আদিবাসী পুরাণ
বজ্রপাত হলো রাজকন্যার ধমক!
পাহাড়গুলো অন্যরকম। শক্ত তার দেহ। কিন্তু কদাকার নয়। সবুজের সঙ্গে তার নেই কোনো বন্ধুতা। অথচ চারপাশটা সবুজে ভরপুর। দূরের পাহাড়গুলোকে রূপসী রমণীর মতো দেখায়। একটি পাহাড় আরেকটির সঙ্গে লাগানো।
বৃষ্টিতে জমেছে পানি। দুই পাহাড়ের মাঝে। সাদা মাটির স্পর্শে পানি তাই অপরূপ। একেবারে নীলাভ সবুজ। দূর থেকে স্বপ্নের মতো দেখায় চিনামাটির সাদা পাহাড়গুলোকে।
পাহাড়ের পাশে থাকা বাড়িগুলো অন্যরকম। মাটি আর ছনে ছাওয়া ঘর। ভেতরের অবয়বে কোনো বর্ণিলতা নেই। অধিকাংশই ভাঙাচোরা। বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে ঘরের ভেতরটায়। তবুও পাহাড়ের বুকে এভাবেই মাটি আঁকড়ে বেঁচে আছে হাজংরা।
ঘুরতে এসেছি নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে। গাইড হিসেবে আমাদের সঙ্গী হন স্থানীয় এক নাট্যকর্মী। নাম তাঁর গোপাল।
এখানে ঘুরতে মোটরসাইকেলের কোনো বিকল্প নেই। আমরা শিবগঞ্জ গুদারা পার হয়ে কামারখালীর পথ পেরোই। অতঃপর মেঠোপথে চলে আসি কুল্লাগড়া ইউনিয়নে। এখানেই রয়েছে চিনামাটির পাহাড়গুলো।
ইউনিয়নের একেবারে শেষপ্রান্তে সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। নামটাও বেশ। বগাউড়া। গ্রামের এমন নামকরণের কারণ জানা নেই স্থানীয়দের।
আমরা যখন গ্রামটিতে পৌঁছাই আকাশ তখন ফকফকে। মেঘ কাটিয়ে ঝলমলে রোদ উঠেছে। পুব আকাশে হঠাৎ একটি রংধনুর দেখা মিলল। তা দেখে হাজং গ্রামের ছেলেমেয়েদের সে কি আনন্দ। যে যার বাড়ির উঠোন থেকে দেখছে সেটি। রংধনুর রঙে বৃদ্ধদের মুখেও হাসির ঝলক।
গোপালের পরিচিত এক হাজং পরিবারের বাস পাহাড়ের পূর্বকোণে। পাহাড় কাটা রাস্তায় ধীর পায়ে চালে আসি ওই হাজং বাড়িটিতে। বাড়ির ভেতরটায় ভিড়। আবাল-বৃদ্ধদের সম্মিলন ঘটেছে যেন। আনন্দ নিয়ে সবাই রংধনু দেখছে আর নিজেদের মধ্যে আলাপ জমিয়েছে হাজং ভাষায়।
একটি ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। নাম মোহন হাজং। এখনো বেশ শক্ত-সামর্থ্য। বয়সের ভার তাঁকে নোয়াতে পারেনি। তাঁকে ঘিরেই ভিড় জমায় সবাই। ঘরের বারান্দায় বেছানো হয় মাদুর। অতঃপর তিনি বলতে শুরু করেন কিছু একটা। সবার মতো আমরাও উঠোনের এক কোণে বসে শুনি তা।
গৃহবধূ সুপতার শ্বশুর মোহন হাজং। তিনি চুপিচুপি বললেন, তাঁর শ্বশুর সবাইকে শোনাচ্ছেন রংধনু নিয়ে হাজং সমাজের বিশ্বাসের প্রচলিত গল্পটি। রংধনু নিয়ে হাজংদের ওই গল্পটির ভাবার্থ :
এক দেশে ছিল এক রাজা। তার ছিল এক ছেলে। এক মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই রাজার মেয়েটা ছিল অপরূপা সুন্দরী। তার রূপের আলোকছটায় অন্ধকার ঘরেও কোনো আলোর প্রয়োজন হতো না। রাজকন্যার রূপের আলোয় আলোকিত হতো চারপাশ।
দিন গড়িয়ে চলল। রাজার ছেলেমেয়েও বড় হতে থাকল। যৌবনে এসে রাজার মেয়ের রূপ যায় আরো বেড়ে। সে রূপ আছড়ে পড়ে চারপাশে। খুব কাছ থেকেই তা উপভোগ করে রাজার ছেলে। ভাই হয়েও মনে মনে সে ভালোবাসতে থাকে নিজের বোনকেই।
