মুক্তগদ্য
নীল আকাশে কে ভাসাল সাদা মেঘের ভেলা
তুমি দৌড়ে যাও ওই ঘন কাশবনের মধ্য দিয়ে। তোমার পরনে সাদা জামা, আকাশি উড়না। মাথার ওপর আকাশি রঙের আকাশ। আর সাদা সাদা তুলোর মতো মেঘ। এমন রোদ! কী যে হাওয়ার মাতামাতি! তুমি ছুটছ। বংশাই নদের সাদা মাটিতে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে। বাতাসে কী সুর বাজে তুমি জানো? জানো তো অবশ্যই।
শরৎ! শরৎ! শরৎ!
আহা! শরৎকাল!
শরৎকাল এলেই তোমার প্রথম কোন কথাটি মনে হয়? তোমার মনে হয়, ‘আজি আশ্বিনের মাঝামাঝি, উঠিল বাজনা বাজি।’ কেননা, সারা বছর ধরে তুমি অপেক্ষা করতে থাকো শরৎকালের জন্য। তুমি অপেক্ষা করতে থাকো কবে বেজে উঠবে ঢাকের বাদ্য। কবে বংশাইয়ের পাড় কাশফুলে ভরে উঠবে। তুমি তোমার মাতৃদেবীকে বলো, মাগো, জননী আমার মরে গেলে কিন্তু ওই কাশবনে আমায় কবর দেবে।
তোমার জননী রাগান্বিত হন।
বালাই ষাট! তুই কেন মরবি?
কেন মরতে পারি না! ওই খোকার মতো? রবিঠাকুর লিখেছেন না!
পূজার সময় মাকে সবাই বলে, তোর কোকা কোথায়?
“আমি তখন বাঁশির সুরে/আকাশ বেয়ে ঘুরে ঘুরে/তোমার সাথে ফিরব সকল কাজে। পুজোর কাপড় হাতে করে/মাসি যদি শুধায় তোরে, ‘খোকা তোমার কোথায় গেল চলে।’ বলিস খোকা সেকি হারায়/আছে আমার চোখের তারায়/মিলিয়ে আছে আমার বুকে কোলে।”
তোমার জননী কপট মারের জন্য উদ্যত হন। তুমি ভোঁ দৌড়। দৌড় দৌড় দৌড়। তোমার ফ্রকের ভেতর বাতাস ঢুকে ঢোলের মতো ফুলে উঠেছে। তোমার কলাবেণীর নীল ফিতে উড়ছে। তুমি উড়ছ, তুমি পাঙ্খইয়ের ঝোপ পেরিয়ে, ফসল তুলে নেওয়া ক্ষেতের মধ্যিখান দিয়ে তুমি ছুটছ। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে...’ তুমি কাশের বনে হারিয়ে যেতে চাও, সাদা কাশের রেণু হয়ে যেতে চাও।
দি দি ... ই...
যাই..
ওই যে অপু ডাকছে
দিদি...কোথায় তুমি?
এই যে
তোমাকে খুঁজে পাই না কেন?
তুমি দূর থেকে দেখতে পাও, আহারে ভাইটা বুঝি তাকে খুঁজে না পেয়ে এবার কেঁদেই ফেলবে। সে দৌড়ে এসে ভাইয়ের হাত ধরে।
‘যমের দুয়ারে দিলাম কাঁটা, ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা।’ এই বলে তুমি বংশাইয়ের সাদা মাটি তার কপালে লাগিয়ে দাও।
ধূর! দিদি! কী যে তুমি করো না! মাটি দিয়া দিলা কপালে!
আরে তোকে আশীর্বাদ করলাম।
শোনো ওই যে হালিম আছে না, ক্লাস ফাইভে তিনবার ফেল করছে, ও কইছে তুমি নাকি হিন্দু হইয়া গেছ?
ক্যান?
