হাসির গল্প
রবিনহুডের কবলে
দুইটা টিউশনি থেকেই বেতন দিতে দেরি করায় ফাহিমের কপালে অমাবস্যার ভাঁজ। স্টুডেন্টের বাবা এটা ইচ্ছা করে করেছেন, না অনিচ্ছায়, সেটা বুঝতে পারছে না ফাহিম। হাফিজেরও একই অবস্থা। পার্টটাইম যে জবটা করত সেখান থেকে ঈদের একদিন আগে বেতন দেওয়া হলো। ফাহিম ও হাফিজের বাড়ি কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুর।
ঈদের দুদিন আগে রওনা দিয়ে ঢাকা থেকে কুড়িগ্রাম যাওয়া প্রায় অসম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা, কোনো গাড়ির টিকেট পাওয়া যাবে না। ট্রেনের অবস্থা ভয়াবহ। ফাহিম যখন ভাবছিল, এবার সাধের কোরবানির ঈদটা ঢাকায় করতে হবে মেসের ডিমভাজি আর আলুভর্তায়, তখন বন্ধু হাফিজ দৌড়ে এলো। নিজের ব্যাগ গোছানোর পাশাপাশি ফাহিমকে তাড়া দিচ্ছিল ব্যাগ গোছাতে। ‘কীভাবে বাড়ি যাবি’ ফাহিমের এমন প্রশ্নে হাফিজ শুধুই বলল, ‘তোর সব প্রশ্নের উত্তর ট্রান্সপোর্টে উঠে দেওয়া হবে। এখন অডিও স্টপ অপশনে রেখে ভিডিও চালু কর, মানে, মুখটা বন্ধ করে হাত চালা।’
শান্ত বালক ফাহিম আগে থেকে না জেনেবুঝে কোনো কিছুই করবে না। নিরুপায় হয়ে উত্তেজিত হাফিজকেই ফাহিমের ব্যাগ গুছিয়ে দিতে হলো।
‘শোন, আমার বুদ্ধির ওপর ভরসা রাখ। এবারের জার্নি হবে তোর জীবনের সেরা জার্নি। দেখা যাবে পরীক্ষার খাতায় রচনা লেখার সুযোগ এলে এই জার্নি নিয়েই লিখবি। আগের সব মজার জার্নি তোর মেমোরি থেকে ফরমেট খেয়ে যাবে।’ হাফিজ ফাহিমের মুখ স্টপ অপশনে রাখতে বলে নিজে রীতিমতো প্লে মুডে আছে।
পরের দিন সকাল ৮টায় ফাহিমকে নিয়ে হাফিজ হাজির গাবতলীতে। বাসস্ট্যান্ডে নয়, গরুর হাটে। ফাহিমের ঘোর লাগা ভাব তখনো ছাড়ে নাই। ‘আচ্ছা, তুই এবার অনেক টাকা স্যালারি পেয়েছিস। আর ঢাকায় গরুর দাম এলাকার চেয়ে কম বলে ঢাকা থেকে গরু কিনে নিয়ে যাবি?’ ফাহিমের এমন প্রশ্নে হাফিজ হ্যাঁ-না কিছুই না বলে গলা টান করে কী যেন খুঁজছিল। কয়েক ঘণ্টা গোবরের গন্ধের মাঝে ফাহিমকে দাঁড় করিয়ে রেখে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করল হাফিজ।
চোখেমুখে ‘ইউরেকা’ ভাব নিয়ে হাফিজ ছুটে এলো। হাফিজ-ফাহিম উঠেছে একটা গরুর ট্রাকে। উত্তরবঙ্গ থেকে এই ট্রাকে করে গাবতলীর হাটে গরু আনা হয়েছিল। সব গরু বিক্রি করে ফেরার সময় এরা কিছু মানুষকে নিয়ে যায়। এতে করে উপরি কিছু ইনকাম হয়, আবার দরিদ্র শ্রেণির কিছু মানুষের ঘরে ফেরার সুযোগও তৈরি হয়। সাধারণত যারা গরুর হাটের শ্রমিক অথবা ঢাকায় মাটি কাটার মতো কাজ করে, তারা ফেরত ট্রাকে বাড়ি যায়, ফাহিম তো কিছুতেই উঠবে না। এর জন্য হাফিজকে আধা ঘণ্টা লেকচার দিতে হয়েছে। পেপার বিছিয়ে জটলা পাকিয়ে বসেছে সবাই। ফাহিমের কানের কাছে মুখ এনে হাফিজ বলল, ‘কী রে গোবরের গন্ধ পাচ্ছিস?’ ফাহিম ডানে-বায়ে মাথা নাড়ল। ‘পাবি না, কারণ গরুর হাটে যে সময়টা দাঁড়িয়ে ছিলি, সে সময়ে তোর সেন্সর গোবরের গন্ধের সঙ্গে অ্যাডজাস্টেড হয়ে গেছে। দেখিস, খোলা আকাশ দেখতে দেখতে বাড়ি যাওয়ার মজাই আলাদা।’