রাজা তাঁর ছেলেমেয়েকে সব সময় ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতেন। কখনো তাদের চোখের আড়াল করেননি। সকাল থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের কাছে কাছে রাখতেন। তাদের খুব বেশি আদর করতেন।
কিছুদিন যেতেই ভাই হয়েই রাজপুত্র রাজকন্যার প্রেমে মত্ত হয়ে ওঠে। ভাইয়ের আচরণে তা টের পেয়ে যায় রাজকন্যা। কিন্তু কী করবে সে! মুখ ফুটে সে কথা কাউকে বলতেও পারে না। এ যে বড়ই লজ্জার ব্যাপার! রাজকন্যা খুব সাবধানে নিজেকে সামলে রাখে। এদিকে যতই দিন গড়াতে থাকে ততই বোনের রূপে রাজপুত্র পাগল হয়ে ওঠে। রাজকন্যাও ধীরে ধীরে ভাইয়ের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে।
একদিন ঘটল এক কাণ্ড। খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ খাওয়ার ঘরে রাজপুত্র নেই। রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন ছেলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে নিজ ঘরে খিল এঁটে বসে আছে। রাজা গিয়ে অনুরোধ করার পরেও রাজপুত্র দরজা খুলল না।
রাজা এপাশ থেকে জানতে চাইলেন-হাতি, ঘোড়া, টাকশালের টাকা - তুমি কী চাও? যা চাবে তাই-ই পাবে।
উত্তরে রাজপুত্র নিজের রূপসী বোনকে বিয়ে করার প্রস্তাব করে। ছেলের প্রস্তাবে রাজার মাথায় যেন বাজ পড়ে। আদরের ছেলের একি উন্মাদনা! সে সময় ছেলেকে শান্ত করতে রাজা সে প্রস্তাবে রাজি হন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি ছেলের জন্য অন্য পাত্রী ঠিক করে ফেলেন। অন্যত্র বিয়ে হলে হয়তো রাজপুত্রের উন্মাদনা আর থাকবে না। তেমনটাই ভেবেছিলেন রাজার।
রাজবাড়িতে তখন রাজপুত্রের বিয়ের ধুমধাম। এর মধ্যেই সে জেনে ফেলে তার জন্য অন্য পাত্রী ঠিক করা হয়েছে। তার সঙ্গেই আজ তার বিয়ে হবে। তখন রাজপুত্র ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বিয়ের পোশাক ফেলে সে তার রূপসী বোনের খোঁজ করতে থাকে।
বোন তখন পুকুর ঘাটে স্নান করছিল। তার ভাই রাজপুত্র সেখানে গিয়েই বোনকে বিয়ের কথা বলে। শুনেই বোনের হৃদয় কেঁপে ওঠে। নিজের আপন বড় ভাইকে সে কী বলবে! রাজার মেয়ে তখন অশ্রুসজল চোখে মহাদেবকে স্মরণ করে। তাঁর কৃপা প্রার্থনা করে। ঠিক তখনই মহাদেবের আশীর্বাদ নেমে আসে। সে আশীর্বাদের শক্তিতে রাজকন্যা পুকুরের জল থেকে আকাশের দিকে উঠতে থাকে। এভাবে একসময় সে আকাশের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায়।
হাজংরা বিশ্বাস করে, এখনো আকাশ থেকে মাঝে মাঝে স্নানের দৃশ্য মনে হলে জলকণার স্মৃতিতে রাজার মেয়ে রংধনু হয়ে ফুটে ওঠে। রংধনু নিয়ে এটিই হাজংদের আদি বিশ্বাস। রংধনু তৈরির আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সঙ্গে যার অনেকটাই মিলে যায়।
গল্পটা শেষ হতেই সবার মুখে হাসি। পাশ থেকে তখন সুপতা জানায়, রাজার মেয়ে যখন আকাশে উঠছিল, তখন পিছু ডাকছিল তার রাজপুত্র ভাইটি। নিজের ভাইকে আকাশ থেকে সে তখন ধমক দেয়। রাজকন্যার সে ধমক আজও বজ্রের সঙ্গে মিশে আছে। তাই হাজংদের কাছে বজ্রপাত হলো রাজকন্যার ধমক।
