেছেন।
কবিতার কথাই ধরা যাক। গত চারশ বছরে দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশে সাহিত্যের কাফেলায় সম্ভবত কবিতার শিবিরই সর্বাগ্রে। সকলেই জানেন উত্তর ভারতের গৌরব ছোটমাপের গীতিকবিতা—বা গজলের—উৎপত্তি মোগল রাজদরবারে কি তার আশপাশে। সময়ে সময়ে এই কাব্য আপনকার পিতৃ-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গেয়ে উঠতেও পিছপা হয়নি। তাই আজও সে টিকে আছে মানুষের মুখে মুখে। ‘স্বাধীনতা’র আগে বা পরে দেশের রাজনীতির নেতারা যা বলার চিন্তা কিংবা সাহস করেননি কবিরা উঠে দাঁড়িয়ে তাই বলেছেন একাধিকবার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুহম্মদ ইকবাল, কাজী নজরুল ইসলাম, ফয়েজ আহমদে ফয়েজ, আকবর এলাহাবাদী কিংবা জোশ মালিহাবাদী প্রমুখ কবি প্রবর্তন করেছেন কবিতার নতুন নতুন ধারার।
বাংলাদেশে সেদিন পাঞ্জাবি সেনাপতিরা যখন বাঙ্গালি জনগণের রক্তে স্নান করছেন তখন বাংলাদেশের পক্ষে কাব্যসংহতি প্রকাশ করে এগিয়ে এসেছেন স্বয়ং পাঞ্জাবের চারণ কবি আহমদ সলিম প্রমুখ। পাকিস্তান সরকার এই কবিকে কারাগারে পুরে রেখে দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। নির্যাতন, হত্যা, গ্রেপ্তার, ত্রাসনীতি, কবিদের স্তব্ধ করতে পারেনি। কবিদের এই ভূমিকার জোরেই সম্ভবত তারিক আলি বলেছেন: ‘পাছে নতুন নতুন, ঢের বিপজ্জনক আবেগের আতিশয্য দেখা দেয়—এই ভয়ে অনেক সত্য চোখে ধুলা দিয়া জনসাধারণের দৃষ্টিপথ হইতে সরানো, ইতিহাসের বিবরণ হইতে লুকানো, আর পরম যত্নে গোপন করা হইয়াছিল। যাঁহারা এসব সত্যের সন্ধান করিতেছেন তাঁহাদের পক্ষে দক্ষিণ এশিয়ার অতি উঁচু হইতে শুরু করিয়া নিতান্ত সাধারণ কবি পর্যন্ত যাহা প্রকাশ করিয়াছেন তাহা বিবেচনা করিলেই যথেষ্ট হইবে।’ (১)
সময় আজ আমাদের কাছে যে জবাব দাবি করছে সাহিত্যিক অভিযান কিংবা কাব্যিক রূপকল্পে তার উত্তর ষোল আনা জুটবে না সত্য, তথাপি চিন্তাপ্রবাহের শক্তিকে—ভাবের ক্ষমতাকে—আজ আর ছোট করে দেখাও সুবুদ্ধির পরিচায়ক হবে না। কবি, গল্পকার আর চলচ্চিত্র নির্মাতার পালনীয় ভূমিকা আজ আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বরং বেশিই উজ্জ্বল।
অবশ্য আমাদের সকল সাহিত্যিকের আমলনামা সমান নিষ্পাপ বা পরিচ্ছন্ন নয়। একটা কথা না বললে অন্যায় হবে যে আমাদের সাহিত্যের একটা বড় অংশই বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার আলামত মাত্র। ইতিমধ্যে পুরানো হয়ে যাওয়া এই সাহিত্য আমাদের বর্তমান পরিবর্তনবিমুখ আর বিরক্তিকর দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে দায়ী।
