২০২১ সালের বিজয় দিবসে মেট্রোরেলে চড়বে রাজধানীবাসী

২০২১ সালের বিজয় দিবসটি রাজধানীবাসীর জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ওই দিনই স্বপ্নের মেট্রোরেলে করে রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলে আসবেন উত্তরা ও মিরপুরের বাসিন্দারা। কাজ শেষে আবার বিকেলে এ মেট্রোরেলে করেই ফিরবেন কর্মজীবী মানুষ। উত্তরা থেকে মেট্রোতে চড়ে ৪০ মিনিট পর চলে যাবে মতিঝিলে। রাজধানী ঢাকার চিরায়ত যানজটে পড়ে তাঁদের ধুঁকে ধুঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করতে হবে না।
স্বপ্নের মেট্রোরেল নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গেই এ কথা জানালেন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তদারকির জন্য একাধিক টিম থাকলেও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই তদারক করছেন এ প্রকল্পের কাজ। কাজ এগিয়ে চলেছে পূর্ণমাত্রায়।
যানজটে নাকাল নগরবাসীর মনে একসময় এ মেট্রোরেল ছিল স্বপ্নের মতো। এখন আর এটি স্বপ্ন নয়, অতি বাস্তব। পুরো মেট্রোরেল প্রকল্পকে দুই অংশে বিভক্ত করে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন জাপানি প্রকৌশলীরা।
উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম অংশের কাজের এ পর্যন্ত ৬৪ শতাংশ শেষ হয়েছে। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত অংশের কাজের অগ্রগতি ৩৪ শতাংশ। বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন, জাপানে মেট্রোরেল কোচ তৈরিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামোগত কাজের অগ্রগতি ২২ শতাংশ পর্যন্ত শেষ হয়েছে। এনটিভি অনলাইনকে এ তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক।
এম এ এন সিদ্দিক আরো বলেন, ‘জাপানি প্রযুক্তিতে জাপানেই তৈরি হচ্ছে মেট্রোরেল প্রকল্পে চলাচলের জন্য রেল কোচ, ইঞ্জিন, রেললাইনে ব্যবহৃত ট্র্যাক তৈরির কাজ। আগামী বছরের ১৫ জুন প্রথম রেল কোচটি বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করবে। পর্যায়ক্রমে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের আগেই অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সামগ্রী চলে আসবে।’

একনজরে মেট্রোরেল
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা মেট্রো রেল ব্যবস্থাকে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) নামে একটি কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। অতি জনবহুল ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা ও পথের দুঃসহ যানজট কমিয়ে আনতে এমআরটি স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই ‘ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ নামে একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার।
২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার ‘মেট্রোরেল প্রকল্প’ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন লাভ করে। ২০.১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) প্রকল্প ঋণ ৭৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ২৫ শতাংশ। ২০১৬ থেকে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হয়।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাইকা। বাকি পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার জোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। মেট্রোরেল প্রকল্প লাইনের পুরো কাজ আটটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্যাকেজ ৩ ও ৪-এর আওতায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার উড়ালপথ ও নয়টি স্টেশন নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে ৬৪ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
মেট্রোরেল ব্যবস্থায় প্রথম ধাপে প্রতিদিন ২৪টি ট্রেন চলাচল করবে। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলবে ট্রেনগুলো। প্রতি ট্রেনে থাকবে ছয়টি বগি। একটি ট্রেনে এক হাজার ৬৯৬ জন যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। এর মধ্যে বসে যেতে পারবেন ৯৪২ জন, বাকিরা দাঁড়িয়ে যেতে পারবেন। একটি স্টেশনে ট্রেন অবস্থান করবে ৪০ সেকেন্ড। উত্তরা থেকে মতিঝিলে এ ট্রেন আসতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট।
যাত্রীরা ফুটপাত থেকে সিঁড়ি, এসকেলেটর কিংবা লিফটে করে উঠতে পারবেন ট্রেনে। মেট্রোরেলের প্রতিটি পিলারের ব্যাস দুই মিটার, ভূগর্ভস্থ অংশের ভিত্তি হলো তিন মিটার ও উচ্চতা হবে ১৩ মিটার। একটি স্তম্ভ থেকে আরেকটির দূরত্ব ৩০ থেকে ৪০ মিটার। স্তম্ভের ওপরে পাশাপাশি ও সমান্তরাল দুটি রেলপথ থাকবে এবং লাইনগুলোর প্রস্থ হবে প্রায় ৯.১ মিটার।

রুট ও স্টেশন
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মেট্রো রেলের চূড়ান্ত রুট হচ্ছে উত্তরা তৃতীয় ধাপ-পল্লবী, রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে (চন্দ্রিমা উদ্যান-সংসদ ভবন) খামারবাড়ি হয়ে ফার্মগেট-সোনারগাঁও হোটেল-শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বর-তোপখানা রোড থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত। সম্পূর্ণ রুটের ১৬টি স্টেশন থাকছে। এগুলো হচ্ছে উত্তরা, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, আইএমটি, মিরপুর সেকশন-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম ও বাংলাদেশ ব্যাংক। ট্রেন চালানোর জন্য বিদ্যুৎ নেওয়া হবে জাতীয় গ্রিড থেকে। ঘণ্টায় দরকার হবে ১৩.৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর জন্য উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁ ও বাংলা একাডেমি এলাকায় পাঁচটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থাকবে।

সরেজমিনে মেট্রোরেল
নির্মাণকারী সংস্থার সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা চলতি বছরে ডিসেম্বরের মধ্যে। সরেজমিনে এ প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পিলার নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হলেও পরবর্তী অংশের কাজ এখনো অনেক বাকি। ফার্মগেট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত কোথাও কোথাও কিছু কিছু পিলার উঠলেও অধিকাংশ পিলারের জন্য মাটি খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। বিশাল বিশাল যন্ত্র দিয়ে চলছে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি ও ভারি গার্ডার উত্তোলনের কাজ। প্রকল্পজুড়েই নির্মাণ শ্রমিকদের কলরব। নিরাপত্তাবেল্ট বেঁধে কাজ করছেন তাঁরা। নির্দেশনা দিচ্ছেন দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা। পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে এসব সামগ্রী ও নির্মাণকাজ। অনেক যাত্রী এসব দাঁড়িয়ে দেখছেন।
প্রকল্পের কাজ দুই বছর পিছিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘এটি একটি বড় প্রকল্প। অনেক অবকাঠামো ও ভূগর্ভস্থ স্যুয়ারেজ লাইন ও বৈদ্যুতিক লাইন সরাতে হচ্ছে। এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এ কারণেই সময় একটু বেশি লাগছে। তা ছাড়া এ প্রকল্পের পুরো কারিগরি সহায়তা দিচ্ছেন জাপানি প্রকৌশলীরা। হলি আর্টিজানের মতো একটি মর্মান্তিক ঘটনার পর এ প্রকল্পের কাজ কিছুটা গতিহীন হয়ে পড়ে। এখন সবকিছু কাটিয়ে উঠে আমরা কাজকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে রাজধানীবাসীর জন্য উপহার থাকবে এ মেট্রোরেল।’