ওই যে বেশি বেশি নন্দিতা দিদিদের বাড়িতে যাও। মনে হয় এই জন্য। আর আমি যে তোমারে দিদি ডাকি। এইটাও নাকি হিন্দু ডাক।
ইহ! আমি হিন্দু হইয়া গেছি! ও কইলেই হইল? দিদি ডাকতে শিখাইছি তো কী হইছে? ও কি ‘পথের পাঁচালী’ পড়ছে? পড়ে নাই। তাই জানে না, অপু কেমন কইরা দুর্গার পিছন পিছন ছুটত। তুই আমারে দিদিই ডাকবি। নন্দিতাগো বাড়ি যাই তো কী হইছে? নন্দিতা কত ভালো! আর অই হানিফ! ও তো পরীক্ষায় গোল্লা পায়। আমি কি গোল্লা পাই? মাদ্রাসায় আমারে মোয়াল্লেম বানাইছে। সেইডা কি জন্য? ও তো আরবিও ভালোমতো কইতে পারে না। বাদ দে চল পাল পাড়া যাই।
ওরা দুই ভাইবোন মিলে ছুটতে থাকে পাল পাড়ার দিকে। বাতাসে ভাসতে থাকে।
জান্নাতুল ফেরদৌসী, ওইখানে ক্যান যাও?
আমার ভালো লাগে। ওই ঢোল, কাসর ঘণ্টা, খোল, ওই সিন্দুর, ওই শেফালি ফুল আমার ভালো লাগে। ওই যে গণেশ-কার্তিক-লক্ষ্মী-সরস্বতী, ওই যে দুর্গাদেবী, ওই যে অসূর আমার ভালো লাগে। ভালো লাগে দেবীর হাতের ওই বর্শা, ওই ত্রিশূল।
তুমি তো মাদ্রাসায়ও যাও। তোমার মাদ্রাসায় পড়তে ভালো লাগে না?
লাগে।
কিন্তু ওই মরুভূমি, উট, খেজুর বাগান, ঠিক বুঝি না। আমি চোখ বন্ধ করলে ওইগুলা দেখতে পাই না। এই যেমন চোখ বন্ধ করলাম, কাশফুল দেখলাম, নদী দেখলাম। ওইটা তো দেখি না।
শীতের শেষ দিকে তুমি বাড়ি থেকে গরম ভাত খেয়ে স্কুলে যাও। ফার্স্ট বেঞ্চের কোনার সিটটি তোমার জন্য নির্ধারিত। তুমি বসেছ। স্যার আসতে একটু দেরি। ফর্সামতো একটি মেয়ে তার পাশে বসে।
‘জান্নাতুল ফেরদৌস! তোমার নাম?’
হ।
তোমার?
নন্দিতা রানী সাহা।
কই থাকো?
ওই তো ডাকবাংলো পার হয়ে যে মাঠটা, মাঠের পাশে যে হলুদ বিল্ডিং ওইটা আমাদের বাসা।
ও, তোমরা নতুন আসছ?
হ। আমার বাবা রেভিনিও সিও।
আমার আব্বা থানা শিক্ষা অফিসার।
তুমি তো অনেক ভালো ছাত্রী। আমারে অঙ্ক করাইবা?
আচ্ছা।
জান্নাতুল ফেরদৌস, বান্ধবী নন্দিতা রানী সাহাকে অঙ্ক করায়। সন্ধ্যা হলে নন্দিতা ঘরে ধূপ দেয়। মাটির প্রদীপে তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালে। সেও বাসায় এসে ধূপ দেয়। প্রদীপ জ্বালে। ওরা দুজনে পুতুল খেলে। নন্দিতা বাসা থেকে বাইরে যায় না। নন্দিতা কাপড়ের পুতুল বানায়। একদিন জান্নাতুল ফেরদৌস মাটির দুটো পুতুল ওকে দিলে সে অবাক হয়।
তুমি বানাইছ?