রাজনীতিতে কেউ নতুন কিছু সৃষ্টি করতে চাইলে তাঁকে নতুন সাহিত্যসৃষ্টির কাজে লাগতেই হবে। কারণ রাজনীতিতে সাহিত্যের স্থান গতিসঞ্চারক প্রেরণার মতো। ১৯১৬-১৭ সনের দিকে চিনদেশে প্রথম যুগের বিপ্লবী নেতা ছেন তুশিউ এ রকমই উপলব্ধি করেছিলেন। ১৯৮৩ সনে এ কথাটাই আমাদের নতুন করে পড়তে হবে। তবে আমাদের দেশেও এরকম একটা ধারা আছে। এই ধারা আজও সম্ভাবনাময়।
আজকের এক আনকোরা লেখক মঞ্জু সরকারের গল্প সংগ্রহ ‘অবিনাশী আয়োজন’ কিছুদূর পড়ে আমার মনে হয়েছে বইটি আমাদের যুগের সৃজ্যমান এই নতুন সাহিত্যেরই ইশারা। হালে আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক পুঁজির অনুগ্রহে যে ধরনের পল্লী-গবেষণা আর তথ্যজরিপ চলছে তার একশটা খণ্ডে যতটা না সত্য পাওয়া যাবে তার বেশি বস্তুনিষ্ঠার সাক্ষাৎ মিলছে এই লেখকের এক একটি গল্পে। বাস্তবের সাথে যে করুণ বিযুক্তি এ দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক নেতাদের ভাগ্যলিপি সেই বিযুক্তিকে যুক্তিতে পরিণত করতে চাইলে—পরিণতির সেই পুলসেরাত পার হতে চাইলে—এই গল্পগুলি আঙ্গুল টিপে পড়তে হবে।
১৯০৫ সালের প্রথম রুশ বিপ্লব কি বস্তু ছিল তা খোদ লিয়েফ তলস্তয়ও বুঝতে পারেননি। ব্যক্তিগতভাবে এই বিপ্লবের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ছিল বিরাট—তবু মহাত্মা লেনিন তাঁকে চিত্রিত করেছিলেন ‘রুশ বিপ্লবের দর্পণ’ জ্ঞানে: ‘... যথার্থই মহান শিল্পী হলে তিনি নিজ রচনায় বিপ্লবের অন্তত কিছু কিছু সারবান দিক প্রতিফলিত করেছেন নিশ্চয়ই।’ যুগের প্রধান প্রবণতাকে ধরতে পারার মধ্যেই শিল্পীর মহত্ব বা কমপক্ষে শিল্পিত্ব চেনার একটা উপায় আমরা খুঁজে পাই।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধাংশেরও বেশি এখন ভূমিহীন শ্রমিক। এই জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের চার ভাগ চরম দারিদ্রসীমার নীচে মানবেতর জীবনধারণে বাধ্য হচ্ছেন। এর চেয়ে বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা আজ আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না। এ সত্য বুর্জোয়া খবরের কাগজেও আজ আর ষোল আনা অস্বীকৃত নয়। এর চেয়েও গভীরতর সত্য আছে এই অবস্থাস্রষ্টা প্রক্রিয়ার মধ্যে।
উদাহরণস্বরূপ দেখাতে পারি, মঞ্জু সরকারের একটি চরিত্র বলে: ‘খরা-বইন্যা-আকাল মংগা সব হইল আল্লাহর ইচ্ছা। কথায় কয়, ধন-দৌলত-হায়াত-মউত-রেজেক সব হইল আল্লার ইচ্ছায়।’ আর একটি চরিত্র জবাব দিতে থাকে: ‘আল্লা আছে খালি তোর মতো কামলার গোঁয়ায় বাঁশ দেওয়ার জন্যে। দ্যাশত যখন মংগা নাগে, সেরাজ চৌদরীর ঘর কি একবেলা না খায়া থাকে রে, হ্যাঁ?’ সে আরও বলে: ‘এককালে হামারও তো কমবেশি জায়গা-জামিন আছিল—কোটে গেল সউগ? আল্লা কি ধন-সম্পত্তি আসমানত তুলি নি গেইছে?’
