ঢাকায় রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’

গ্যেটে ইনস্টিটিউটের আয়োজনে এবং দৃকের সহযোগিতায় গত ২৪ এপ্রিল বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটে দৃক গ্যালারিতে আলোকচিত্রী মোসকা নাজিব ও নাজেস আফরোজের ৫০টি স্থিরচিত্র নিয়ে ‘কাবুল থেকে কোলকাতা : সম্পর্ক, স্মৃতি ও পরিচয়’ শিরোনামে শুরু হয়েছে এক ভিন্নধর্মী আলোকচিত্র প্রদর্শনী।
কাবুলিওয়ালা অথবা কাবুলের লোক মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘কাবুলিওয়ালা’র মাধ্যমেই পরিচিতি পায় বাংলাভাষী পাঠকের কাছে। আফগানিস্তানের এই বিশেষ পেশার মানুষের কয়েকশ বছর ধরেই যাতায়াত ভারতে, তবে ১৮৯২ সালে কবিগুরু তাঁদের প্রতি সহমর্মী একটি গল্প রচনা করেন। সেই গল্প সকলেই পাঠ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর রচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ দুই আলোকচিত্রী ও সাংবাদিক মোসকা নাজিব ও নাজেস আফরোজ যৌথভাবে তিন বছরের একটি দীর্ঘ কাজ হাতে নেন। যার মূল লক্ষ্য ছিল, কাবুলিওয়ালা জনগোষ্ঠীর গত কয়েক দশকের সামাজিক পরিবর্তনগুলো তুলে ধরা। এ দুই আলোকচিত্রী প্রায় হারিয়ে যাওয়া কাবুলিওয়ালাদের এখনকার অবস্থানের কথা নিজেদের আলোকচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা গল্প বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও মঞ্চস্থ হয়েছে। এই গল্পে কবিগুরু লিখেছেন একজন সুঠামদেহী আফগান পুরুষের কথা, যিনি আরেক দেশে এসে দ্বারে দ্বারে শুকনো ফল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই কাবুলিওয়ালার পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় এক বাঙালি মেয়েশিশুর সঙ্গে। এই বাচ্চাটিকে দেখে কাবুলিওয়ালার মনে পড়ে আফগানিস্তানে রেখে আসা নিজের একমাত্র মেয়ের কথা। এমন এক মানবিক গল্প নিয়েই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন গল্পটি।
ভারতে বসবাসরত আফগান বংশোদ্ভূত মোসকা নাজিব বলেন, ‘নিজের মাতৃভূমি থেকে দূরে থাকার সুবাদে আমি সব সময় আত্মপরিচয় এবং নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি। এ ভাবনাই আমাকে বর্তমান কাজটি করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। কাবুলিওয়ালারা ভারতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে, তারা এ দেশে অন্যতম পুরোনো জনগোষ্ঠী। তাদের জীবনযাপনকেই ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা করেছি।’ নাজিব আশা করেন, এই আলোকচিত্রগুলোর মাধ্যমে দর্শক কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারবেন জন্মভূমি ছেড়ে নতুন দেশে, নতুন জায়গায় গিয়ে বসতি গড়ে তোলা কতটা কঠিন ।
নাজিব আরো বলেন, ‘আমি এই ছবিগুলো তোলার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করেছি যে কীভাবে একটি জনগোষ্ঠী ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে নিজস্ব সংস্কৃতি আর আত্মপরিচয়কে আগলে রেখেছে এবং তাদের বোঝার মাধ্যমে আমি আমার নিজের দেশ আফগানিস্তানের মানুষের সঙ্গে ওদের একটি যোগসূত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি।’
অন্যদিকে ভারতীয় সাংবাদিক নাজেস আফরোজ পুরো বিষয়টিকে একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখেছেন। তিনি বলেন, “একসময় কলকাতা শহরটি ছিল দারুণ বৈচিত্র্যময়। আর এই বিচিত্র শহরই আজকের এই আমাকে ‘আমি’ করে তুলতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল। কিন্তু আমি লক্ষ করেছি যে গত কয়েক দশকে সেই বৈচিত্র্য কোথায় যেন ফিকে হয়ে গেছে এবং এই পরিবর্তন কোনোভাবেই আমার জন্য সুখকর নয়। এই আলোকচিত্র সিরিজের মাধ্যমে আমি সেই পুরোনো বৈচিত্র্যময় কলকাতাকে সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বলা যায়, এটি কলকাতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রদর্শনের একটি মাধ্যম মাত্র। এই আলোকচিত্র সিরিজ মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, পরিচয়হীনতা এবং একটি নতুন পরিচয় ধারণ করা— এ সবকিছু নিয়ে একটি ধারণা পেতে সাহায্য করবে এবং ভাবিয়ে তুলবে।”
প্রদর্শনীটি ৬ মে পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য খোলা থাকবে।