হ। কেমনে বানাইলা? তুমি না মুসলমান।
কেমন বানাইলাম মানে কী? আমি তো মাটি দিয়া হাঁড়ি, পাতিল, পাখি, চুল, ছেলেপুতুল, মেয়েপুতুল বানাইতে পারি। রোদে শুকাইয়া আগুনে পুড়াইয়া এগুলো শক্ত বানাই। নদীর পাড়ের আঠাইলা মাটি হইলে ভালো হয়।
এবার সে নিজেই অবাক হয়। আসলেই তো! সে কখনই ভাবেনি, মাটির জিনিস যে সে বানায়, কেমনে বানায়? ওর আরেক সহপাঠী সুফিয়া খাতুন বলে : তুমি যে মাটির পুতুল বানাও, জীবন দিতে পারবা? এগুলা বানানো তো হারাম।
‘হারাম?’ কই কেউ তো তাকে বলেনি। তারা যখন জেলা শহরে থাকত তখনো বানাত। এখন এই থানা শহরে এসে সে শিখল, এগুলো বানানো হারাম। ‘হারাম’ বলতে এতদিন সে কেবল বুঝত তাস খেলা, জুয়া খেলা হারাম। তাই মামারা তাস খেলতে বসলে সে চিৎকার করত, নানা, মামারা তাস খ্যালে। মামারা তার মুখ বন্ধ করার জন্য রাজ্যের মার্বেল দিত তাকে। সে কাচের বয়ামে মার্বেলগুলো জমিয়ে রাখত।
তার মনে আছে, একবার সন্ধ্যামাসিদের বাড়িতে গিয়েছিল মায়ের সঙ্গে দুর্গাপূজায়। কীর্তন শুনেছে রাত জেগে। নলসন্ধ্যা গ্রামের হিজল গাছগুলো এখন কেমন আছে কে জানে? বাড়ি ফেরার পর আব্বা বলেছিল, কী দিয়ে ভাত খেয়েছ? সে বলে, পাঁঠার মাংস দিয়ে।
হায় হায়, তুমি বলির পাঁঠা খেয়েছ? তোমার তো জাত গেছে। এবার তো প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তুমি কেঁদে ফেলেছিলে? আব্বা তোমাকে কোলে নিয়ে অনেক হেসেছিলেন। ইশ! সন্ধ্যামাসির মা আতপ চাল গুঁড়ো করে যে পিটুলি বানায়। তাই দিয়ে ফুলকপির বড়া, সরিষার তেল দিয়ে মেখে রাখা মুসুরের ডাল রান্না করেছিলেন। এই ডালকে নাকি সিন্ধি ডাল বলে। তার মুখে সে স্বাদ এখনো লেগে আছে। রাতে থাকার জন্য সেই যে মামাদের কাঠের দোতলা বাড়িটা! কেমন ভয় ধরানো ভালো লাগা! ঘুম ভেঙে জানালা দিয়ে বিস্তীর্ণ সবুজ দেখতে পায় সে। জলো হাওয়া আসতে থাকে নদী থেকে। সন্ধ্যামাসিরা ছিল বসাক। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসির সহপাঠীরা বলত, ও, তোমরা তাঁতি?
সন্ধ্যামাসি একটুও বিব্রত না হয়ে বলতেন, না, আমরা তাঁতশিল্পী।
শরৎকাল এলেই তোমার সন্ধ্যামাসির কথা মনে পড়ে।
জান্নাতুল ফেরদৌস সমস্ত থানা শহরে লেখাপড়ায় এক নম্বর। সকালের মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের মোয়াল্লেম। ছোট হুজুর সব সময় ওকে দিয়েই পড়ান সবাইকে।
তারা সুর করে পড়তে থাকে।
নামাজের ফরজ ১৪টি।
এ নম্বরে জামা পাক
দুই নম্বরে জাগা পাক
তিন নম্বরে শরীর পাক
চার নম্বরে ছতর ঢাকা
পাঁচ নম্বরে দাঁড়ান
ছয় নম্বরে কেবলামুখী হওয়া
সাত নম্বরে রুকু
আট নম্বরে সিজদা...
চৌদ্দ নম্বরে নামাজ হতে ইচ্ছাপূর্বক বাহির হওয়া।
তারপর পড়ে জায়নামাজের দোয়া
ইন্নি ওয়াজ্জাহতু...
তারপর লাল ওড়না মাথায় দিয়ে কোরআন শরিফ বুকে বেঁধে বাড়ি ফেরে। আর পিছু পিছু হানিফ আসতে থাকে। আর তাকে টিজ করতে থাকে।
‘ওই ছেড়ি তর নাম কী?
ইাম দিয়া তর কাম কী?’
জান্নাতুল ফেরদৌস পায়ের জুতো ছুড়ে মারে ওকে।
বলে, তুই হইলি তিনবার ফাইভ ফেল। হেড স্যাররে কইলে তোর কী অবস্থা হইব তুই জানস?
হানিফ আর ওকে বিরক্ত করে না।
সেও স্বস্তি পায়। হানিফকে ভুলে যায়।
সে বাসায় ফেরে, স্কুলে যায়, বিকেলে গোল্লাছুট খেলে। কাঁদার মধ্যে মাছ খোঁজে। পোনামাছ মনে করে ব্যাঙাচি তুলে আনে। টাকি মাছ ভেবে আনে ঘাওরা মাছ। জিগার আঠা দিয়ে কাগজের ঘুড়ি বানায়। মাটির মধ্যে খোদাই করে মানুষের মুখ আঁকে। থানা সদরে পাশ দিয়ে যে ছোট্ট নদীটি গেছে তার পাড়ে ঘুরতে যায়। পুতুল বানাবে বলে মাটি তুলে আনে। সেখানেই সে আবিষ্কার করে মন্দিরটি। ঢাকের বাদ্য! দেবীর অর্চনা! আহা! কী আনন্দ! এখানেও ঢাকে বাদ্য আছে...