সমসেরের মতন কামলাও এখন বলতে শিখেছে: ‘আরে আল্লা খোদা নয়, সেরাজ চৌদরীর মতন ধনী মাইনষার জন্যে হামার এই দৌক্ষদুর্দশা।’ মন্তাজ আলী যোগ করে: ‘... খালি সেরাজ চৌদরী ক্যান, দিনাজপুর বগুড়ার কামত যায়া এবার দেখি আসছোঁ, এই কাতিমাসী মংগাতেও সেটেকার মহাজনদের কি সান-শওকত! টাউন-বন্দরে ভদ্দরলোকদের কি ঠাকবাট।’
এর বেশি নয়, কিন্তু এরও পেছনে যে দাঁড়িয়ে আছে হরেক চরিত্র—রেলের চেকার, শহরের মধ্যবিত্ত গৃহস্বামী, রাষ্ট্রপতির হেলিকপটার, ফুড ফর ওয়ার্ক, টেস্ট রিলিফের গম। এসব কাহিনি লেখক ভালোভাবেই জানেন। ১৯৮০ সালের দশকে এই লেখকের কাছে গ্রামীণ ক্ষমতাধর জমিজিরাত ধনদৌলতওয়ালাদের সঙ্গে পুলিশ, আদালত ও রাষ্ট্রের যোগসূত্র আর অত অস্পষ্ট নয়। এই যোগাযোগ সুদূর মার্কিন মুল্লুক অবধি বিস্তৃত—এ খবরও জানা হয়ে গেছে। খালকাটা, রাস্তাঘাটে মাটিচাপা দেওয়া আর পরিবার পরিকল্পনাশুদ্ধ দেশের উন্নয়নের রঙ্গিন কল্পনা সব ধরা পড়ে গেছে অভিজ্ঞতার নৃশংস দর্পনে।
লেখক এঁকেছেন সত্তরের দশকের আকাল-পীড়িত গ্রামীণ সর্বহারার চিত্র। এ চিত্র জয়নুল আবেদিনের আঁকা ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরকালীন ছবি সম্প্রদায়ের মতোই নির্মম, নিষ্ঠুর, অকরুণ। কিন্তু নির্মমতার মধ্যেই এর শেষ নয়। এর অবসাদের ধারাবেগও লেখকের দৃষ্টিসীমায় বিদ্ধ। এই আবেগ হয়তো অপাপবিদ্ধ নয়। খুশির খবরটা এইখানেই।
এই গল্পগুলোর পট উত্তর বাংলার, বিশেষ করে জেলা রংপুরের। যদিও কমবেশি সারা বাংলাদেশের চেহারাই এমনধারা তবুও উত্তর বাংলায় এই চিত্রের চূড়ান্ত হয়েছে। এই অবস্থার পশ্চাদপট যে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন প্রণালী তারও পশ্চাতে যে শ্রমের আন্তর্জাতিক বিভাজন ও বণ্টনপদ্ধতি সে কথা লেখককে কোথাও বক্তৃতার আকারে বলতে হয়নি। ছবিটি এমনিতেই ছায়া হয়ে এসেছে।
কিন্তু বিশ শতকের এই শেষ তেহাইয়ে ‘তৃতীয় বিশ্বের তৃতীয় বিশ্ব’ পদবাচ্য বাংলাদেশ, তার সমাজ ও রাজনীতির প্রধান স্ববিরোধ নিরসনের পথই ধরতে পারে। এই পথ জটিল—এ সত্যে সন্দেহ করি না কিন্তু এ পথ না ধরে বাংলাদেশ মুক্ত হতেও পারবে না। সেই জন্যই লেনিনের কড়া মাপকাঠিটি মেনে নিয়েও এই নবীন লেখককে আমরা বড় শিল্পীর লক্ষণাক্রান্ত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের মহান শিল্পী ভাবতে পারি।
প্রথম প্রকাশ : উত্তরণ, ঈদসংখ্যা, ৮ জুলাই ১৯৮৩
বোধিনী
(১) If one is looking for facts long obscured from public view, hidden from history, carefully concealed lest they excite newer and more dangerous passions then one need only study the outpourings of South Asia’s poets from the highest to the lowest.
দোহাই
১. মঞ্জু সরকার, অবিনাশী আয়োজন (ঢাকা : রূপম প্রকাশনী, ১৯৮২)।