আবার রাজকন্যা যখন আকাশে উঠছিল, তখন তার চোখেমুখে ফুটে ছিল লম্পট ভাইয়ের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ। তার সে আনন্দ আর মুখের হাসি ফুটে উঠেছিল বিদ্যুতের ঝলকানিতে। হাজংদের বিশ্বাসে সেটিই বিদ্যুৎ চমকানো আলো।
আরো গল্প তখনো চলছে। আমরা তখন আলাপ জমাই পাশে বসা সুদীপ হাজংয়ের সঙ্গে। পাহাড়ের ওপারেই তার বাড়ি। হাতে বাঁশের তৈরি ঢালার মতো কিছু একটা। সুদীপ জানায় হাজং ভাষায় এটি -যাক্ষা। যাক্ষা দিয়ে নদীতে মাছ ধরে যা পান তাই দিয়েই চলে তার সংসার। সুদীপ কথা বলে বাংলা ও হাজং ভাষার সংমিশ্রণে। দুঃখের সঙ্গে সে জানাল, বাংলা ভাষার আধিক্যের কারণে আজ হারিয়ে যাচ্ছে হাজং আদিবাসীদের মায়ের ভাষাটিও।
হাজংরা মঙ্গোলীয় জাতির হলেও এদের ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয়। কাছারের (আসাম) ভাষার অসংখ্য শব্দ এই ভাষায় ব্যবহৃত হয়। এদের জীবন প্রণালির সঙ্গে গারো ও কোচদের অনেক মিল রয়েছে। হাজংরা বিশ্বাস করে একসময় তাদের ভাষা অন্যরকম ছিল। কিন্তু আসামের হাজোনগর ছেড়ে ময়মনসিংহ ও গারো পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় বসতি গড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের ভাষারও পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘদিন বাঙালি সমাজের মাঝে বসবাসের কারণে কোনো কোনো বাংলা শব্দের সঙ্গে হাজং শব্দের, হাজং শব্দের সঙ্গে অহমিজ শব্দের এবং অহমিজ শব্দের সঙ্গে বাংলা শব্দেরও মিল তৈরি হয়েছে।
কথায় কথায় সুপতা হাজং জানাল, অন্যান্য আদিবাসীদের মতো হাজংরাও বিয়ের অনুষ্ঠানে কুলার মধ্যে ধান, দূর্বা, আতপ চাল, মিষ্টি, সিঁদুর ইত্যাদি দিয়ে বর-কনেকে বরণ করে। হাজংদের কাছে এটি আবশ্যকীয় একটি বিষয়। এরা বিশ্বাস করে ধান, দূর্বা, আতপ চালে রয়েছে জীবন-সার। আর সিঁদুর যৌন ও বিজয়ের চিহ্ন। তাই বিয়ের আচারগুলো পালনের মাধ্যমে ভাবি দম্পতির ভবিষ্যৎ জীবন ধনে-ধান্যে পরিপূর্ণ হবে, তেমনটাই কামনা করা হয়।
সুদীপ জানাল, হাজংদের বিশ্বাসে পৃথিবী কেঁপে ওঠার কারণটিও। হাজংরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে পৃথিবীটা বিরাট এক ষাঁড়ের মাথায় অবস্থান করছে। ওই ষাড় যখন পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা পারে না। তখনই সে ঝাঁকুনি দেয়। ফলে পৃথিবী কেঁপে ওঠে। আমরা যাকে বলি ভূমিকম্প। হাজংরা মনে করে, প্রকৃতিকে যত ধ্বংস করা হবে, প্রকৃতিও ততই তার বদলা নেবে। তখন ভূমিকম্পও বেশি হবে।
আসর ভাঙ্গতেই কথা হয় বৃদ্ধ মোহন হাজংয়ের সঙ্গে। তিনি দুঃখ করে বললেন, বিরিশিরিতে একসময় ছিল চিনামাটির বড় বড় পাহাড়। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ। দিনে দিনে তা কেটে পুকুর করে ফেলা হয়েছে। ফলে পাহাড়ে থাকা আদিবাসীরা জীবন বাঁচাতে নেমে এসেছে সমতলে।
ফেরার পথে মোহন হাজংয়ের একটি কথাই বারবার ঘুরপাক খায় মনের অতলে। সম্পদের লোভে মানুষ প্রকৃতিকে যেভাবে হত্যা করছে প্রকৃতিই কি ফিরিয়ে দেবে না তার কাক্ষিত জবাবটি!