চমেকজুড়ে হাহাকার : ঝলসানো শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছেন আহতরা
আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক)। আহতদের চিকিৎসায় ব্যস্ত মেডিকেলের বার্ন ইউনিট। দ্রুত চিকিৎসা দিতে চলছে ডাক্তার, নার্স, স্বেচ্ছাসেবকদের ছোটাছুটি। সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ডে আহত যাঁদের এখানে আনা হচ্ছে, তাঁদের শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে গেছে। কারও মাথায় লেগেছে মারাত্মক আঘাত। বুক-পেট-পিঠও পুড়ে একাকার। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তাই হাজারো মানুষের ভিড়। সেই ভিড়ে নিখোঁজদের খোঁজ পেতে মরিয়া স্বজনরা। আসছে নানা শঙ্কার খবর। বলা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত ৪৩ জনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেলেও ক্রমেই তা বাড়বে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পড়ে আছে এক যুবক। তাঁর এক চোখ ও পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ। হাতের চামড়া খসে পড়েছে। বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছিলেন। তিনি সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহত হয়েছেন। চেহারা দেখে ব্যক্তিটিকে শনাক্তের কোনো উপায় নেই। হাসপাতালে এক স্বেচ্ছাসেবক তাঁর ছবি নিয়ে ঘুরছেন। যেখানেই মানুষের জটলা, সেখানেই যাচ্ছেন তিনি। ছবিটি দেখিয়ে জানতে চাচ্ছেন, তিনি কারও পরিচিত কি না। অথচ, পাওয়া যাচ্ছে না আহতের স্বজন।
আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ। ওয়ার্ডে প্রবেশে করতেই ডান পাশের বেডে শুয়ে আছেন তিনি। পেটের অর্ধেক অংশ ঝলসে গেছে। ব্যান্ডেজ লাগানো পুরো পেটে। পাশে দাঁড়িয়ে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন তাঁর মামাতো ভাই রাসেল।
রাসেল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাইফুল্লাহ ওখানে ছয় বছর ধরে কাজ করছেন। তিনি স্টোরকিপার। গতকালের ঘটনা জানার পরপরই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু, পাইনি। পরে মেডিকেলে এসে অনেক খোঁজাখুঁজির পর পেলাম। ভালো করে কথা বলতে পারছেন না। পরিস্থিতি কেমন, সেটাও এখন ভালো করে বলা যাচ্ছে না।’
স্বজনদের আরেকজন তাহের উদ্দিন। তাঁর চাচাতো ভাই রফিক উদ্দিনের দুই হাত এবং মাথায় ব্যান্ডেজ। দুই পায়ের আঙুল পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘ ভাইয়ের ফেসবুক আইডি থেকে জানতে পারি ঘটনা। এরপর ভাইকে ফোন দিয়ে না পেয়ে সীতাকুণ্ডে চলে আসি। সেখানে না পেয়ে মেডিকেল এসে জানতে পারি, তিনি ৩৬ নং ওয়ার্ডে ভর্তি। এরপর বাড়িতে খবর দিই।’
গুরুতর আহত হয়েছেন নিরাপত্তারক্ষী হযরত আলী। বিস্ফোরণে তাঁর ডান হাতের নিচের অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ ছাড়া, বিস্ফোরণের সময় রাসায়নিক ছিটকে এসে তাঁর দু-চোখ মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বেডে একা একা শুয়ে কাতরাচ্ছেন। ‘তাঁর খোঁজে এখন পর্যন্ত কেউ হাসপাতালে আসেনি। আসলেও হয়তো খুঁজে পাচ্ছেন না’ বলে জানান আশপাশের মানুষ।
চমেকের চিকিৎসক রাজিব বলেন, ‘হযরত আলীর কনুইয়ের নিচ থেকে কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। চোখে রাসায়নিক ছিটকে এসে পড়ায় আর স্বাভাবিক হবে কি না, এখনই বলা যাচ্ছে না। তাঁর অবস্থা বেশ খারাপ। হাসপাতালে আনার পর শুধু বলেছেন যে, তাঁর বাড়ি নারায়ণগঞ্জে এবং তিনি নিশা গ্রুপের হয়ে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করতেন।’
মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে দায়িত্বরত নার্স সোমা দাস বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৯৩ জনের তালিকা আমার কাছে আছে। সবাই কমবেশি আঘাতপ্রাপ্ত। তাদের সেবা চলছে। একসঙ্গে এত দগ্ধ রোগী আর কখনো দেখিনি। দুর্ঘটনায় কারও মাথায় আঘাত লেগেছে, কারও আবার দুই হাতই ঝলসে গেছে। একজনের পেটের এক পাশ ঝলসে ভেতরে ঢুকে গেছে।’
এদিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর সেখান থেকে প্রথম ফেসবুক লাইভে আসা অলিউর রহমান ওরফে নয়ন (২০) মারা গেছেন। আজ সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকা মিলনের মরদেহ শনাক্ত করেন তাঁর স্বজনরা।
চমেক হাসপাতালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। অজ্ঞাত মরদেহগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। পরে সেগুলো মর্গে পাঠানো হবে। তারপর মরদেহগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পুরোপুরি নির্বাপণ হয়নি। আগুন যেন এই এলাকার বাইরে সমুদ্র এলাকায় যেতে না পারে, সে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট, সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশসহ বিশেষ টিম কাজ করছে। তবে, আগুন ডিপো এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু, বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল রয়েছে। একেক কেমিক্যাল একেক ধরনের, সে জন্য সময় লাগছে। তা ছাড়া মালিকপক্ষ কেউ না থাকায় কোথায় কোন কেমিক্যাল রয়েছে, তা আমাদের জানা নেই। তবে, আমরা চেষ্টা করছি আগুন যেন সমুদ্র এলাকা পর্যন্ত যেতে না পারে।’