ওভারলোড করে ট্রাক ছাড়ল। সমস্যা হচ্ছে, গাবতলী থেকে সাভার আসতেই কয়েক ঘণ্টা লেগে গেল। একদিক দিয়ে সারি সারি গরুর ট্রাক ঢাকায় ধুঁকছে, আরেকদিক দিয়ে ঢাকার মানুষগুলো বাড়ি যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। স্থির জ্যামে বসে থেকে মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়া কোনো প্রাইভেটকার রং রুটে গিয়ে জ্যামটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। প্রাইভেটকার ও ট্রাক ড্রাইভারদের কল্যাণে কোনো গাড়ি এদিক-ওদিক একটুও নড়তে পারছে না। পুরা স্থিরাবস্থা। ফাহিম আর সহ্য করতে পারছে না। চোখ-মুখ লাল করে হাফিজের দিকে তাকিয়ে দেখে সে পাশের যাত্রীর গায়ে হেলান দিয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এ অবস্থায়ও একজন মানুষ কী করে ঘুমায়, ভাবতে ভাবতে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল।
ক্লান্ত ফাহিমের ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার একটু পর। ততক্ষণে তারা চান্দুরা এলাকায় আসছে।
হাফিজ তখনো আশা ছাড়ে নাই। ‘আর একটু, তারপর দেখবি রাস্তা একদম ক্লিয়ার। পানির মতো। কত দ্রুত বাড়ি চলে যাবি, ভাবতেও পারবি না।’ ফাহিম কিছু বলছে না, প্রচণ্ড খুদায় কিছু বলার মতো মুডে সে নাই। রাত ৯টা-১০টার দিকে আবারো স্থিরাবস্থার মধ্যে পড়তে হলো তাদের। এবারের সমস্যা, একটা ট্রাক মাঝরাস্তায় ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। সেটাকে ঠেলে রাস্তার পাশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চারপাশে গাড়ি থাকায় সহজে তা করা যাচ্ছে না। ফাহিম কোনোমতে হাফিজের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খাবার কিছু একটা ব্যবস্থা করবি, না উপোস থাকার নিয়ত করেছিস।’ হাফিজের মুখে হাসি দেখা গেল। ফাহিম দুঃসহ জার্নির ভেতরেও খাবার নিয়ে ভাবছে। তার মানে বর্তমান অবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। শুভ লক্ষণ। ফাহিমকে রেখে হাফিজ গেল খাবার আনতে। ফেরার নাম নাই। এদিকে পথ ক্লিয়ার হয়ে যাওয়ায় গাড়ি ছেড়ে দেয় দেয় ভাব। একজন বাইরে গেছে বলে কিছুক্ষণ গাড়ি থামিয়ে রাখা গেল। ট্রাকের অন্য যাত্রীদের চিৎকারে ফাহিমকে নামিয়ে দিয়ে ট্রাক ছেড়ে দিল।
হাতে দুজনের ব্যাগ নিয়ে চলে যাওয়া ট্রাকের দিকে বিধ্বস্ত বদনে তাকিয়ে আছে ফাহিম। দীর্ঘক্ষণ পরে মঞ্চে হাফিজের আগমন। তার এক হাতে শিঙ্গাড়া, আরেক হাতে পুরি। গরম শিঙ্গাড়া পাচ্ছে না বলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভাজিয়ে নিয়ে এসেছে। গরম শিঙ্গাড়া দেখলেই ফাহিমের রাগ শীতল হয়ে যাবে আশা করেছিল। মুখে কিছু বলতে হলো না ফাহিমের। ট্রাক যে তাকে রেখে চলে গেছে, সেটা বুঝে ফাহিমকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। ‘শোন দোস্ত, বিয়ে হয়ে যাওয়া প্রেমিকা আর ছেড়ে যাওয়া গাড়ির কথা ভাবতে নেই। এতে ক্ষতি ছাড়া লাভের চান্স শূন্য। চল ওই টি-স্টলে বসে আগে খেয়ে নিই।’