এই শহরে এসে মনটা তার খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার বুঝি আর দুর্গাপূজা দেখা হলো না। এখন সে খুবই আনন্দিত হয়। মুগ্ধ হয়ে পূজা দেখে। বাড়ি ফেরার পথে হানিফ আর তার সাঙ্গপাঙ্গো তাকে দেখে সরে যায়। সে সারা রাত ঘুমাতে পারে না। বহুদিন পর সে যেন তার গ্রামে ফিরে যায়। বউ নাচানি, চরক পূজা, সন্ধ্যা মালতির ম্যাজেন্টা, হলুদ ফুলগুলো দেখতে পায়। যেন তারা তাকে ডাকছে আয়...
আয়...
জান্নাত ওঠো! আব্বা ডাকছেন! ধড়মড় করে ওঠে বসে সে।
মাদ্রাসায় যাবা না?
আইজ না যাই!
কী কও? সবাই যাইতাছে। তুমি তো স্কুল-মাদ্রাসা কামাই করো না। যাও। বিকেলে তোমারে টিডিএনডিসির মাঠে ফুটবল খেলা দেখাতে নিয়া যাবো।
জান্নাত ওঠে। আকাশি রঙের জামা-পায়জামা আর সাদা জর্জেটের একটি ওড়না মাথায় দিয়ে বাসা থেকে বের হয়। রেহাল আর কোরআন শরিফ তার বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। কিন্তু মাদ্রাসায় তাকে দেখে সবাই কেমন চুপ হয়ে যায়। বিশাল মাদ্রাসা। এ-মাথা থেকে ও-মাথা দেখা যায়। সারা থানা শহরের ছেলেমেয়েরা কয়েকশ হবে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে।
বড় হুজুর কেন আজ? ছোট হুজুর কোথায়? বড় হুজুরের হাতে দুটো জালি বেত। বসে আছেন আসনে।
‘জান্নাতুল ফেরদৌসী।’
‘লাব্বায়েক।’
‘এদিকে আয়।’
সে দাঁড়ায়। হানিফের দিকে চোখ পড়ে। কেমন যেন জ্বলজ্বল করছে তার চোখ দুটো।
‘তুই নাকি কলেজ ফাংশনে নাচছস?’
‘জ্বী হুজুর, যখন থ্রিতে পড়তাম তখন।’
‘‘খামোস!’
‘কাইল ক্যান মন্দিরে গেছিলি?’
‘প্রতিমা দেখতে হুজুর।’
‘কারে কারে নিয়া গেছিলি?’
‘কাউরে ন, হুজুর।’
‘মিছা কথা কস?’
‘মিথ্যা আমি বলি না।’
‘এত বড় সাহস? আমার মুখে মুখে কথা কস? মেয়েমানুষ হইয়া একা একা ঘোরো? আইজ তোমারে শিখাবো আদব কায়দা কারে কয়!’
জালি বেতের শব্দ। সপাং সপাং।
জান্নাতুল ফেরদৌস, তুমি মার খাচ্ছ কেন?
তুমি না স্কুলে প্রথম হও? তুমি না মাদ্রাসার গর্ব ছিলে? তোমার কাছ থেকে সবাই আদব কায়দা শেখে?
তোমার কিছু মনে নেই। তুমি লুটিয়ে পড়ো। মেঝেতে। তোমার আসমানি জামা, সাদা ওড়না নীল আকাশের নিচে কাশফুলের রেণু হয়ে যায়। তুমি বংশাই নদের পাড়ে চলে যাও সাদা ভেলায় ভেসে। কাশবনের ভেতর লুকিয়ে পড়ো। দশ বছরের বালিকা তুমি হারিয়ে যেতে চাও রবিঠাকুরের ছোট্টখোকার মতো। যেন পূজোর দিন মা তোমাকে খুঁজে খুঁজে বেড়ায়। তুমি সারা আকাশময় ঘুরে ঘুরে বাঁশি বাজাবে। অথচ কেউ তোমাকে দেখতে পাবে না...