কলাগাছ থেকে সুতা তৈরি করছেন যমুনার চরের চার শিক্ষার্থী
সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার যমুনা নদীর চরে নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে কলাগাছ থেকে সুতা তৈরির কাজ করছেন চার শিক্ষার্থী। শামীম, মোহন, নাইম ও নাইমুর নামের এই শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে এ কাজ করে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।
উপজেলার চরগিরিশ ইউনিয়নের গুয়াহখোড়া গ্রামের এই শিক্ষার্থীরা নিজ ইচ্ছাশক্তির জোরে শুরু করেন এমন আত্মকর্মসংস্থানমূলক উদ্যোগ।
ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা মেকানিক্যাল টেকনোলজির শেষবর্ষে লেখাপড়া করছেন মোহন মিয়া ও শামীম রানা। আর ঢাকার তিতুমীর কলেজে রসায়নে স্নাতক পড়ছেন তানজিরুল ইসলাম নাইম। এছাড়াও নাইমুর ময়মনসিংহ টেকনিক্যাল সেন্টারে কম্পিউটার বিভাগের অধ্যয়নরত ছাত্র। মহামারি করোনার কারণে তাদের সবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ফলে এই শিক্ষার্থীরা চলে আসেন নিজ বাড়িতে। তাঁরা সবাই অলস সময় কাটাচ্ছিলেন গ্রামে। তবে আজ তাঁরা একটি সুন্দর স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
একদিন মোহন মিয়া ইউটিউবে খুঁজে পান কলাগাছ থেকে সুতা তৈরির কৌশল। সেই ভিডিও দেখালেন অন্য বন্ধুদেরও। সঙ্গে সঙ্গে চার বন্ধু মনস্থির করে কলাগাছ থেকে সুতা তৈরির মূল উপাদান ফাইবার তৈরি করবেন তাঁরা।
নেমে পড়লেন কাজে। প্রথমে তাঁরা ময়মনসিংহ থেকে চল্লিশ হাজার টাকায় কেনেন একটি ফাইবার এক্সট্রাকশন মেশিন। কয়েকদিন ভালোভাবে রপ্ত করলেন সুতা তৈরির নানা কৌশল। এরই মধ্যে পুরো চরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে কলাগাছ থেকে সুতা তৈরির গুঞ্জন। অনেকেই দেখতে আসেন। এতে উৎসাহ বাড়তে থাকে তাদের। কিন্তু কাজে সফল হতে হলে আরও কিছু টাকার দরকার। চাই একটি ঘর। তাদের সাহস ও সংগ্রামে মুগ্ধ হয়ে ওই গ্রামের ওয়াহাব নামের একজন এগিয়ে এলেন। তিনি একটি বড় টিনের ঘর তাদের কাজের জন্য দেন। সেই ঘরেই উদ্যোক্তারা মেশিন বসান। এছাড়াও মেশিন কিনতে মিলন নামের একজন তাদের কিছু আর্থিক সহায়তা দেন।
এরপর কলাবাগান থেকে কলার কাদি কাটার পরে ফেলে দেওয়া কলাগাছ আনা হয়। লম্বা করে কাটা হয় কলাগাছগুলোকে। এরপর কলাগাছের ওই লম্বা অংশগুলো মেশিন দেওয়া হয়। অনেকটা ধানের আঁটি থেকে ধান ছাড়ানোর মতোই। আর এতে মেশিনের অন্যপাশ দিয়ে আশ বেরিয়ে আসে। এসব সুতা রোদে শুকালে সোনালি রঙ ধারণ করে। প্রতিদিন ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ কেজি সুতা উৎপাদন করছেন তাঁরা।
তরুণ উদ্যোক্তা মোহন মিয়া বলেন, ‘কলাগাছের কাণ্ড দিয়ে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে সুতা। প্রতিদিন আমরা চার বন্ধু দিনরাত এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। সুতাগুলো বের হওয়ার পর তা রোদে শুকিয়ে নিয়ে ঘরে রাখছি।’
আরেক উদ্যোক্তা শামীম রানা জানান, সুতা তৈরির সময়ে উপজাত হিসেবে পাওয়া পানি আমরা সংরক্ষণ করছি। এই পানি বিভিন্ন ডিটারজেন্ট তৈরির কাজে এবং তারপিন তৈরির কাজে ব্যবহার হয়। এর মণ্ড থেকে পরিবেশবান্ধব পলিথিন ও নিউজ পেপার তৈরির গবেষণাও আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। আর কলাগাছের অবশিষ্ট অংশ জৈব সার হিসেবে উৎকৃষ্ট। তাই কলাগাছ থেকে সুতা তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটাই পরিবেশসম্মত।
উদ্যোক্তা নাইম বলেন, ‘প্রতিদিন আমরা চরের নানা প্রান্ত থেকে ঘোড়ার গাড়িতে করে কলাগাছ নিয়ে আনি। কলাগাছগুলো বিনামূল্যে সংগ্রহ করি। প্রতি গাড়িতে ৩০ থেকে ৩৫টি কলাগাছ পরিবহণ সম্ভব। গাড়িপ্রতি ভাড়া দিতে হয় দুইশ টাকা। দিনে প্রায় চার থেকে পাচঁটি গাড়িতে করে কলাগাছ আনা হয়। দূর্গম চরাঞ্চল হওয়ায় পরিবহণ ব্যয় বেশ বেশি।’
সুতার তৈরির পুঁজি এবং বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে মোহন মিয়া বলেন, ‘আমরা চারজনই নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষার্থী। নিজেদের উদ্যোগে কিছু টাকা নিয়ে এ কাজে নেমেছি। মেশিন ও অন্য খরচ মিলে প্রায় এক লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে এরই মধ্যে। এখনও আমরা সুতা বিক্রি করিনি। তবে ময়মনসিংহের আরেক উদ্যোক্তা আড়াইশ টাকা কেজি দরে এই সুতা বিক্রি করছেন। আবার ঢাকার এক ব্যবসায়ী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুতা নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে।
পরিবেশবান্ধব এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সরকারি সহায়তা দরকার জানিয়ে উদ্যোক্তারা জানান, এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০ কেজি সুতা তাঁরা উৎপাদন করেছেন। এখন সেগুলো রাখারই কোনো জায়গা নেই।
কাজিপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, ‘কলাগাছ থেকে চার শিক্ষার্থীর সুতা তৈরির খবরটি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। কলাগাছের অবশিষ্ট অংশ উৎকৃষ্ট জৈব সার। এটিও বিক্রি করা সম্ভব। উদ্যোক্তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। এ বিষয়ে সরকারি প্রণোদনার জন্য চেষ্টা করব।’
কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হাসান সিদ্দিকী জানান, কলাগাছ থেকে সুতার তৈরির বিষয়টি আমি অবগত হয়েছি। এটি একটি নতুন সম্ভাবনার দিক। তাঁরা চাইলে কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে টাকা নিতে পারবেন। এছাড়া সরকারি সহায়তার দিকটিও আমরা বিবেচনা করবো।’