এই অবস্থায় কেউ আগ্রহ ভরে শিঙ্গাড়া চিবাতে পারে, হাফিজকে না দেখলে অজানাই থেকে যেত ফাহিমের। এত রাতে কোথায় যাবে, কী করবে ভাবছে ফাহিম, হাফিজ শিঙ্গাড়া শেষ করে পুরি খাচ্ছে। দোকান বন্ধ, রাস্তায় গাড়ির ছুটে চলা বাদে চারদিকে শ্মশানঘাটের নিস্তব্ধতা। এখানেই হয়তো রাত থাকতে হবে।
নিস্তব্ধতা ভাঙল তিন যুবক। তাদের হাতে মাঝারি সাইজের দুইটা চাকু। হাফিজ-ফাহিমের সামনে এসে দাঁড়াল। ‘ভাইজানেরা, যা আছে ভালোয় ভালোয় দিয়ে দেন। আমরা এলাকায় জনসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করি। এই ধরেন গরিবদের সাহায্য করা, বড়লোকদের থেকে ছিনতাই করা...। রবিনহুড যেটা করত। আপনারা বাড়ি যাওয়ার ভাড়া রেখে টাকাপয়সা যা আছে দিয়ে দেন,’ বলছিল তিনজনের মাঝের লোকটা। ফাহিম সুবোধ বালকের মতো সবকিছু দিয়ে দেওয়ার মনস্থির করছে। এমন সময় হাফিজ মুখ এগিয়ে এনে নিচু স্বরে ফাহিমকে বলছে, ‘শোন, একদম ঘাবড়াস না। এরা অকেশনাল ছিনতাইকারী। ঈদ উপলক্ষে মাঠে নেমেছে। মাঝের জনকে লিডার মনে হচ্ছে। আমি কথা বলে ওদের ব্যস্ত রাখব। তুই এক পা এগিয়ে গিয়ে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে লিডারটার দুই পায়ের মাঝখানে জোরসে লাত্থি মারবি। একেবারে পাওয়ার পয়েন্টে। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে। লিডারকে ধরাশয়ী করতে পারলে আর কোনো চিন্তা থাকবে না, বাকিগুলা ঝেড়ে পালাবে।’ ফাহিম পারবে না বলে ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল। ধমকে উঠল হাফিজ, যা বলছি শোন। আমি ওদের কথা বলে ব্যস্ত রাখব। তুই অ্যাকশনে যাবি। গো ফাহিম গো। বলে আধুনিক জামানার রবিনহুডের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। একই সঙ্গে কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে ফাহিমকে প্ররোচিত করছে অ্যাকশনে যাওয়ার জন্য। প্ররোচনা খুব খারাপ জিনিস। ফাহিম চোখ বন্ধ করে এক পা এগিয়ে গেল। হাফিজের শেখানো পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে শরীরের সমস্ত শক্তি পায়ে এনে কষে লাথি লাগাল। দুই পায়ের মাঝখানে। ‘ইয়াপ’ করে ভোঁতা একটা শব্দ হলো। মনে মনে নিজের টাইমিংয়ের প্রশংসা করল ফাহিম। বন্ধু হাফিজকে দুইটা ধন্যবাদও দিয়ে দিলে। তাকে দিয়ে এমন একটা কাজ করিয়েছে যে, এক জীবন গল্প করে বেড়ানো যাবে।
এবার চোখ খুলে দেখা দরকার। চোখ খুলে দেখে হাফিজ সর্বশক্তি দিয়ে দম আটকাবার চেষ্টা করছে। দুই হাতে ফাহিমের আঘাত করা স্থান চেপে ধরে আছে। তার মানে অতি উত্তেজনায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি না ঘুরে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে ফেলেছিল। যাতে করে তার অ্যাকশন রবিনহুডের ওপর প্রয়োগ না হয়ে হাফিজের ওপর হয়েছে। জ্ঞান হারানোর আগে হাফিজ কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। কী বলতে চেয়েছিল জানার খুব ইচ্ছে ফাহিমের।