রাঙামাটিতে আ.লীগের সম্মেলন ঘিরে ব্যস্ততায় নেতাকর্মীরা
দীর্ঘ ১০ বছর পর রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামীকাল।
এর আগে ২০১৯ সালে সম্মেলনের সব প্রস্তুতি শেষ করার পরেও সম্মেলনের পাঁচ দিন আগে স্থগিত হওয়ার পর ফের দুবছর পেরিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া এ সম্মেলনে সভাপতি ও সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন দুজন করে।
মোট চার পদপ্রত্যাশীর মধ্যে সভাপতি পদে লড়বেন ১৯৯৬ সাল থেকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করা বর্তমান সভাপতি ও সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান ও সহসভাপতি নিখিল কুমার চাকমা। আর, সাধারণ সম্পাদক পদে লড়বেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. মুছা এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজী কামালউদ্দিন।
আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছে—২৪৬ জন কাউন্সিলরের ভোটেই সম্ভবত নির্ধারণ হবে পরবর্তী নেতৃত্ব।
সভাপতি পদে গত দুই দশকে প্রথম বারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়েছেন দীপংকর তালুকদার। সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত প্রতিরোধ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ এ নেতা এক দশক ভারতে নির্বাসিত থাকার পর আশির দশকের মাঝামাঝি দেশে ফিরে আসেন এবং রাঙামাটি আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ১৯৯১ সালে তিনি নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন রাঙামাটি থেকে। এর আগে পার্বত্য এ জেলা থেকে আর কখনোই বিজয়ী হননি কোনো নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। সে থেকে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে তাকে ঘিরেই। এরপর অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনেই তিনি দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। এবং ২০০১ ও ২০১৪ সাল বাদে প্রতিবারই বিজয়ী হয়েছেন। রাঙামাটির আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে জনপ্রিয় এ নেতা, এই প্রথম চ্যালেঞ্জে পড়েছেন তাঁরই সাবেক রাজনৈতিক শিষ্য নিখিল কুমার চাকমার।
সভাপতি পদের আরেক প্রার্থী নিখিল কুমার চাকমা নব্বইয়ের দশকে শেষার্ধে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। জেলা, পৌর ও সদর উপজেলা কমিটির বেশ কিছু নেতাদের নিয়েই মাঠে নেমেছেন সহসভাপতি পদে থাকা নিখিল কুমার চাকমা।
আওয়ামী লীগের এবারের প্রথম মেয়াদে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা নিখিল বর্তমানেও জেলা আওয়ামী লীগের চার নম্বর সহসভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান। দলের নেতাকর্মীদের কাছে জনপ্রিয়তাও রয়েছে তাঁর।
সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে নিখিল কুমার চাকমা বলেন, ‘দলের কাউন্সিলর ও নেতাকর্মীদের অনুরোধেই আমি প্রার্থী হয়েছি। দীপংকর দাদা দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি মনে করছি—আমাকে নির্বাচিত করলে দলের কাজে আরও গতি আসবে এবং দলের নেতাকর্মীদের আরও বেশি সক্রিয়ভাবে কাজে লাগাতে পারব। জয়ের ব্যাপারে ভীষণ আশাবাদী আমি।’
এ বিষয়ে সাবেক পৌর মেয়র ও কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান বলছেন, ‘সারা দেশের সঙ্গে পার্বত্য রাজনীতির সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এখানে বিএনপি-জামাতের পাশাপাশি আঞ্চলিক দলগুলোর অপতৎপরতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হয় আওয়ামী লীগকে। সুতরাং আমাদের এমন নেতৃত্বই নির্বাচন করতে হবে, যাঁরা পরীক্ষিত এবং এ লড়াইয়ে নিজেদের এরই মধ্যে প্রমাণ করেছেন।’
হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ‘যারা নিকট বা দূর অতীতে কখনোই আঞ্চলিক দলগুলোর সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার সততা দেখাতে পারেনি, সোচ্চার ছিল না মোটেও, আমরা কাউন্সিলরেরা তাদের বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় রাখব।’
এদিকে, সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হওয়া হাজি মুছা মাতব্বর ও হাজি কামাল উদ্দিনের দ্বৈরথ বেশ জমে উঠেছে।
বর্তমান সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. মুছাও সাধারণ মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। হাজি মুছা মাতব্বর করোনাকালে মানুষের পাশে থেকে মানবিক কার্যক্রম, উপজেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং সবার সঙ্গে নমনীয় আচরণের কারণে এ পদে পুনরায় শক্ত প্রার্থী তিনিই।
আরেক সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা হাজি কামাল মূলত ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া কামাল জেলা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ কাউন্সিলে ভোটের লড়াইয়ে হেরেছেন মুছার কাছেই। চার প্রার্থীর মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ কামাল পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য।
হাজী কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার পুঁজি হচ্ছে সততা। এ সততার যারা সমর্থক, তারা আমাকে নির্বাচিত করবে। অনেক টাকাপয়সার ছড়াছড়ি হচ্ছে, তাতে কাজ হবে না। তারা আমার বিরুদ্ধে আঞ্চলিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ আছে বলে যে অপপ্রচার করছে, সেটা যে সত্য নয়, এটা তারাও জানে।’
অন্যদিকে, হাজি মুছা মাতব্বর বলেন, ‘আমি ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যে রাজনীতি শুরু করেছিলাম, সেখানেই স্থির থাকব আমৃত্যু। জননেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে পাহাড়ে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিতের ওপর দাঁড় করাতে জীবনবাজি রেখে কাজ করেছি এবং করে যাচ্ছি। আমাদের নেতাকর্মীরা, কাউন্সিলরেরা অবশ্যই তার মূল্যায়ন করবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে।’
টাকা ছড়ানোর অভিযোগ উড়িয়ে মুছা আরও বলেন, ‘যারা আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তারা অমানুষ। বরং যারা অভিযোগ করছে, তারাই টাকা ছড়াচ্ছে।’
অন্যদিকে, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, ‘আমাদের সম্মেলনের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশে সব প্রার্থী যাঁর যাঁর প্রচারনায় ব্যস্ত। এটা খুবই ভালো একটা দিক। দলের গণতন্ত্রের চর্চা অবারিত হয়েছে। কাউন্সিলরেরাও স্বাধীনভাবে তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন বলে আমার বিশ্বাস। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমাদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।’
আসন্ন সম্মেলন ঘিরে বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে রাঙামাটির রাজনৈতিক অঙ্গন। দীপংকর-নিখিল ও মুছা-কামাল দ্বৈরথে জমে উঠেছে স্থানীয় রাজনীতি। জেলাজুড়ে প্রাণচাঞ্চল্য আর জোর আলোচনা—পরিবর্তন নাকি ধারাবাকিতা, তা নিয়েই। ২৪ মে সন্ধ্যায় সম্ভবত মিলবে সব প্রশ্নের উত্তর।