আগাম বন্যার আশঙ্কায় নেত্রকোনার হাওরে চলছে ধান কাটা
হাওর অঞ্চলে কৃষকদের সারা বছরের একমাত্র ফসল বোরো ধান। হাড়ভাঙা কষ্টে ফলানো বোরো ধান ঘরে তুলতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছে নেত্রকোনার হাওর অঞ্চলের কৃষকরা। বন্যা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে যাতে নতুন করে কোনো ক্ষয়ক্ষতিতে পড়তে না হয়, তাই তাড়াহুড়ো করছে তাঁরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কায় নেত্রকোনার মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী হাওরাঞ্চলে দ্রুতগতিতে চলছে ধান কাটার কাজ। দেখেই মনে হবে, গোলায় তোলার কাজ শেষ হলেই বুঝি দুচিন্তা থেকে বাঁচে কৃষকরা।
জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে হাওরাঞ্চলে অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে শতাধিক কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও কৃষি শ্রমিকদের মাধ্যমে দ্রুতগতিতে চলছে ধান কাটা।
নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে নেত্রকোনা জেলায় এক লাখ ৮৪ হাজার ৯৮৩ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে খালিয়াজুরী উপজেলায় ২০ হাজার ১০০ হেক্টর, মদনে ১৭ হাজার ৩৪০ হেক্টর, মোহনগঞ্জে ১৭ হাজার ৪৩ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়। এ বছরে ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় সাত লাখ ৬৪ হাজার ৪৯৩ মেট্রিক টন।
আজ সোমবার দুপুরে নেত্রকোনার মদন ও খালিয়াজুরীর হাওরাঞ্চলে কৃষকদের ধান কাটা পরিদর্শন করে তাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন জেলা প্রশাসক কাজী মো. আবদুর রহমান।
এ সময় জেলা প্রশাসক কাজী মো. আব্দুর রহমান বলেন, ‘করোনাকালে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধান কাটেন তার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও শ্রমিক সংকট দূর করতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, কৃষকরা নির্বিঘ্নে তাদের পরিশ্রমের ফসল ভালোভাবেই ঘরে তুলতে পারবে।’
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘হাওরের তিন উপজেলায় আবাদকৃত ৫৪ হাজার হেক্টর জমির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ধান কাটা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। বর্তমানে পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রমিক ধান কাটছেন। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি অনুকূলে রয়েছে।’
ধান কাটা পরিদর্শনকালে উপস্থিত ছিলেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাবিবুর রহমান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত, মদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বুলবুল আহমেদ, খালিয়াজুড়ির ইউএনও এস এম আরিফুল ইসলামসহ জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।
নেত্রকোনা জেলার মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলার বিভিন্ন হাওরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, সর্বত্র কৃষকেরা ধান কাটা, মাড়াই ও শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করছে। কোথাও কৃষি শ্রমিক, কোথাও আবার সরকারের ভর্তুকি দেওয়া কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিনের মাধ্যমে ধান কাটা হচ্ছে। ধান কাটা ও মাড়াই নিয়ে কৃষকদের মধ্যে এক ধরনের উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। কিছুদিন আগে গরম ঝড়ো বাতাস ও শিলাবৃষ্টিতে হাওরাঞ্চলে বোরো ধানের আংশিক ক্ষতি হওয়ার পরও ধানের ফলন ভালো হওয়ায় খুশি কৃষকরা।
কৃষকরা জানায়, এ বছর ১০ থেকে ১২ এপ্রিল হাওরে ব্রি-২৮ ধান কাটা শুরু হয়েছে। আর এখন ব্রি-২৯ ধান কাটা শুরু হয়েছে। হাওরাঞ্চলে ধান কাটা শ্রমিকের সংকট রয়েছে। অনেক কৃষক ধান কাটা, মাড়াই ও শুকাতে তাদের স্কুল ও কলেজপড়ুয়া ছেলে মেয়েদের যুক্ত করছে।
মদন উচিতপুর হাওরের কৃষক মজিদ মিয়া বলেন, ‘গেল কয়েক বছরের চেয়ে এবার হাওরে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছিল। কিন্তু গরম বাতাসে অনেকের ধানের ক্ষতি হয়েছে।’
শেওড়াতলী গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন বলেন, ‘ধান কাটার পর জমিতেই ভেজা ধান ৮২৫ টাকা মণ দরে ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছে কৃষকরা।’
মাঘান গ্রামের কৃষক কামাল মিয়া বলেন, ‘আগাম বন্যায় যাতে ধানের কোনো ক্ষতি না হয় তার জন্য হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটার চেষ্টা করছি।’
মদন উপজেলার গাজীপুর গ্রামের কৃষক মামুন চৌধুরী জানান, তিনি ৮৫ কাটা জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান আবাদ করেছেন। তিনি কাঠাপ্রতি সাত থেকে আট মণ ধান পেয়েছেন।
মদন উপজেলার পরিতোষ সরকার বলেন, ‘ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে আমরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। সরকার যদি মাঠে সরাসরি কৃষকদের থেকে ধান কিনত তাহলে কৃষকরা আরও লাভবান হত।’
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত বলেন, ‘এরই মধ্যে জেলার হাওর এলাকায় ফসলরক্ষা বাঁধের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে অতিবৃষ্টি কিংবা বন্যা শুরু হলেও ফসলের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না।’
নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের সঠিক পরামর্শ ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় হাওরাঞ্চলে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সম্প্রতি মদন ও খালিয়াজরীতে গরম ঝড়ো হাওয়ায় বেশকিছু জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া শিলাবৃষ্টিতে বারহাট্টা, কলমাকান্দা ও মোহনগঞ্জে প্রায় সাড়ে চার হাজার হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। তারপরও আশা করছি এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদিত হবে।’